প্রহেলিকা রিভিউ: বহস্যের মায়াজালে মাহফুজ আহমেদের স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন

প্রহেলিকা রিভিউ

চলচ্চিত্রের নামঃ প্রহেলিকা (২০২৩)
মুক্তিঃ জুন ২৯, ২০২৩
অভিনয়েঃ মাহফুজ আহমেদ, শবনম বুবলি, নাসির উদ্দিন খান, রাশেদ মামুন অপু এবং এ কে আজাদ সেতু প্রমুখ
পরিচালনাঃ চয়নিকা চৌধুরী
প্রযোজনাঃ জামাল হোসেন
পরিবেশনাঃ জাজ মাল্টিমিডিয়া (বাংলাদেশ), দেশি ইভেন্টস ও পথ প্রডাকশন (অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড)
কাহিনী এবং চিত্রনাট্যঃ পান্থ শাহরিয়ার
সম্পাদনাঃ রমজান আলী
চিত্রগ্রহনঃ সুমন হোসেন
সংগীতঃ ইমন সাহা

প্রারম্ভিক কথাঃ নাট্য নির্মাতা হিসেবে চয়নিকা চৌধুরী খুবই পরিচিত মুখ। ২০২০ সালে ‘বিশ্বসুন্দরী’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দার নির্মাতা হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন চয়নিকা। অন্যদিকে ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জিরো ডিগ্রী’ সিনেমার ৮ বছর পর বড় পর্দায় ফিরলেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ। চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘প্রহেলিকা’ মাহফুজের এই প্রত্যাবর্তনের সিনেমা। দর্শকদের মাঝে আগ্রহ তৈরির জন্য বস্তুত এই দুটি নামই যতেষ্ট। তবে মুক্তির আগে ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার গানগুলো দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। সব মিলিয়ে গত ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর ভিড়ে ঠিক জায়গা করে নিয়েছিলো ‘প্রহেলিকা’। দর্শকদের এই প্রত্যাশার প্রতি কতটুকু সুবিচার করতে পারলেন চয়নিকা চৌধুরী? কেমন হলো মাহফুজ আহমেদের প্রত্যাবর্তন? আজকের রিভিউতে এই বিষয়গুলো নিয়েই থাকছে বিস্তারিত আলোচনা।

কাহিনী সংক্ষেপঃ অনেকটা গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত হয়েছে ‘প্রহেলিকা’ সিনেমাটি, যেখানে গল্পের শুরুতে দুই গ্রামের মারামারি দেখতে পাই আমরা। সেই মারামারিতে বল্লমের আঘাতে একজন খুন হলে, গ্রামের সব পুরুষের নামে থানায় মামলা হয়। উক্ত মামলার প্রেক্ষিতে স্থানীয় চেয়ারম্যানের পরামর্শে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় মনা (মাহফুজ আহমেদ)। গ্রাম থেকে পালিয়ে মনা আশ্রয় নেয় এক সময়ের জমিদার ও সংগীত অনুরাগী জামশেদের (নাসির উদ্দিন খান) বাসায়। সেখানেই মনার সাথে পরিচয় হয় জামশেদের স্ত্রী অর্পা (শবনম বুবলি) এবং বাড়ির চাকর আবুল (এ কে আজাদ)-এর সাথে। এই চারটি চরিত্র নিয়েই মূলত ‘প্রহেলিকা’ গল্পের বুনিয়াদ।

জামশেদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার পর মনা বুঝতে পারে জামশেদ এবং অর্পার সম্পর্কে রহস্যের বেড়াজাল রেয়েছে। সেই সাথে আবুলও সেই সম্পর্কের একটি অংশ। জামশেদ, অর্পা এবং আবুলের সম্পর্কের সমীকরণে নতুন করে যুক্ত হয়ে যায় মনা। অর্পার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে নিজেকে জটিল এক পরিস্থিতির মুখোমুখি আবিষ্কার করে মনা। এর মধ্যে সেখানে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এক ঝামেল থেকে বাঁচতে এসে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নতুন প্রহেলিকায় আটকা পরে সে। অর্পাকেও নিয়েও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দোল খেতে থাকে মনা। সময়ের সাথে অর্পার অতীত নিয়ে রহস্য আরো ঘনীভূত হতে থাকে।

সিনেমার পরের অংশটুকু মূলত সেই রহস্যের নতুন সমীকরণের। জামশেদ, অর্পা না মনা – কার হাতে সেই প্রহেলিকার মূল চাবিকাঠি। আবুল কি শুধুই বাড়ির কাজের লোক, নাকি এই প্রহেলিকায় আবুলও আছে শক্ত চাবুক হাতে? ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা কি আসলেই অনাকাঙ্ক্ষিত না কোন পরিকল্পনার অংশ? সেই ঘটনার সাথে জড়িয়ে যাওয়া কি মনার দূর্ভাগ্য না নিয়তি? মনা কি পারবে এই প্রহেলিকা থেকে নিজেকে বের করে আনতে? জামশেদ এবং অর্পার গল্পেরইবা পরিণতি কি? এই সব প্রশ্ন আর রহস্যের শেষটা জানতে আপনাকে দেখতে হবে ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত।

গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন পান্থ শাহরিয়ার। এই সিনেমার গল্পের বুনিয়াদ শক্তিশালী এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেকগুলো সম্ভাবনার ছবি দিয়ে পান্থ শাহরিয়ার এই সিনেমার গল্প সাজিয়েছেন। কিন্তু গল্পের তুলনায় সিনেমাটির চিত্রনাট্য সেভাবে গোছাতে পারেননি তিনি। গল্প যতটা ভালো, চিত্রনাট্য ঠিক ততটাই দূর্বল। থ্রিলার এবং রহস্য নির্ভর গল্পকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। পান্থ শাহরিয়ার সেখানে ঠিক খেই হারিয়ে ফেলেছেন। চিত্রনাট্যের দূর্বলতার কারনে অনেক জায়গায় সিনেমাটি উত্তেজনা হারিয়ে ফেলে। আর এটিই এই সিনেমার সবচেয়ে দূর্বল দিক বলে মনে হয়েছে।

পরিচালনাঃ ‘বিশ্বসুন্দরী’ সিনেমায় নির্মাতা হিসেবে নিজের সম্ভাবনার জানান দিয়েছিলেন চয়নিকা চৌধুরী। ‘প্রহেলিকা’ সিনেমায় সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন এই নির্মাতা। তবে দ্বিতীয় সিনেমা হিসেবে আরো পরিপক্কতা প্রত্যাশিত ছিলো। বেশ কিছু জায়গায়, গল্পের সাথে নির্মাতা হিসেবে সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন চয়নিকা। বিশেষ করে, অর্পা এবং মনার কাছে আসাটাকে আরো আকর্শনীয় করতে পারতেন তিনি। কিন্তু সিনেমায় মনে হয়েছে এখানে অনেক বেশী তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন চয়নিকা। এছাড়া কয়েকটি দৃশ্যকে তিনি সিনেমার মূল গল্পকে রহস্যের প্রহেলিকার সাথে সংযোগ ঘটাতে পারেননি বলে মনে হয়েছে।

অভিনয়ঃ মনা চরিত্রে মাহফুজ আহমেদ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ‘জিরো ডিগ্রী’ সিনেমায়ও এরকম একটি চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। একইভাবে ‘প্রহেলকা’ সিনেমার রহস্যের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে হাজির হয়েছেন মাহফুজ আহমেদ। একই লুকে পুরো সিনেমা পার করে দিলেও, অভিব্যাক্তি দিয়ে প্রতিটি দৃশ্যে নিজের আলাদা স্বত্বাকে উপস্থাপন করতে সক্ষম ছিলেন মাহফুজ। অন্যদিকে এই সিনেমার অন্যতম দূর্বল দিক হচ্ছেন বুবলি। অর্পা চরিত্রে বুবলিকে পুরোপুরি বেমানান মনে হয়েছে। এছাড়া সংলাপ বলার ক্ষেত্রে খবর পরার সেই ধাঁচটা এখনো রয়ে গেছে বুবলির মাঝে।

মাহফুজ আহমেদ এবং বুবলির পর এই সিনেমার প্রধান চরিত্রে ছিলেন নাসির উদ্দিন খান। জামশেদ চরিত্রে নাসির বরাবরের মতই দারুণ অভিনয় করেছেন। তার প্রতিটি দৃশ্যই সিনেমাকে আলাদা এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আবুল চরিত্রে এ কে আজাদ সেতু ভালো অভিনয় করেছেন। যদিও সিনেমায় তার পর্দা উপস্থিতি কম ছিলো, তিনি দর্শককে হতাশ করেননি। বুবলির পর সিনেমাটির অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছেন রাশেদ মামুন অপু। ডিবি অফিসার চরিত্রে তাকে খুবই বেমানান মনে হবে দর্শকদের। একজন ডিবি কর্মকর্তার চরিত্রের গভীরতার কাছে রাশেদ মামুন অপুর ব্যক্তিত্ব মার খেয়েছে বাজেভাবে। এছাড়া পুরো সিনেমায় তার অভিনয়কে অতি-অভিনয়ের দুষে দুষ্ট লেগেছে।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ একটি গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার চিত্রগ্রহণে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সুমন হোসেন। দারুণ লোকেশনে চিত্রায়িত সিনেমাটির প্রতিটি ফ্রেম ভালো অনুভূতির জন্ম দিবে। বিশেষ করে সিনেমাটিতে ব্যবহৃত বৃষ্টির দৃশ্যগুলো পর্দায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। এছাড়া মাহফুজ আহমেদ এবং বুবলির ডুব সাঁতার কিংবা নৌকায় করে ঘুরার দৃশ্যগুলো দারুণভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন সুমন হোসেন।  রমজান আলীর সম্পাদনা ছিলো মাননসই। আর চিত্রনাট্যের দূর্বলতার কারনে, সম্পাদনায় তেমন কিছুর সুযোগ পাননি। চিত্রগ্রহণের পাশাপাশি ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার সংলাপ ছিলো অতুলনীয়। বেশীরভাগ সংলাপেই ছিলো রহস্যের জাল। অনেকগুলো দৃশ্যে সংলাপ দিয়েই উৎরে গেছেন চয়নিকা চৌধুরী।

উপসংহারঃ ‘প্রহেলিকা’ সিনেমাটির ক্লাইম্যাক্স প্রশংসার দাবীদার। সম্পর্কে পাওয়া এবং না পাওয়া, স্বাভাবিক জীবনকে নতুন সমীকরণের সামনে দাড় করিয়ে দেয়ার গল্পের সিনেমা ‘প্রহেলিকা’। বাহ্যিক আবরণের আড়ালে সম্পর্কের গভীরতা সিনেমাটিকে বেশ আকর্শনীয় করেছে। গল্পের বুনন, চিত্রগ্রহণ, মাহফুজ আহমেদ এবং গান – এই জিনিসগুলো আপনাকে অন্তত হতাশ হতে দিবে না। সার্বিক বিবেচনায় সিনেমাটি আরো ভালো হতে পারত এতে কোন সন্দেহ নেই, তবে যতটুকু হয়েছে সেটিও সিনেমা হিসেবে উল্লেখ করার মত। না দেখে থাকলেও, আপনার ইচ্ছে তালিকায় এখই যোগ করে নিতে পারেন চয়নিকা চৌধুরীর সিনেমা ‘প্রহেলিকা’।

প্রহেলিকা রিভিউ

আরো পড়ুনঃ
প্রিয়তমা রিভিউ
সুড়ঙ্গ রিভিউ
ডেড রেকনিং – পার্ট ওয়ান রিভিউ

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d