ওপেনহেইমার রিভিউ: ক্রিস্টোফার নোলানের আরো একটি দুর্দান্ত সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা

ওপেনহেইমার রিভিউ

চলচ্চিত্রের নামঃ ওপেনহেইমার (২০২৩)
মুক্তিঃ জুলাই ২১, ২০২৩
অভিনয়েঃ কিলিয়ান মারফি, এমিলি ব্লান্ট, ম্যাট ড্যামন, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, ফ্লোরেন্স পুগ, জোশ হার্টনেট, ক্যাসি অ্যাফ্লেক, রামি মালেক এবং কেনেথ ব্রানাঘ প্রমুখ
পরিচালনাঃ ক্রিস্টোফার নোলান
প্রযোজনাঃ এমা থমাস, চার্লস রোভেন এবং ক্রিস্টোফার নোলান
পরিবেশনাঃ ইউনিভার্সাল পিকচার্স
কাহিনীঃ কাই বার্ড এবং মার্টিন জে শেরউইনের আমেরিকান প্রমিথিউসঅবলম্বনে
চিত্রনাট্যঃ ক্রিস্টোফার নোলান
সম্পাদনাঃ জেনিফার লেম
সিনেমাটোগ্রাফিঃ হোটে ভ্যান
সংগীতঃ লুডভিগ গোরানসন

প্রারম্ভিক কথাঃ হলিউডের অন্যতম মেধাবী নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান। জটিল প্রেক্ষাপটে দারুণ গল্প এবং চিত্রনাট্যে সিনেমা নির্মানের জন্য বিখ্যাত তিনি। তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমায় তিনি একটু ভিন্ন বিষয় নির্বাচন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমার আবিষ্কারকের উপর ভিত্তি করে তিনি নির্মান করেছেন ‘ওপেনহেইমার’ সিনেমাটি। তবে সিনেমাটিকে কিছুটা জীবনী ভিত্তিক মনে হলেও, আসলে তার ফোকাস ছিলো ভিন্ন। অতীতের মত তার নতুন এই সিনেমাটি নিয়েও দর্শকদের আগ্রহ ছিলো ব্যাপক। সিনেমাটিতে ক্রিস্টোফার নোলান দর্শকদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে সক্ষম হলেন, তার বিস্তারিত আলোচনা থাকছে আজকের এই রিভিউতে।

কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটি একজন মূলত একজন বিজ্ঞানীর গল্প। জে রবার্ট ওপেনহেইমার (কিলিয়ান মারফি) আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী একজন ইহুদি যিনি রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এরপর ১৯২৭ সালে জার্মানির গটিংজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকাকালীন ওপেনহাইমার তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায়, বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার গবেষণা কর্ম মার্কিন সরকারের নজরে আসলে, তারা তাকে ম্যানহাটন প্রকল্পে নিয়োগ দেয়।

এরপর তিনি নিউ মেক্সিকোতে এই প্রকল্পের লস আলামোস ল্যাবরেটরির পরিচালক নিযুক্ত হন। ওপেনহাইমারও এই ল্যাবরেটরির জন্য প্রত্যন্ত জায়গার পরামর্শ দেন এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল লেসলি গ্রোভস (ম্যাট ড্যামন)-কে একটি অস্থায়ী শহর তৈরির নির্দেশ দেন। এই শহরে বার, গির্জা, স্কুল ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে বলেন, যাতে তার বিজ্ঞানীরা তাদের পরিবারকে নিয়ে এখানে আসতে উত্সাহিত হয়। তার লক্ষ্য ছিলো বিজ্ঞানীদের একাকীত্ব এবং পরিবারের চিন্তায় যেন তাদের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেই ধারাবাহিকতায়, জে রবার্ট ওপেনহেইমার তার বিজ্ঞানীদের নিয়ে ম্যানহাটন প্রকল্পের গবেষণা কাজ এগিয়ে নিতে থাকেন।

ম্যানহাটন প্রকল্পে ওপেনহেইমারের মূল কাজ ছিলো বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা। আর সেটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কারণ, জার্মানি ইতিমধ্যে একটি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জার্মানির আগেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে হবে। সন্দেহাতীতভাবে ওপেনহাইমার তার কাজে সফল হয়েছিলেন, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা সবাই জানি যে জার্মানির আত্মসমর্পনের পর জাপানকে কাবু করতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই কাজটি কতটুকু সহজ ছিলো? জে রবার্ট ওপেনহাইমারকে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য কেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল? আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার জীবনে এর প্রভাব কেমন ছিলো সেটি নিয়েই সিনেমার বাকি অংশ।

গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ ‘ওপেনহাইমার’ কাই বার্ড এবং মার্টিন জে শেরউইনের ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’-এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পারমাণবিক অস্ত্রে ঐতিহাসিক দৃশ্যায়ন। কিন্তু সিনেমাটি আসলে সেই জানা ইতিহাসের ভিতরের ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। জে রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবন এবং যুদ্ধের পরে তাকে কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল সেই অজানা কথাই বড় পর্দায় উঠে এসেছে ক্রিস্টোফার নোলানের হাত ধরে। গল্পটি নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত ছিলো, যা ঐ সময়ের ঘটনা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ অবলম্বনে এই সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন ক্রিস্টোফার নোলান নিজেই। আর তার চিত্রনাট্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। খুবই চমকপ্রদ চিত্রনাট্যে গল্পকে উপস্থাপন করেছেন এই নির্মাতা। ১৮০ মিনিটের মধ্যে ক্রিস্টোফার নোলান অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন যে সিনেমাটি যেন দর্শকদের আকৃষ্ট করে রাখে। সাদাকালো এবং রঙ্গিন আবহে, দুটি ভিন্ন সময়কে সমান্তরালে নিয়ে আসতে পারার চমক একমাত্র তার পক্ষ্যেই সম্ভব। এছাড়া সিনেমাটির সংলাপ দর্শকদের কাছে এর আবেদনকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

পরিচালনাঃ ক্রিস্টোফার নোলানের নির্দেশনা প্রত্যাশিতভাবেই অতুলনীয় ছিলো। সিনেমার গল্প এবং ধারা বর্ননা সরল ছিলো না। দুটি ভিন্ন সময়ের গল্পের পাশাপাশি এতে একাধিক সমান্তরাল পরিপেক্ষিত রয়েছে। ক্রিস্টোফার নোলান এই জায়গাগুলো সাজিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। ফলস্বরূপ, বিভিন্ন সময়ে ইঙ্গিত রেখে যাওয়া কিছু ঘটনা সম্পর্কে দর্শকরা কৌতূহলী হয় উঠে। এছাড়া সিনেমাটিতে তার সাউন্ড এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কার্যকরভাবে ব্যবহার আলাদাভাবে উল্লেখের দাবী রাখে।

উল্টো দিকে, নোলান পরিচালিত অন্য সিনেমাগুলোর মত ‘ওপেনহাইমার’-ও জটিল সিনেমা। বিষয়বস্তুর বুঝে উঠতে এবং নিজেকে সিনেমার ধারা বর্ননার সাথে অভ্যস্ত করতে একটু সময় লাগে। পূর্ণ একাগ্রতা ছাড়া সিনেমাটি বুঝে উঠা কঠিন, একাগ্রতা স্বত্বেও কিছু দৃশ্য সাধারণ মানুষের মাথার ওপর দিয়ে যেতে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ, কেন কিছু দৃশ্য সাদাকালো এ দেখানো হয়েছে তা অনেকেই বুঝতে পারবেন না। এছাড়া সিনেমাটিতে রোম্যান্টিক বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ন হলেও, সেগুলো খুব দ্রুত চলে যায়। বহুল আলোচিত ‘চেভালিয়ার ঘটনা’-ও কার্যকরভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি নোলান।

অন্যদিকে ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার শুরুর অংশগুলো বেশ মজাদার ছিলো, বিশেষ করে প্রাথমিক ১৫ থেকে ২০ মিনিট যখন বিভিন্ন চরিত্রগুলোকে দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। আর ওপেনহাইমার লেসলি গ্রোভসের সাথে দেখা করে এবং ম্যানহাটন প্রজেক্টের জন্য চূড়ান্ত হয়, তখন সিনেমাটির মূল গল্প ডালপালা গজাতে শুরু করে। ওপেনহাইমার যেভাবে তার কাজ সম্পন্ন করেন এবং লক্ষ্য অর্জন করে সেগুলো পর্দায় একটি বিনোদনমূলক পরিবেশ তৈরি করে। আর বিরতির পর বিস্ফোরণের পরীক্ষা এবং সেই দৃশ্যের বিল্ড আপ অসামান্য ছিলো। তবে সমান্তরালভাবে চলতে থাকা তদন্তের দৃশ্যগুলি খুব আকর্ষণীয় ছিলো।

অভিনয়ঃ নাম ভূমিকায় কিলিয়ান মারফি দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। ওপেনহাইমার চরিত্রে তিনি ছিলেন পুরোপুরি প্রাকৃতিক এবং চরিত্রটিকে পুরোদমে নিজের ভিতরে লালন করেছেন মারফি।  রবার্ট ডাউনি জুনিয়র (লুইস স্ট্রস) তার চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন। একই কথা প্রজয্য ম্যাট ডেমনের ক্ষেত্রেও। এমিলি ব্লান্ট (কিটি) এবং ফ্লোরেন্স পুগের (জিন ট্যাটলক) নিজেদের চরিত্রে অসাধারণ চিহ্ন রেখে গেছেন। রামি মালেক (ডেভিড হল) একটি অতিথি চরিত্রে দুর্দান্ত ছিলেন। জেসন ক্লার্ক (রজার রব), কেসি অ্যাফ্লেক (বরিস প্যাশ), কেনেথ ব্রানাঘ (নিলস বোর), বেনি সাফডি (এডওয়ার্ড টেলার), ডিলান আর্নল্ড (ফ্রাঙ্ক ওপেনহেইমার), ম্যাথিয়াস শোয়েইফার (ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ) এবং জোশ হার্টনেট (আর্নেস্ট লরেন্স) নিজেদের জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন। আর আলবার্ট আইনস্টাইন চরিত্রে টম কন্টি মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন।

সঙ্গীত চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ লুডভিগ গোরানসনের সঙ্গীত ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী একটি দিক। সিনেমার মূল থিমটি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে প্রভাব ছড়িয়েছে। রিচার্ড কিং এর সাউন্ড ডিজাইনেও বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। হোটে ভ্যান-এর সিনেমাটোগ্রাফি অসামান্য এবং খুব প্রভাবশালী। তবে জেনিফার লেমের সম্পাদনা আরও তীক্ষ্ণ হতে পারত। রুথ ডি জং-এর প্রোডাকশন ডিজাইন অতীতের যুগের কথা মনে করিয়ে দিবে দর্শকদের।

উপসংহারঃ সামগ্রিকভাবে, ‘ওপেনহাইমার’ একটি চমত্কার সিনেমাটিক অভিজ্ঞতার প্রতিশব্দ। নিঃসন্দেহে চলতি বছরে হলিউডের অন্যতম সেরা সিনেমাগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে ‘ওপেনহাইমার’। আগেই যেমন বলেছি, ‘ওপেনহাইমার’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা এতে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের সিনেমা নয়। আবার ঠিক ওপেনহাইমারের জীবনীও নয়। সিনেমাটি আসলে, ওপেনাহাইমার এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে রাজনীতির গল্প। সফলতা অর্জন এবং সেই সাফল্যের পরিণতি – এই দুটির মধ্যকার সময়ের চিত্র বুঝতে হলে ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ আপনার জন্য এই মুহুর্তের অন্যতম সেরা আয়োজন।

ওপেনহেইমার রিভিউ

আরো পড়ুনঃ
ডেড রেকনিং – পার্ট ওয়ান রিভিউ
ফাস্ট টেন রিভিউ
নো টাইম টু ডাই রিভিউ

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d