হৃতিক রোশনের ফিল্মোগ্রাফিঃ খানদের ভিড়ে বক্স অফিসের নতুন সুপারস্টার

হৃতিক রোশনে

নব্বইয়ের পরবর্তি সময়ে বলিউডে যত তারকার আগমন ঘটেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নন্দিত তারকা হৃতিক রোশন। ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা দিয়েই নিজেকে সুপারস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন হৃতিক। এরপর বিগত তিন দশক ধরে নিজের তারকাখ্যাতি ঘরে রেখেছেন সফলভাবে। বক্স অফিসে সাফল্যের পাশাপাশি হৃতিক এমন কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছেন যা বলিউডে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ফিল্মীমাইকে বিশেষ ধারাবাহিক ফিল্মোগ্রাফি বিশ্লেষণে আজকে থাকছে বলিউড খানদের ভিড়ে বক্স অফিসের নতুন সুপারস্টার হৃতিক রোশনের গল্প।

তারকা পরিবার থেকে আগমন এবং মেধা দিয়ে রাজত্ব
হৃতিক রোশনের বাবা রাকেশ রোশন একজন অভিনেতা এবং নির্মাতা। অভিনেতা হিসেবে তিনি তেমন বড় মাপের না হলেও নির্মাতা হিসেবে রাকেশ রোশন বলিউডের অন্যতম সেরাদের একজন। তারকা পরিবারে জন্ম হওয়ার কারনে স্বভাবতই হৃতিক সিনেমায় অভিষেকে কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু অভিষেকের পর হৃতিক বলিউডে তার নিজস্ব জায়গা তৈরি করেছেন তার মেধা দিয়ে। এছাড়া অভিনয়ে আসার আগে থেকেই সিনেমার সাথে যুক্ত ছিলেন হৃতিক রোশন। বাবা রাকেশ রোশনের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কিছু সিনেমায়। শাহরুখ খান এবং সালমান খানকে নিয়ে রাকেশ রোশনের ‘করণ অর্জুন’ সিনেমার সহকারী পরিচালক ছিলেন হৃতিক রোশন।

হৃতিকের গত তিন দশকদের ফিল্মোগ্রাফি বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, খান পরবর্তি বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকা হচ্ছেন হৃতিক রোশন। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বলিউডে খান রাজত্বের পাশাপাশি যে তারকার নামটি সবচেয়ে বেশী শোনা যায় সেটি হচ্ছে হৃতিক রোশন। অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের শারীরিক গঠন এবং অসাধারণ নাচের জন্য দর্শক এবং নির্মাতাদের পছন্দের শীর্ষে হৃতিকের অবস্থান। আর অভিনয়ের দিক থেকে বললে, বহুমুখী অভিনয়ে হৃতিকের তুলনা শুধুই হৃতিক। ‘ধুম ২’ কিংবা ‘ওয়ার’ সিনেমায় যেমন তাকে দেখা গেছে দুর্দান্ত অ্যাকশন তারকা রুপে, তেমনি ‘সুপার ৩০’ এবং ‘গুজারিশ’ সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন অসাধারণ দক্ষতার সাথে।

হৃতিক রোশনের

এক সিনেমা দিয়েই সুপারস্টার
১৯৮০-এর দশকে হৃতিক বেশ কিছু সিনেমায় শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। এরপর রাকেশ রোশনের দুটি সহ মোট চারটি সিনেমার সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই তারকা। আর পুর্ন অভিনেতা হিসেবে বলিউডে তার অভিষেক হয়েছিলো বাবা নির্দেশনায় ‘কাহো না পেয়ার হ্যাঁ’ সিনেমার মাধ্যমে। মুক্তির পর সিনেমাটি বক্স অফিসে আলোড়ন তুলেছিলো এবং হৃতিক রোশন রাতারাতি সুপারস্টার হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। সিনেমাটি মুক্তির বছর ভারতীয় বক্স অফিসে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের সিনেমা ছিলো। প্রথম সিনেমার ৩ কোটির বেশী টিকেট বিক্রির মাধ্যমে হৃতিক দর্শক এবং নির্মাতাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত নাম হয়ে উঠেন।

‘কাহো না পেয়ার হ্যাঁ’ সিনেমার পর হৃতিক রোশন অভিনীত ‘ফিজা’ এবং ‘মিশন কাশ্মীর’ সিনেমাগুলো রেকর্ড উদ্বোধনী পেতে সক্ষম হয়েছিলো। এই দুই সিনেমার বক্স অফিসের উদ্বোধনী সহজেই সে সময়ের শীর্ষ তারকাদের সিনেমার উদ্বোধনী আয়ের চেয়ে বেশী ছিলো। এই দুটি সিনেমাই বক্স অফিসে বাণিজ্যিক সফল হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলো। যদিও, সিনেমাগুলোর প্রতি প্রত্যাশা আরো অনেক বেশী ছিলো। ‘কাহো না পেয়ার হ্যাঁ’ সিনেমার ঐতিহাসিক সাফল্যের কারনে, হৃতিকের প্রতি দর্শক এবং নির্মাতাদের আস্থা ছিলো আকাশচুম্বী। এক সিনেমা দিয়েই সুপারস্টার হৃতিক তাই ছিলেন চাহিদার শীর্ষে।

ফ্লপের পর আবারো সাফল্যের ধারাবাহিকতা
হৃতিক রোশন তার ক্যারিয়ারের প্রথম ফ্লপের দেখা পান ২০০১ সালে। এ বছর হৃতিক অভিনীত সুভাষ ঘাই পরিচালিত তারকাবহুল ‘ইয়াদে’ বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরেছিলো। এরপরই মুক্তি পায় করণ জোহর পরিচালিত তারকাবহুল সিনেমা ‘কাভি খুশি কাভি গাম’। সিনেমাটি মুক্তির পর বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে সর্বোচ্চ আয়ের সিনেমা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলো। এরপর হৃতিক অভিনীত টানা কয়েকটি সিনেমা বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিলো। ২০০২ এবং ২০০৩ সালের ‘কই মিল গায়া’ সিনেমার আগে পর্যন্ত হৃতিকের চারটি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুখ থুবড়ে পরেছিলো। বড় বাজেটে বড় নির্মাতাদের সিনেমা হওয়া স্বত্বেও, এই সবগুলো সিনেমা ফ্লপের খাতায় নাম লিখায়।

হৃতিক রোশনে

‘কই মিল গায়া’ এবং নতুন যুগের সূচনা
২০০৩ সালে রাকেশ রোশন পরিচালিত ‘কই মিল গায়া’ সিনেমার মাধ্যমে বক্স অফিসে আবারো ঝড় তুলেন হৃতিক রোশন। সিনেমাটি বক্স অফিসে সুপারহিট হওয়ার পাশাপাশি এতে হৃতিকের অভিনয় দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিলো। ‘কই মিল গায়া’ সিনেমার পর হৃতিক রোশনের ‘লক্ষ্য’ বক্স অফিসে ব্যর্থ হলেও সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলো। ২০০৪ সালের ‘লক্ষ্য’ সিনেমার পর ২০০৫-এ হৃতিকের কোন সিনেমা মুক্তি পায়নি। ২০০৬ সালে আবারো বক্স অফিসে ঝড় তুলেন এই তারকা। এ বছর হৃতিক অভিনীত ‘ধুম ২’ এবং ‘কৃষ ২’ সিনেমাগুলো বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলো।

সিনেমার মাঝে লম্বা বিরতি নিতে শুরু করেন হৃতিক
২০০৬ সালের পর হৃতিক রোশন তার সিনেমা মুক্তির মাঝে লম্বা বিরতি নিতে শুরু করেন। এছাড়া তিনি তার সিনেমার চিত্রনাট্য নির্বাচনেও বেশ কৌশলী হয়ে উঠেন। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তার এই চিত্রনাট্য নির্বাচন কিছুটা হলেও তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিলো। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সিনেমা ‘যোধা আকবর’ বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেও সেটি প্রত্যাশা অনুযায়ী ছিলো না। এছাড়া সিনেমাটির অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের কারনে সমালোচিত হয়েছিলো। এরপর হৃতিক অভিনীত ‘কাইটস’ এবং ‘গুজারিশ’ সিনেমাগুলো বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরেছিলো। তবে ‘গুজারিশ’ পরবর্তী সিনেমাগুলো ব্র্যান্ড হিসেবে হৃতিকের পুনরুত্থানকে নিশ্চিত করেছে।

বক্স অফিসে নতুন মাইলফলক অর্জন
হৃতিক রোশন অভিনীত ‘জিন্দেগী না মিলে দোবারা’ বক্স অফিসে হিট হওয়ার পাশাপাশি বলিউডের কাল্ট ক্ল্যাসিক সিনেমা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরপর হৃতিক অভিনীত ‘অগ্নিপথ’, ‘কৃষ থ্রী’ এবং ‘ব্যাং ব্যাং’ সিনেমাগুলো বক্স অফিসে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো। ‘অগ্নিপথ’ সিনেমার মাধ্যমে হৃতিক রোশন প্রথমবারের মত বক্স অফিসে ১০০ কোটি রুপির মাইলফলক অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘কৃষ থ্রী’ এবং ‘ব্যাং ব্যাং’ সিনেমাগুলোও ১০০ কোটির বেশী আয় করেছিলো। এরপরই আবার ‘কাবিল’ এবং ‘মহেঞ্জোদারো’ সিনেমা দুটি বক্স অফিসে সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।

‘ওয়ার’ এবং হৃতিকের প্রথম ৩০০ কোটি
২০১৯ সালে সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ‘ওয়ার’ সিনেমার মাধ্যমে ভারতীয় বক্স অফিসে ৩০০ কোটি রুপির মাইলফলক অতিক্রম করেন হৃতিক রোশন। যশ রাজ ফিল্মসের স্পাই ইউনিভার্সের অংশ হিসেবে নির্মিত সিনেমাটিতে হৃতিক ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন এজেন্ট চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সিনেমাটি মুক্তির পর বক্স অফিসে আলোড়ন তুলেছিলো। ২০১৯ সালে ‘ওয়ার’ ছাড়াও হৃতিকের ‘সুপার ৩০’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। এই সিনেমাটিও বক্স অফিসে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো। ২০০৬ সালের পর ২০১৯ সালেও দুটি বক্স অফিস সফল সিনেমা উপহার দেন বলিউডের গ্রীক দেবতা হৃতিক রোশন।

এখন পর্যন্ত হৃতিক অভিনীত মোট ১৬টি সিনেমা বক্স অফিসে সফল হয়েছে। এরমধ্যে ৬টি সিনেমা বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। হৃতিকের ব্লকবাস্টার এবং হিত/সুপারহিট সিনেমা তালিকায় চলুন চোখ বুলানো যাক।

ব্লকবাস্টার হিট/সুপারহিট
কাহো না পেয়ার হ্যাঁ কোই মিল গায়া
কাভি খুশি কাভি গাম অগ্নিপথ
কৃষ জিন্দেগী না মিলে দোবারা
ধুম ২ সুপার ৩০
কৃষ থ্রী
ওয়ার

হৃতিক রোশন অভিনীত সর্বশেষ ‘বিক্রম ভেধা’ বক্স অফিসে সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে সিনেমাটিতে একজন গ্যাংস্টার হিসেবে তার অভিনয় দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিলো। হৃতিক রোশন বর্তমানে সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ‘ফাইটার’ সিনেমার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভারতের প্রথম এরিয়েল অ্যাকশন সিনেমা ‘ফাইটার’ আগামী বছরের ২৫শে জানুয়ারি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। সিনেমাটিতে হৃতিকের বিপরীতে অভিনয় করছেন দীপিকা পাডুকোন। সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ‘পাঠান’ সিনেমাটির মত ‘ফাইটার’ সিনেমাটিও বক্স অফিসে রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

‘ফাইটার’ ছাড়াও হৃতিকের হাতে রয়েছে একাধিক বড় বাজেটের সিনেমা। জানা গেছে ‘ফাইটার’ সিনেমাটির কাজ শেষ করে হৃতিক ‘কৃষ ৪’ সিনেমার কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। সিনেমাটিতে তাকে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাবে। এছাড়া হৃতিক রোশন অভিনীত ব্লকবাস্টার ‘ওয়ার’ সিনেমার দ্বিতীয় পর্ব ‘ওয়ার ২’ নির্মানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যশ রাজ ফিল্মস। যশ রাজ ফিল্মসের স্পাই ইউনিভার্সের অংশ হিসেবে নির্মিতব্য ‘ওয়ার ২’ সিনেমাটি পরিচালনা করছেন ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ খ্যাত নির্মাতা অয়ন মুখার্জি। ‘ফাইটার’-এর পর এই দুটি সিনেমাও বক্স অফিসে ঝড় তুলবে বলে মনে করছেন বলিউডের ট্রেড বিশেষজ্ঞরা।

আরো পড়ুনঃ
ফিল্মোগ্রাফি বিশ্লেষণঃ অজয় দেবগনের বক্স অফিস মহারাজা হয়ে উঠার যাত্রা
‘ওয়ার ২’ সিনেমায় নতুন দৃশ্যপটঃ এনটিআরের অভিনয় শুধুই গুজব
স্পাই ইউনিভার্সের নতুন সিনেমা ‘ওয়ার ২’: পরিচালনায় অয়ন মুখার্জি

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d