চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ বক্স অফিসে ইতিমধ্যে ২০০ কোটি রুপির বেশী আয় করতে সক্ষম হয়েছে। মহামারী পরবর্তি সময়ে যেখানে বলিউডের শীর্ষ তারকাদের সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরছে, সেখানে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’-এর আয় সংশ্লিষ্টদের জন্য চমক হিসেবেই হাজির হয়েছে। তবে সিনেমাটির বক্স অফিস আয়ের পিছনে যতটা না সিনেমার মানের অবদান আছে, তার চেয়ে বেশী অবদান রেখেছে এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বিষয়বস্তুর কারনে সিনেমাটির প্রদর্শনি নিষিদ্ধও হয়েছে কিছু জায়গায়। তবে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়, বলিউডে অতীতেও এরকম দেখা গেছে। রাজনৈতিক কারনে নিষিদ্ধ হওয়া বলিউডের ছয়টি সিনেমা নিয়ে আলোচনা থাকছে এই প্রতিবেদনে।
০১। পদ্মাবত (২০১৮)
পনেরো শতকে সুফি কবি মালিক মহম্মদ জয়সির একটি কবিতার উপর ভিত্তি করে সঞ্জয় লীলা বনসালির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের এই সিনেমায় রানী পদ্মিনী চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীপিকা পাড়ুকোন। মুক্তির আগেই সিনেমাটি ব্যাপক বাধার মুখে পরেছিলো। রাজস্থান ভিত্তিক একটি সংগঠন কর্নি সেনা অভিযোগ করেছে যে সিনেমাটিতে রানী পদ্মিনী (দীপিকা পাড়ুকোন) এবং আলাউদ্দিন খিলজি (রণবীর সিং) এর মধ্যে একটি রোমান্টিক দৃশ্য রয়েছে। যদিও সিনেমাটির নির্মাতা বনসালি বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু কর্নি সেনা সেটি অগ্রায্য করে এবং সিনেমাটি নির্মানের বিরোধিতা করে। এমনকি দৃশ্যধারনের সময় সিনেমাটির সেটে হামলাও চালিয়েছিলো উক্ত সংঘটনটি।
কর্নি সেনার ব্যাপক বিরোধিতা এবং বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে ‘পদ্মাবত’ সিনেমাটি প্রথমদিকে গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং মধ্যপ্রদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। পরবর্তিতে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশে সেখানে সিনেমাটির মুক্তির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় এবং এটি ২৫শে জানুয়ারী সারা ভারতে মুক্তি পায়। এমনকি সিনেমাটি মুক্তির পরেও, প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বিক্ষোভ চলমান ছিলো। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি রাজ্য ‘পদ্মাবত প্রদর্শন’ করা প্রেক্ষাগৃহে পুলিশ সুরক্ষা দিয়েছিল। ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়া সিনেমাটি মুক্তির পর বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে দারুণ ব্যবসা করতে সক্ষম হয়েছিলো।
০২। আরাকশান (২০১১)
চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাত-ভিত্তিক আসন সংরক্ষণের উপর ভিত্তি করে সামাজিক-রাজনৈতিক সিনেমাটি উত্তর প্রদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া পর্যন্ত সিনেমাটি রাজ্যে দুই মাসের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। সাইফ আলি খান, দীপিকা পাড়ুকোন, অমিতাভ বচ্চন এবং প্রতীক বব্বর অভিনীত সিনেমাটিকে কেউ কেউ ‘দলিত বিরোধী এবং সংরক্ষণ বিরোধী’ বলেও অভিহিত করেছেন।
০৩। ফানা (২০০৬)
আমির খান এবং কাজল অভিনীত ফানা সিনেমাটি গুজরাটে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এই রাজ্যে সেটি আর কখনই মুক্তি পায়নি। তবে নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সিনেমার বিষয়বস্তুর কোনো সম্পর্ক ছিল না। মূলত গুজরাট সরকারের তৎকালীন ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনের (এনবিএ) প্রতি তার অবস্থানের কারণে ‘ফানা’ সিনেমার বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। আমির খান সর্দার মানসরোবরের উচ্চতা বাড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন যা ভারতীয় জনতা যুব মোর্চাকে বিরক্ত করেছিল। তারা হুমকি দিয়েছিল যে খান ক্ষমা না চাওয়া হলে সিনেমাটি নিষিদ্ধ করা হবে। আমির খান তার মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাননি এবং সিনেমাটি কখনই গুজরাটে মুক্তি পায়নি।
০৪। পারজানিয়া (২০০৪)
রাহুল ঢোলাকিয়া পরিচালিত ‘পারজানিয়া’ সিনেমাটিও গুজরাটে কখনও মুক্তি পায়নি। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময় গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যায় নিখোঁজ হওয়া একজন পার্সি ছেলের সত্য গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিলো সিনেমাটি। উগ্রবাদী সংঘঠন ‘বজরং দল’ সিনেমা হলগুলিকে এটি প্রদর্শন না করার হুমকি দিয়েছিল। সিনেমাটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজরাটে মুক্তি পায়নি কারণ প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এটি প্রদর্শন করতে অস্বীকার করেছিল।
০৫। ব্ল্যাক ফ্রাইডে (২০০৭)
লেখক হুসেন জাইদির ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে – দ্য ট্রু স্টোরি অফ মুম্বাই রাওটস’ বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিলো অনুরাগ কাশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। সিনেমাটি মুক্তিতে দুই বছর বিলম্ব হয়েছিল। কাশ্যপ বলেছিলেন যে সিনেমাটি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তিনি বিষণ্নতায় চলে গিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের মুম্বাইয়ে বোমা বিস্ফোরণের অপরাধীদের ধরতে ব্যাপক অভিযানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিলো এই সিনেমা। এতে কিছু ভারতীয় রাজনৈতিক নেতার নাম সহ আপত্তিকর বিষয়বস্তু ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিলো। পরবর্তিতে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ ভারতে মাত্র একশটি পর্দায় মুক্তি পেয়েছিল।
০৬। দ্য কাশ্মীর স্টোরি (২০১৩)
২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সিনেমাটি কেরালায় কথিত ধর্মীয় প্রবৃত্তিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। কীভাবে হিন্দু ও খ্রিস্টান নারীরা কট্টরপন্থী ইসলামিক ধর্মগুরুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলো, সেই গল্প উঠে এসেছে সিনেমায়। নির্মাতারা দাবি করনে যে, এই নারীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল এবং পরে আফগানিস্তান, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার মতো দেশে আইএসআইএসের হয়ে লড়াই করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। প্রথম তামিল নাড়ুর প্রেক্ষাগৃহ মালিক সমিতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি প্রদর্শনে অস্বীকার করেন। এরপর সিনেমাটি প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো কলকাতা রাজ্য সরকার। পরবর্তিতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে সিনেমাটির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিলো।
প্রিয় পাঠক, রাজনৈতিক কারনে নিষিদ্ধ হওয়া বলিউডের এই ছয়টি আলোচিত সিনেমার মধ্যে আপনার পছন্দের সিনেমার নাম আমাদের জানিয়ে দিন মন্তব্যে। উপরে উল্লেখিত এই ছয়টি সিনেমা ছাড়া আরো কয়েকটি বলিউড সিনেমা মুক্তির পর বাধার মুখে পরেছিলো। তবে সেগুলো নিষিদ্ধ বা বাধার মুখে পরার কারণ আসলে রাজনৈতিক ছিলো না। এই ছয়টি সিনেমা ছাড়া আর কোন সিনেমা এই তালিকায় থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করছেন সেটা জানিয়ে দিতে পারেন মন্তব্যে।
আরো পড়ুনঃ
এবার কলকাতায় নিষিদ্ধ হলো বলিউডের বিতর্কিত সিনেমা ‘দ্য কেরালা স্টোরি’
বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত বলিউডের ৫টি ভৌতিক সিনেমা
ভারতীয় সিনেমায় পুরুষতন্ত্রের নিয়ম ভঙ্গকারী দশটি নারী কেন্দ্রিক সিনেমা