করোনা মহামারীর কারনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই সিনেমায়ও বিরাজ করছিল স্থবিরতা। প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনা এবং ওটিটি প্লাটফর্মের জনপ্রিয়তার কারনে দর্শক আসবেন কি না, এমন শঙ্কায় সিনেমা মুক্তি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন নির্মাতারা। কিন্তু চলতি বছরের ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শান’ ও ‘গলুই’ সিনেমাগুলোর দর্শকপ্রিয়তা দেশীয় সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। এরপর ঈদুল আযহার তিনটি সিনেমা ‘পরাণ’, ‘দিনঃ দ্য ডে’ ও ‘সাইকো’ দেখতে প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করতে থাকেন দর্শক। ঠিক তার পরেই ‘হাওয়া’ সিনেমাটি আরো আশাবাদী করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
এরমধ্যে ‘পরাণ’ এবং ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটি স্মাপ্রতিক সময়ে বাংলা সিনেমার দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে দারুণভাবে। চতুর্থ এবং পঞ্চম সপ্তাহেও সিনেমাগুলো নিয়ে দর্শকদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। ‘পরাণ’ সিনেমার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাল্টিপ্লেক্স চেইন ছিলো ‘হাওয়া’ সিনেমা দখলে। এদিনে সর্বোচ্চ ২৬টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে স্টার সিনেপ্লেক্সে অনন্য এক রেকর্ড গড়েছিল এই সিনেমা। শুধু তাই নয় দর্শকপ্রিয়তা বিবেচনায় হলিউডের ‘থর’ সিনেমাটি নামিয়ে ‘হাওয়া’ চালানোর ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে।
বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের এমন আগ্রহ নিকট অতীতে আর দেখা যায়নি। সিনেমাগুলোর অসাধারণ সাফল্য ঢাকাই সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে আটকে থাকা সিনেমাগুলো মুক্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন নির্মাতারা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাঁদের সিনেমা মুক্তির তারিখ ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি দ্রুত দৃশ্যধারন শেষ করে সেন্সর বোর্ডে জমা দিচ্ছেন অনেক নির্মাতা।
নিঃসন্দেহে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাগুলো বাংলা সিনেমায় সুদিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কতটুকু প্রস্তুত ঢালিউড। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমাগুলো কি পারবে ঢাকাই সিনেমার প্রতি তৈরি হওয়া দর্শকদের প্রত্যাশা ধরে রাখতে। ইতিমধ্যে চলতি বছরের বাকী সময়ে মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতীক্ষিত সিনেমা। শাকিব খানের উপর ভর করে চলা ঢালিউড দেখলো ভালো গল্পের সিনেমার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা।
জানা গেছে চলতি বছরের আগস্ট মাসসহ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বেশ কয়েকটি সিনেমার মুক্তির ঘোষণা এসেছে। শাহিন সুমনের ‘মাফিয়া ফোর’ সিনেমাটি আগামী ১২ আগস্ট মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। আর তার এক সপ্তাহ পর ১৯ আগস্ট মুক্তি পাচ্ছে মোস্তাফিজুর রহমানের সরকারি অনুদানের সিনেমা ‘আশীর্বাদ’। একই নির্মাতার ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ নামে আরো একটি সিনেমা ১৬ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাবে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে মাহমুদ দিদারের বহুপ্রতীক্ষিত ‘বিউটি সার্কাস’ মুক্তি পাওয়ার কথা ২৩ সেপ্টেম্বর। একই দিনে দীপংকর দীপনের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘অপারেশন সুন্দরবন’ মুক্তির চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছেন নির্মাতারা। ‘অপারেশন সুন্দরবন’ মুক্তির পরের সপ্তাহে আসছে সাইদুল ইসলামের ‘বীরত্ব’। আর অক্টোবরের ৭ তারিখে মুক্তি পেতে যাচ্ছে মোস্তাফিজুর রহমানের ‘যাও পাখি বল তারে’ ও ইস্পাহানি আরিফ জাহানের ‘হৃদিতা’ সিনেমা দুটি। এছাড়া বেলাল সানির ‘ডেঞ্জারজোন’ এবং সুজন বড়ুয়ার ‘বান্ধব’ সিনেমাগুলোর মুক্তি পাচ্ছে যথাক্রমে ১০ এবং ২৮ অক্টোবর।
একের পর এক ছবি মুক্তির ঘোষণাকে ভীষণ ইতিবাচকভাবে দেখছেন ঢাকাই সিনেমা সংশ্লিষ্টরা। তবে এর মধ্যে খারাপ কিছুও দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ডিপজল তার প্রযোজিত এবং অভিনীত ৫টি সিনেমা ধারাবাহিকভাবে মুক্তির ঘোষণা করেছেন। সিনেমাগুলোর নাম এবং নির্মান দেখলেও বোঝা যায় দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ করার জন্য এই সিনেমাগুলোই যতেষ্ট। মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত এই সিনেমাগুলো মুক্তি পেলে ঢাকাই সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মাঝে যে আগ্রহ জন্ম নিয়েছে তা নষ্ট হতে বেশী সময় লাগবে না। ব্যক্তিরা। অনেকে বলছেন, বাংলা সিনেমার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। বাংলা সিনেমায় সুদিনের এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে এরকম বস্তা পচা সিনেমার বদলে পরপর ভালো সিনেমা মুক্তি দিতে হবে।
মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমাগুলো মধ্যে আরো রয়েছে শাকিব খান অভিনীত ‘লিডার, আমিই বাংলাদেশ’ এবং ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমা গুলো। তবে এই দুটি সিনেমার মুক্তির ব্যাপারে নির্মাতাদের কাছ থেকে কিছু এখনো জানা যায়নি। দুটি সিনেমাই দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এছাড়া মুক্তি প্রতীক্ষিত অন্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে আরিফিন শুভ অভিনীত গত বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিনেমার দ্বিতীয় পর্ব ‘ব্ল্যাক ওয়ার’। এই সিনেমাটির মুক্তির তারিখও এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের আগ্রহের বিষয়ে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ নির্মাতা দীপংকর দীপন বলেন, ‘ভালো সিনেমা দেখতে যে দর্শকের জোয়ার উঠবে, এটা জানতাম। কিন্তু এত দ্রুতই যে উঠবে, বুঝিনি। আমাদের তরুণেরা হলে গিয়ে ভালো সিনেমা দেখতে চান। পরাণ ও হাওয়া তার প্রমাণ। দেশীয় সিনেমার কারণে বিদেশি সিনেমাও নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে হল কর্তৃপক্ষ। এটা প্রমাণ করে যে দেশীয় সিনেমার সম্ভাবনা কত বেশি। এ কারণে সিনেমা মুক্তি দিতে প্রযোজক–পরিচালকদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।’
‘পরাণ’ খ্যাত নির্মাতা রায়হান রাফির ‘দামাল’ এবং ‘নূর’ নামে দুটি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘হলে দর্শক আসা শুরু হয়েছে। তাঁদের যে ভালো সিনেমা দেখার ক্ষুধা আছে, তা পরাণ দিয়েই টের পেয়েছি। দামাল আরও বড় ধামাকা হবে। এ ছবিতে পরাণ–এর দুই তারকা শরীফুল রাজ ও মিমের সঙ্গে সিয়ামও আছে। তিনজনের আলাদা ভক্ত-দর্শক আছেন। সবমিলে দর্শকের জন্য আরও বড় চমক নিয়ে আসছে দামাল।’
এছাড়া চলতি বছর মুক্তির অপেক্ষায় থাকা তিনটি সিনেমার নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান জানান বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হওয়াতেই তিন ছবি মুক্তি দিচ্ছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রে দর্শকখরা চলছিল। কয়েকটি মৌলিক সিনেমার কারণে আবারও দর্শক হলে আসছেন। দর্শকের দেখার অভ্যাস ধরে রাখতে একের পর এক ভালো সিনেমা দরকার। সে ভাবনা থেকেই ছবিগুলো মুক্তি দিচ্ছি।’ এছাড়া ‘আনন্দ অশ্রু’ নামে তার আরো একটি সিনেমা নভেম্বরে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এই সিনেমাগুলোর সাফল্যই প্রমাণ করে যে ভালো গল্পে সুনির্মিত সিনেমার দর্শক এখনো আছে। ‘শান’, ‘গলুই’, ‘দিনঃ দ্য ডে’, ‘পরাণ’ এবং ‘হাওয়া’ সিনেমাগুলোর মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় সুদিনের যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, সেটা ধরে রাখতে ভালো গল্পের সিনেমা দরকার। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘দামাল’, ‘অন্তরাত্মা’, ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ এর মত সিনেমাগুলো সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সবাই।
আরো পড়ুনঃ
ধারাবাহিকভাবে পাঁচ সিনেমা মুক্তির মাধ্যমে বড় পর্দায় ফিরছেন ডিপজল
আবারো কলকাতার সিনেমায় অভিনয়ের ইঙ্গিত দিলেন শাকিব খান
সিনেপ্লেক্সে রেকর্ড প্রদর্শনী নিয়ে মুক্তি পাচ্ছে আলোচিত সিনেমা ‘হাওয়া’