১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন ইতিহাসবিদরা। বলা হয়ে থাকে বাংলা ভাষা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্থান শাসকগোষ্টির সেই সিদ্ধান্তই বাঙ্গালীদের মনে স্বাধীনতার প্রথম বীজ রোপণ করেছিলো। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ধারাবাহিক অনেকগুলো ঘটনার চুরান্ত ফলাফল হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে ঢাকাই চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত ভাষা আন্দোলন, গত ৭১ বছরে ৫২’র এই আত্মত্যাগের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে মাত্র তিনটি সিনেমা।
যেকোন দেশের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মান খুবই সাধারণ একটি প্রবণতা। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্টিত। স্বাধীনতার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একধিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। চাষি নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে উপজীব্য করে সিনেমা নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বাংলদেশের চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত ভাষা আন্দোলন, এখন পর্যন্ত এই সংগ্রামী ঘটনা নিয়ে মাত্র তিনটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীব্যাপী ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ বেড়েছে। ভারতের সবগুলো ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়ে জাতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সময় নিয়ে প্রতি বছর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে থাকে এবং সেগুলো ব্যবসায়িক সাফল্যও অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু ৫২’র ভাষা আন্দোলন নিয়ে ঢাকাই সিনেমার নির্মাতাদের নীরবতা কিছুটা হলেও শঙ্কার। এখন পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত তিন সিনেমার মধ্যে একটি আবার স্বাধীনতার আগে মুক্তিপ্রাপ্ত। এরপর স্বাধীনতা পরবর্তি গত ৫২ বছরে ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত মাত্র দুটি সিনেমা।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত প্রথম সিনেমা হচ্ছে জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’। তবে এই সিনেমাটি পুরোপুরি ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নিয়ে নির্মিত ছিলো না। মূলত ১৯৭০ সালে গণআন্দোলনের পটভূমিতে ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন জহির রায়হান। সিনেমাটিতে প্রভাতফেরি, বিভিন্ন সংগঠনের পুষ্পস্তবক অর্পণের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া এতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি ব্যবহূত হয়েছিল। সিনেমাটিতে রাজনৈতিক ঘটনা ও বক্তব্য থাকার কারণে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছিলেন জহির রায়হান।
জহির রায়হানকে নানাভাবে হয়রানির পাশাপাশি সিনেমাটিকে মুক্তির অনুমতি দিতেও গড়িমসি করেছিলো পাকিস্তানের সামরিক সরকার। যার কারনে নির্দিষ্ট তারিখে সিনেমাটি মুক্তি দিতে পারেননি এই নির্মাতা। পরবর্তিতে সচেতন দর্শক ও জনসাধারণের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ মিছিলে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সামরিক সরকার সেন্সর সার্টিফিকেট দিতে বাধ্য হয়েছিল। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, রোজী সিদ্দিকী, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিলের মতো তুখোড় অভিনয়শিল্পীরা।
স্বাধীনতার পর ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিলো ২০০৬ সালে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার লেখা উপন্যাস ‘ওংকার’ অবলম্বনে শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত এই সিনেমার নাম ‘বাঙলা’। সিনেমাটির প্রধান তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাহফুজ আহমেদ, চিত্রনায়িকা শাবনূর ও হুমায়ূন ফরীদি। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি, ফখরুল ইসলাম, উপমা, আহসানুল হক মিনু, মিল্টন খন্দকারসহ অনেকে। স্বাধীনতার প্রায় ৩৫ বছর পর ‘বাঙলা’ সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিলো।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত সর্বশেষ সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার নাম ‘ফাগুন হাওয়ায়’। সিনেমাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, আবুল হায়াত, শহীদুল আলম সাচ্চু, ফজলুর রহমান বাবু ও ভারতের যশপাল শর্মাসহ অনেকে। টিটো রহমানের গল্প ‘বউ কথা কও’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি প্রযোজনা করেছেন ফরিদুর রেজা সাগর। ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ তিনটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়ছিলো এই সিনেমাটি।
তবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্বাধীনতার আগে একটি সিনেমা নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকাই সিনেমার কালজয়ী নির্মাতা জহির রায়হান। সিনেমাটির নাম ছিলো ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। সিনেমাটি নির্মানের জন্য এফডিসিতে সেটা জমা দিয়েছিলেন তিনি। সৃজনী চলচ্চিত্রের ব্যানারে এটি নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তিতে তত্কালীন সরকারের অসহযোগিতার কারণে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি সিনেমার বাইরে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে সরকারিভাবে ‘হূদয়ে একুশ’ ও ‘বায়ান্নর মিছিল’ নামে ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু সিনেমার জন্য সরকারী অনুদান পেয়েছেন নির্মাতারা। কিন্তু সরকারী অনুদান পাওয়া এই সিনেমাগুলোর কোনটারই বিষয়বস্তু ভাষা আন্দোলন নয়। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমাগুলো কিছুটা হলেও নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে সাহায্য করছে। কিন্তু সে তুলনায় চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত সিনেমার দিকে সংশ্লিষ্টদের মনযোগ একদমই নেই। এখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকারী উদ্যোগ সময়ের দাবী বলে মনে করছেন সবাই।
আরো পড়ুনঃ
নাম ভুমিকায় বুবলীকে নিয়ে শুরু হলো চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘প্রহেলিকা’
অবশেষে মুক্তি অনুমতি পেলো বহুল আলোচিত সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’
মুক্তি পেয়েছে জাফর ইকবালের গল্পে সিনেমা ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ সুন্দরবন’