বছরজুড়ে দর্শক খরা দেশীয় সিনেমার জন্য নিয়মিত চিত্র হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর শুধুমাত্র ঈদকে উপলক্ষ্য করে চালু হয় বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহ, বছরের বাকী সময় যেগুলো বন্ধই থাকে। প্রেক্ষাগৃহ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, গত ঈদে ১৬০টির কাছাকাছি প্রেক্ষগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। এরমধ্যে অনেকগুলো ঈদের পর আবার বন্ধও হয়ে গেছে। ঈদের সময় প্রেক্ষাগৃহগুলো চালু থাকায় নির্মাতা ঈদে নিজেদের সিনেমা মুক্তি দিতে প্রতিযোগিতায় নামেন। গত রোজার ঈদেও মুক্তি পেয়েছিলো আটটি সিনেমা। জানা সেই ধারাবাহিকতায় আগামী ঈদে মুক্তির মিছিলে যোগ হয়েছে হাফ ডজনের বেশি সিনেমা।
গত রোজার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সাতটি সিনেমার মধ্যে ‘লিডার’ এবং ‘জ্বীন’ ছাড়া আর কোনটিই লগ্নি ফেরত তুলতে পারেনি। এরপরও আসছে ঈদুল আযহায়, ৬/৭টি সিনেমার মুক্তির আলোচনায় শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা। এই সিনেমাগুলোর জন্য যে পরিমাণ প্রেক্ষাগৃহ দরকার সেটি এই মুহুর্তে বংলাদেশে নেই। পর্যাপ্ত প্রেক্ষাগৃহ না পাওয়ার কারনে সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও মুক্তির পর মুথ থুবড়ে পরছে সিনেমাগুলো। গত ঈদে সুপারস্টার শাকিব খান অভিনীত ‘লিডার’ সিনেমাটি পেয়েছিলো ১০০টি প্রেক্ষাগৃহ। আগামী ঈদেও শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাটি অন্যদের একই চ্যালেঞ্জ দিতে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামী ঈদুল আজহায়ও মুক্তির তালিকায় উঠে এসেছে অর্ধ ডজনের বেশি সিনেমা। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি সিনেমা ঈদে মুক্তির ব্যাপারে নিশ্চিতও করেছেন নির্মাতারা। এখন পর্যন্ত ঈদে মুক্তির মিছিলে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘অন্তর্জাল’, ‘প্রহেলিকা’, ‘লাল শাড়ি’ এবং ‘কাগজের বউ’। ঈদুল আযহায় সিনেমাগুলোর মুক্তি নিশ্চিতও করেছেন এর সংশ্লিষ্টরা। এই ছয়টি সিনেমা ছাড়াও ঈদে মুক্তির সম্ভাব্য তালিকায় আছে ‘ক্যাসিনো’, ‘এমআর নাইন’, ‘যন্ত্রণা’, ‘রিভেঞ্জ’ এবং ‘ডেঞ্জার জোন’। ঈদে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে ইতিমধ্যে ফার্স্টলুক প্রকাশ করেছেন ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’ এবং ‘অন্তর্জাল’ সিনেমাগুলোর সংশ্লিষ্টরা।
ঈদে মুক্তির আওয়াজ তোলা সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে শাকিব খান অভিনীত ‘প্রিয়তমা’। ফার্স্টলুক প্রকাশের পর ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন উল্লেখ করে সিনেমাটির পরিচালক হিমেল আশরাফ বলেন, ‘প্রিয়তমা ফার্স্টলুক প্রকাশের পর সব জায়গা থেকে যে সাড়া পেয়েছি এবং প্রতিদিন দর্শক যেভাবে আগ্রহ প্রকাশ করছেন বিশেষ করে সিনেমা মালিকরাও প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর নিচ্ছেন, আমি মনে করি না হল সংকট ফেইস করতে হবে। সংখ্যায় কত হল পাবে এটা প্রযোজকের সিদ্ধান্ত। তবে আমি চাই, যেখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা ও পরিবেশ ভালো সেখানেই প্রিয়তমা চলবে।‘
অন্যদিকে ঈদে মুক্তির মিছিলে থাকা অন্যতম আলোচিত সিনেমা হচ্ছে ‘সুড়ঙ্গ’। রায়হান রাফী পরিচালিত এই সিনেমাটির মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন জনপ্রিয় টিভি অভিনেতা আফরান নিশো। সিনেমাটির নির্মাতা রায়হান রাফীর মতে, দেশে যতগুলো প্রেক্ষাগৃহ আছে তাতে সর্বমোট দুটি ছবি মুক্তি পেলেও এই সংখ্যাটা অপর্যাপ্ত মনে হতো। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো ছবির মধ্য থেকে যে সিনেমা ভালো হবে দর্শক সেটাই গ্রহণ করবে। হল কম থাকায় কোনটা ভালো সিনেমা সেটা মাউথ পাবলিসিটিতে ছড়িয়ে পড়তে দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগবে।‘
এদিকে ঈদে মুক্তির মিছিলে অর্ধ ডজনের বেশি সিনেমার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন ‘অন্তর্জাল’ সিনেমার পরিচালক দীপংকর দীপন। একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে একাধিক ভালো সিনেমার মুক্তি পাওয়াকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তবে একজন তবে একজন পরিচালক হিসেবে কিছুটা চাপে আছেন উল্লেখ করে দীপন বলেন, ‘অল্প সংখ্যক হলের মধ্যে কতগুলো হল পাবো আর কত মানুষকে দেখাতে পারবো এটা নিয়ে টেনশন আছে। কারণ, ঈদের শুরুতেই শাকিব খানের ছবি সিঙ্গেল স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি সিনেমা হল পাবে। গতবারও তাই দেখেছি, এবারও তাই হবে। যদি ছবি ভালো হয়, ঈদের প্রথম সপ্তাহে মাউথ পাবলিসিটি হলে পরবর্তীতে হয়তো আরও বেশি হল পাবো।‘
আট বছর আগে ‘জিরো ডিগ্রী’ সিনেমায় সর্বশেষ দেখা গিয়েছিলো মাহফুজ আহমেদকে। আট বছর পর চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় ফিরছেন এই অভিনেতা। ঈদে মুক্তি এবং প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া প্রসঙ্গে চয়নিকা চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তির প্রথম সপ্তাহে বোঝা যাবে কোন ছবি ভালো। সেটাই পরবর্তীতে এগিয়ে থাকবে। শাকিব খান আমাদের সুপারস্টার, তার ছবি ভালো চলবে এটাই স্বাভাবিক। নিশোর প্রথম ছবি, তাই দর্শকদের আগ্রহ আছে। আবার মাহফুজ অনেক দিন পর সিনেমা করলো এ কারণেও মানুষ দেখবে। তাছাড়া আমার নিজের নারী দর্শকদের একটি বিরাট শ্রেণী আছে।‘
ঈদে একসাথে এতগুলো সিনেমার মুক্তিকে অস্বাভাবিক হিসেবে উল্লেখ করছেন প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্টরাও। গত ঈদুল ফিতরে একই ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে স্টার সিনেপ্লেক্সের জৈষ্ঠ্য বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘গত ঈদে আট ছবি মুক্তি পেয়েছে। এতগুলো না এলে ইন্ডাস্ট্রির জন্যই ভালো হতো। যেহেতু আমাদের সিনেপ্লেক্স তাই সবদিকে জেনেবুঝে ছবি নিতে হয়। এমনও হয়েছে অন্য ছবিগুলোর সুযোগ দিতে গিয়ে ভালো চলছে এমন ছবির শো কমাতে হয়েছে। আমরা মনে করি, এতগুলো ছবি ঈদে না এসে কয়েক সপ্তাহ পরে আসলেও ভালো হয়। যেমন হাওয়া এসেছিল।‘
ঈদে এতগুলো সিনেমার মুক্তিকে আত্মঘাতী হিসেবে অভিনীত করেছেন দীর্ঘদিন যাবত সিনেমা প্রযোজনা ও পরিবেশনায় সঙ্গে জড়িত জাহিদ হাসান অভি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঈদে এতো ছবি মুক্তি দেয়ার বিষয়টি ব্যবসার চেয়ে ইগো এবং শো অফের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদেই আসতে হবে এটা আসলে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। একজন পরিবেশক হিসেবে আমি মনে করি, যে হলগুলো আছে এতে সর্বোচ্চ তিন-চারটি ছবি মুক্তি পাওয়া উচিত। এর বেশি ছবি এলে হল কুলায় না এবং দর্শক ভাগাভাগি করে মিস করে ফেলে।‘
উল্লেখ্য যে, গত ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত আটটি সিনেমার মধ্যে বেশীরভাগই বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মুক্তির আগে সিনেমাগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের গলাবাজি এবং পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে ঝড় উঠেছিলো ঢালিউডে। সে সময় কথার লড়াইয়ে জড়িয়ে পরেন ‘কিহ হিম’ সিনেমার নির্মাতা মোঃ ইকবাল, অভিনেতা অনন্ত জলিল, বাপ্পী চৌধুরী এবং জয় চৌধুরী সহ অন্যরা। তবে সিনেমা মুক্তির পর সেগুলো শুধুই গলাবাজি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত আটটি সিনেমার মধ্যে শাকিব খানের ‘লিডার’ এবং পূজা চেরির ‘জ্বীন’ ছাড়া বাকী কোনটাই দর্শক টানতে সক্ষম হয়নি। ঈদুল আযহায় মুক্তির আওয়াজ তোলা সিনেমাগুলোর ভাগ্যে কি আছে সেটা হয়তো সময়ই বলে দিবে।
আরো পড়ুনঃ
ফার্স্টলুক প্রকাশেই শাকিবের ‘প্রিয়তমা’ প্রদর্শনে আগ্রহী ২৭টি প্রেক্ষাগৃহ
আগামী ঈদে তিন আলোচিত সিনেমায় ত্রিমুখী লড়াইয়ে ঢালিউড বক্স অফিস
প্রেক্ষাগৃহ ১০০-এর কমঃ ঈদে মুক্তির জন্য প্রস্তুত অর্ধডজনের বেশী সিনেমা