বিগত কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত নিম্নমুখী দেশীয় সিনেমার পারদ। নব্বইয়ের দশকে চরম অশ্রীলতার কারনে প্রেক্ষগৃহ বিমুখ হতে শুরু করেন বাংলা সিনেমার দর্শকরা। ডিপজলকে পূঁজি করে একের পর এক অশ্রীল সিনেমা নির্মান করতে থাকেন সে সময়ের পরিচালকরা। এরপর ধীরে ধীরে দর্শক হারাতে শুরু করে দেশীয় সিনেমা। সেই ধারাহিকতায় দেশীয় চলচ্চিত্রে দেখা গেছে তারকা এবং নির্মাতা সঙ্কট। সব মিলিয়ে প্রভাবটা পরে দেশের প্রেক্ষগৃহে। একের পর এক বন্ধ হতে থাকে দেশের প্রেক্ষাগৃহ। হাজারের বেশী থেকে এখন সংখ্যাটা ১০০-এর নীচে। তারই ধারাবাহিকতায় অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতাদের দৌরত্মে বর্তমানে কোণঠাসা আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢালিউডের হালচাল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সেখানে সিনেমা ছাড়া সবই হচ্ছে। শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে শিল্পীদের সংঘাত পৌঁছে গেছে চরম পর্যায়ে। দেশের সবচেয়ে বড় তারকা শাকিব খানকে শারীরিকভাবে আঘাত থেকে শুরু করে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মামলা-মকদ্দমায় শামিল হয়েছে শিল্পীরা। নাম ‘চলচ্চিত্র শিল্প’ হলেও সেখানে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ নেই বললেই চলে। বহু বিবাহ এবং অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য সংবাদ শিরোনামে থাকেন শিল্পীরা। সেই সাথে আছে অযাচিত বাকযুদ্ধ, মিথ্যাচার ও মামলার ফুলঝুরি।
বাকযুদ্ধ এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপের বিষয়টি এখন অনেকটাই ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পরেছে এইসব তথাকথিত শিল্পীদের মাঝে। অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতাদের দৌরত্মের অন্যতম বড় উদাহরণ হচ্ছে বস্তাপচা সিনেমা নিয়ে অযাচিত গলাবাজি। বিশ্ব সিনেমায় যখন লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, সেখানে এখনো বাংলাদেশে নির্মিত হচ্ছে ‘সৌভাগ্য’, ‘বাংলা হারকিউলিস’, ‘প্রেম পিরীতির বন্ধন’, ‘তুমি আছো তুমি নেই’ কিংবা ‘ভাইয়ারে’-এর মত সিনেমাগুলো। বাকী যা নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো বিভিন্ন দেশের সিনেমার চতুর্থ পর্যায়ের মানহীন নকল ছাড়া আর কিছুই নয়।
মাঝে মাঝে দুই একটি সিনেমা নতুন সময়ের স্বপ্ন দেখালেও, চলমান তারকা এবং নির্মাতা নামের এইসব আগাছার কারনে সে প্রচেষ্টা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সেগুলো সীমাবদ্ধ থাকছে গুটি কয়েক মানুষের মাঝে। এরমধ্যে দীপঙ্কর দীপন, সানি সানোয়ার, রায়হান রাফি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রতি বছর দেশীয় চলচ্চিত্রে যা হচ্ছে সেগুলো অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতাদের দৌরত্মে কোণঠাসা দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রতিচিত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব শিল্পী এবং নির্মাতারা নিজেদের কাজ এবং সিনেমার ব্যাপারে অপেশাদার হওয়ার কারনেই সম্ভাবনা স্বত্বেও এগুতে পারছে না ঢালিউড।
পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ ও নানা স্ট্যান্টবাজি দিয়ে আলোচনার থাকার এই চেষ্টা দেখা গেছে চলতি বছরের ঈদেও। মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মানের পরিবর্তে এইসব অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতারা ব্যস্ত বাকযুদ্ধ, মিথ্যাচার ও মামলা নিয়ে। বর্তমান সময়ে বিশ্ব সবার হাতের মুঠোয়। তাই দর্শকরা বেছে নিচ্ছেন বিদেশী সিনেমা। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের কাজের মান উন্নয়নের পরিবর্তে ঢালিউডের অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতারা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে কোলাহল নিয়ে। চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে ভালো সিনেমা নির্মান না করে, হিন্দি সিনেমা মুক্তির বিরোধিতা করে নিজেদের দেশ প্রেম আর চেতনাকে উগড়ে দিচ্ছেন সংবাদ মাধ্যমে।
গত বছরের কোরবানির ঈদে অনন্ত জলিলের ‘দ্বীনঃ দ্য ডে’ এবং রায়হান রাফি পরিচালিত ‘পরাণ’ সিনেমাগুলোর মুক্তি নিয়ে কথার যুদ্ধে লিপ্ত হন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া অনন্ত জলিল বাকযুদ্ধে জড়ান তার প্রথম সিনেমার নির্মাতা অনন্য মামুনের সাথে। সে সময় তাদের অযাচিত বাকযুদ্ধ শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অনন্য মামুনকে নিয়ে মন্তব্যে অপেশাদারিত্বের চূড়ান্ত পরিচয় দেন মৌসুমি অভিনেতা এবং প্রযোজক অনন্ত জলিল। সেই সাথে ‘দ্বীনঃ দ্য ডে’ সিনেমার বাজেট নিয়ে অনন্ত জলিলের মিথ্যাচার সবার সামনে আসে। আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলার কথাও জানান সিনেমাটির ইরানি পরিচালক।
সিনেমা নিয়ে বাকযুদ্ধ এবং মিথ্যাচারের এই ধারাবাহিকতা দেখা গেছে গত ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়ে। মুক্তির আগে প্রেক্ষাগৃহ দখলের লড়াইয়ে বুকিং এজেন্টদের সঙ্গে নানা আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা আর দেনদরবার করার পাশাপশি দেখা গেছে সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতার প্রদর্শন। আর সিনেমাগুলো মুক্তির পরে শুরু হয় তারকাদের বাকযুদ্ধ, যা নোংরামির চূড়ান্ত পর্যায় রূপ নেয়। প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সুযোগ পেতে নিজের সিনেমার সুনাম আর অন্যের সিনেমার বদনাম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া ঈদে সিনেমা মুক্তির পর ইতিমধ্যে থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রযোজক, নির্মাতা ও শিল্পীদের মতে, তাদের সিনেমাই সেরা এবং দর্শক সেটিই দেখছে। নিজদের সিনেমার প্রশংসা করতে গিয়ে অন্যদের সিনেমা নিয়ে বাজে মন্তব্যও করতেও দেখা যায় তাদের। এই বাকযুদ্ধের শুরুটা হয় চিত্রনায়ক বাপ্পি ও পরিচালক ইকবালের মধ্যে। শাকিব খান এবং অনন্ত জলিলের সিনেমা নিয়ে ভাবেন না বলে মন্তব্য করেছিলেন বাপ্পি। এরপর তার পায়ের নিচে মাটি নেই বলে মন্তব্য করেন ইকবাল। এরপর বাপ্পি নিজেকে নারায়ণগঞ্জের ছেলে বলেও হুশিয়ারি করেন এই নির্মাতাকে। পর্যায়ক্রমে এই বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পরেন জয় চৌধুরী, অনন্ত জলিল, আব্দুল আজিজ, সোলায়মান লেবুসহ অন্যান্যরা।
এদিকে বাকযুদ্ধের পাশাপাশি ঈদের সিনেমাগুলোকে ঘিরে মামলার ঘটনাও ঘটেছে ইতিমধ্যে। সম্প্রতি হত্যার হুমকি পাওয়ার অভিযোগ এনে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ‘কিল হিম’ সিনেমার পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল। অন্যদিকে ‘জ্বীন’ সিনেমা পাইরেসির কবলে অভিযোগ এনে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ্য থেকে শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঈদে একাধিক সিনেমা মুক্তির ঘটনা অতীতেও ঘটেছে ঢালিউডে। তবে বর্তমান সময়ের মত নোংরামি কখনোই দেখা যায়নি। অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতাদের কারনেই দেশীয় সিনেমার পরিবেশ এরকম হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতো আলোচনা হলেও ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর কোনটাই তেমন ব্যবসা করতে সক্ষম হয়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর মধ্যে শাকিব খান অভিনীত ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, সেটি খুব ভালো নয়। এছাড়া অন্য সিনেমাগুলোর নিয়ে প্রথম দুই/এক দিন কিছুটা আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে মুখ থুবড়ে পরেছে। সপ্তাহ যেতে না যেতেই প্রেক্ষাগৃহ থেকে নেমে গেছে সিনেমাগুলো। মুক্তির আগে কথার ফুলঝুরি দেখা গেলেও, মুক্তির পর সবাই হারিয়ে গেছেন অতলে। মৌসুমী অতিথি পাখিদের মত ঈদে সংবাদ মাধ্যমে আসা এই অপেশাদার শিল্পী এবং নির্মাতাদের হয়তো দেখা মিলবে আবার আগামী ঈদে।
উল্লেখ্য যে, চলমান এই অস্থিরতার মাঝেই আগামী ৫ই মে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে শাহরুখ খানের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘পাঠান’। দেশের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি সিনেমার মুক্তি নিয়েও পরস্পর বিরোধী অবস্থানে সংশ্লিষ্টরা। কেউ বলছেন হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেলে প্রেক্ষাগৃহ বাঁচবে। অন্যদিকে অপর পক্ষ্য মনে করছেন এটি দেশীয় সিনেমার জন্য মরার উপর খরার ঘা হিসেবে আবির্ভুত হবে। গত কোরবানির ঈদের তারকাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ধারাবাহিকতা দেখা গেলো এই ঈদেও। দেশের প্রেক্ষাগৃহ সংকটকে জয় করতে ভালো সিনেমা নির্মানের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।
আরো পড়ুনঃ
ঈদের সিনেমার বক্স অফিস হালচালঃ দেশীয় সিনেমায় নতুন আশার আলো
শাকিব খানের দাপট অব্যাহতঃ দর্শক চাহিদার শীর্ষে ঈদের সিনেমা ‘লিডার’
প্রশংসিত আদর-বুবলী জুটির ‘লোকাল’: দ্বিতীয় সপ্তাহে বাড়ছে প্রেক্ষাগৃহ সংখ্যা