টলিউড বা কলকাতা বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা লেখক-নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি। বাংলা সিনেমা নিয়ে যাদের ধারনা রয়েছে তারা জানেন যে এখানে সিনেমার দুটি ভিন্ন ধারা রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা প্রদর্শনীকে উদ্যেশ্য করে নির্মিত সিনেমা আর অন্যটি হচ্ছে বানিজ্যিক ধারার সিনেমা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই দুই ধারার সংমিশ্রণে সিনেমা নির্মানের চেষ্টা হচ্ছে টলিউডে। সিনেমার বানিজ্যিক আবেদনকে ঠিক রেখে বিষয়বস্তু নির্ভর সিনেমা নির্মানের সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন নির্মাতারা। এরমধ্যে কিছু সিনেমা যেমন সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে আবার কিছু সিনেমা বক্স অফিসে সাফল্য অর্জন করেছে। আর কলকাতা বাংলা সিনেমার নতুন দিনের যাত্রায় অগ্রগণ্য হিসেবে যে কয়জন নির্মাতার নাম আসে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃজিত মুখার্জি। সম্ভবত আধুনিক সময়ে সৃজিত মুখার্জিই একমাত্র নির্মাতা যিনি নিজের কাজ দিয়ে একই সাথে সমালোচক এবং মাস দর্শককে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন। এই নির্মাতার কাজ নিয়ে আজকের প্রতিবেদনে থাকছে সৃজিত মুখার্জির সেরা ছয় সিনেমার আলোচনা!
১। অটোগ্রাফ
সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’। মেলোড্রামা ভিত্তিক সিনেমাটির প্রধান কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, নন্দনা সেন এবং ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। অনেকেই বলে থাকেন যে সিনেমাটি মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনীত ‘নায়ক’ সিনেমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নির্মিত হয়েছে। সিনেমাটিতে অভিনয়ের জন্য প্রসেনজিৎ বেশ কয়েকটি পুরষ্কার জিতেছিলেন। সে সময়ে প্রসেনজিৎ একধরনের ইমেজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। বানিজ্যিক সিনেমা থেকে বিষয়বস্তু এবং চরিত্র নির্ভর সিনেমার দিকে বেশী মনোযোগ দিচ্ছিলেন। সৃজিত মুখার্জি ‘অটোগ্রাফ’ সিনেমাটি কলকাতা বাংলা দর্শকদের সামনে অন্য একর প্রসেনজিতকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। সেই সাথে টলিউডও পেয়ে যায় বাংলা সিনেমার নতুন দিনের রুপকার সৃজিত মুখার্জিকে। পরবর্তিতে এই অভিনেতা-নির্মাতা জুটি একসাথে উপহার দিয়েছেন আরো কয়েকটি কালজয়ী সিনেমা।
২। ২২শে শ্রাবণ
প্রথম সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’ এর বিশাল সাফল্যের পর সৃজিত মুখার্জি নির্মান করেন থ্রিলার, সহিংসতা, সঙ্গীতের পাশাপাশি বাংলা কবিতার এক অদ্ভুত ককটেল। ‘২২শে শ্রাবণ’ নামের এই সিনেমাটিরও প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি। এছাড়া আরো দুটি গুরুত্বপূর্ন চরিত্রে দেখা গেছে পরমব্রত এবং রাইমা সেনকে। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারধর্মী এই সিনেমায় একজন বরখাস্ত হওয়া পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ। একটি সিরিয়েল মার্ডার কেসের প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা (পরমব্রত) এর সাথে কাজ করেন তিনি। প্রতিটি খুনের পর খুনি প্রসিদ্ধ কিছু কবিতার পংক্তি দিয়ে খুনের ক্লু দিয়ে থাকে। একজন মদ্যপ এবং বদমেজাজি মানুষের চরিত্রে প্রসেনজিতের দুর্দান্ত অভিনয় সিনেমাটিকে দিয়েছে এক অনন্য রুপ। নির্মান শৈলী, গল্পের উপস্থাপনা, গান এবং প্রসেনজিতের অভিনয় সমৃদ্ধ সিনেমাটি মুক্তির পর ২০১১ সালের অন্যতম ব্যবসা সফল সিনেমা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলো।
৩। চতুষ্কোণ
সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চতুষ্কোণ ‘ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ২০১৪ সালে। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ প্রমুখ। রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত এই সিনেমাটির কাহিনি গড়ে উঠেছে চার পরিচালকের চার ধরনের গল্প নিয়ে। চারটি ভিন্ন গল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সিনেমাটির ক্লাইম্যাক্সে প্রতিটি গল্পকে এক সুতোয় বেঁধে অসাধারণ একটি থ্রিলার উপহার দেন এই নির্মাতা। দূর্গাপূজা উপলক্ষে ২০১৪ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়েছিলো এই সিনেমা। প্রাথমিকভাবে সিনেমাটির চার পরিচালকের চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ এবং অঞ্জন দত্তর। ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা যাবার পর তার স্থানে অভিনয় করার কথা ছিল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়র। কিন্তু সৃজিত অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় এর দৃশ্যায়ণ বাধাগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে প্রযোজকের সাথে ঝামেলা হওয়ার ফলে অঞ্জন দত্ত সিনেমাটিতে অভিনয় করবেন না বলেন। সময়ের সমস্যা হওয়ায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি থেকে সরে দাঁড়ান।
৪। জাতিস্মর
১৯ শতকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘জাতিস্মর’ হেন্সম্যান অ্যান্থনির (প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি) গল্প নিয়ে নির্মিত। সেসময়ে হেন্সম্যান অ্যান্থনি সবার কাছে ‘অ্যান্থনি ফিরিঙ্গি’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। পর্তুগিজ শহর চন্দননগরের কাছে ফরাশডাঙ্গা নামক এলাকায় তার বসবাস ছিলো। সঙ্গীতকার হওয়ার কারনে ভাষার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা থেকে বাংলা ফোক গান নিয়ে কাজ করে অ্যান্থনি। ‘কবিগান’ দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করে অ্যান্থনি। দুইটি ভিন্ন সময়ের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি, যেখানে অ্যান্থনির অতীত এবং বর্তমান দুই সময়ই দেখানো হয়েছে। হেন্সম্যান অ্যান্থনির গল্পের পাশাপাশি সিনেমাটিতে আরো একটি গল্প দেখানো হয়েছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় গল্পের দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিশু সেনগুপ্ত এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। যিশু সেনগুপ্ত পর্তুগীজ বিষয়ে একজন গবেষক চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
৫। এক যে ছিলো রাজা
বিক্রমপুর রাজ্যের উত্তরাধিকারী এবং তিনজন রাজপুত্রের মধ্যে একজন মহেন্দ্র কুমার চৌধুরীর গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘এক যে ছিলো রাজা’। পরোপকারী মহেন্দ্র কুমার চৌধুরী সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হলে তার স্ত্রী চন্দ্রাবতী দেবী চিকিৎসার জন্য তাকে দার্জিলিং নিয়ে যান। কিন্তু যাত্রা পথে কিছু রহস্যজনক ভাবে মারা যান তার অন্তিম সংস্কার দার্জিলিং করা হয়। আর বিক্রমপুর রাজ্যে তার অন্য দুই ভাইয়ের দখলে চলে যায়। এদিকে ১২ বছর পর বিক্রমপুর রাজ্যে একজন সন্যাসীর আগমন ঘটে যে কি না হুবহু দেখতে মহেন্দ্র কুমার চৌধুরীর মত। ইতিমধ্যে পুরো বিক্রমপুর রাজ্যে রটে যায় যে মহেন্দ্র কুমার চৌধুরী ফিরে এসেছেন! কে এই সন্যাসী? এক যুগ পর কি রাজপুত্র আসলেই ফিরে এসেছেন? সাসপেন্স থ্রিলারধর্মী সিনেমাটি দর্শককে চিন্তার খোরাক দিবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
৬। ভিঞ্চি দা
সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা তৈরির জন্য লড়াই করতে থাকা একজন মেকআপ আর্টিস্টের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেয়া ‘ভিঞ্চি দা’ মুক্তি পেয়েছিলো ২০১৯। সৃজিত মুখার্জির পরিচালনায় সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন রুদ্রনীল ঘোষ, হৃত্বিক চক্রবর্তী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, হৃদ্ধি সেন, গৌতম মৈত্র এবং সোহিনী সরকার। নিজের বাবা একজন প্রসিদ্ধ মেকআপ আর্টিস্ট হওয়ার পরও বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সুযোগ পায় না। নিজের প্রেমিকাকে মডেল করে তিনি স্বপ্ন দেখেন ইতালীয় রেনেসাঁ যুগের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো মোনালিসা আঁকার। এ রকম এক পরিস্থিতে আদি বোস খুঁজে বের করে ভিঞ্চিদাকে। প্রস্তাব দেয় ফিল্মের জন্য প্রস্থেটিক মেকআপ করার। ভিঞ্চিদা রাজি হয়, কিন্তু সে বুঝতে পারেনা যে একটা ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। তার নির্মিত সেই কৃত্রিম মেকআপ ব্যবহার করে একটার পর একটা ‘অপরাধমূলক কার্যক্রম’ সংঘটিত হতে থাকে।
সৃজিত মুখার্জির সেরা সিনেমা বেছে নেওয়া বেশ কঠিন কাজই বলতে হবে। উপরে উল্লেখিত ছয়টি সিনেমা ছাড়াও এই নির্মাতার অন্যান্য আলোচিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘রাজকাহিনী’, ‘গুমনামি’, ‘হেমলক সোসাইটি’ ইত্যাদি। এরমধ্যে ‘রাজকাহিনী’ সিনেমাটি সৃজিত হিন্দিতে ‘বেগমজান’ নামে পুননির্মান করেছিলেন। প্রিয় পাঠক, উপরে উল্লেখিত সিনেমাগুলোর মধ্যে আপনার পছন্দের সিনেমাটির নাম আমাদের জানিয়ে দিতে পারেন মন্তব্যে। এছাড়া এই ছয়টি সিনেমা ছাড়াও আর কোন সিনেমা সৃজিত মুখার্জির সেরা সিনেমার এই তালিকায় থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন তাও জানিয়ে দিন ঝটপট।
আরো পড়ুনঃ
সৃজিত মুখার্জির নতুন সিনেমায় যুক্ত হলেন পাওলি দাম ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য
বদলে গেলো পরিচালক: সৃজিত মুখার্জির পরিচালনায় তাপসী পান্নুর ‘সাবাশ মিতু’