সিনেমা হবে, তাতে মারামারি থাকবে না, তাও কী হয় নাকি! বিশেষ করে এই উপমহাদেশের সিনেমায় নায়ককে তো মারামারিতে দিগ্বিজয়ী হতেই হবে। শেষ দৃশ্যে নায়ককে একা কিংবা ভাই-বন্ধু-বান্ধব মিলে দুশমনদের মেরে তক্তা বানাতেই হবে। পুলিশ যদি আসেও, দুশমনরা তক্তা হলে তবেই আসবে।
সিনেমাতে এই মারামারি করার জন্য আলাদা একটা দলই থাকে। এদের কাজই হল মারামারি করা। মানে, মারামারির অভিনয় করা আরকি। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্য হলে সেখানে নায়কের হয়ে এই দলের কেউ একজন ডামি হয়ে অভিনয় করে। সিনেমায় এই মেকি মারামারির নাম স্টান্ট।।
বাংলাদেশের সিনেমার প্রথম স্টান্টগ্রুপ, মানে মারামারির দলের নাম জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতার পরপরই। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জসিম পরে হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত অ্যাকশন হিরো। তখনও বাংলাদেশে মূলত সামাজিক, ফোক আর রোম্যান্স ঘরানার সিনেমাই নির্মিত হত। এই জ্যাম্বস গ্রুপের আবির্ভাবেই সে ধারায় যুক্ত হয় অ্যাকশন ধাঁচের সিনেমা।
তখন বাংলাদেশ কেবলই স্বাধীন হয়েছে। জসিম, আরমান, হারুন, সাঈদ— এমনি কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আড্ডা দিতেন গুলিস্তান ভবনে। সাঈদের অফিসে। তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন সিনেমার সঙ্গে। তখন কাজ করছিলেন দেবর সিনেমায়। তার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। সে সিনেমার কাজ করতে কক্সবাজার গিয়ে পরিচয় হল মাহবুব গুঁইয়ের সঙ্গে। এরপর তারা হাত লাগালেন শাবানা-উজ্জ্বলের আলেয়ার আলো সিনেমাতেও।
তখনও অবশ্য সে অর্থে তারা সিনেমায় মারামারি শুরু করেননি। তারা প্রথম যে সিনেমাটিতে মারামারি করলেন, সেটির নাম উৎসর্গ। সিনেমাটিতে বেশ কয়েকটি মারামারির দৃশ্য ছিল। তবে মারামারির জন্য তাদের নামডাক হল যে সিনেমায় কাজ করে, সেটি বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসেরই অন্যতম বিখ্যাত ছবি— রংবাজ। দেবর সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে আজিমের পরিচয় হয়েছিল। এই আজিমকে জসিম বলতে গুরু। সেই আজিমের বদৌলতেই তারা রংবাজ সিনেমার কাজ পেল। আর রাজ্জাক অভিনীত সিনেমাটিতে তাদের অ্যাকশন স্টান্ট হল দেখার মতো। সব মিলিয়ে, সিনেমাটিতে কাজ করে বাংলাদেশের সিনেমা জগতে তাদের অবস্থান যাকে বলে পোক্ত হল।
‘রংবাজ’ সিনেমার ভিসিডি কাভার
এভাবেই শুরু হল বাংলাদেশের সিনেমার প্রথম মারামারির দলের, মানে স্টান্টগ্রুপের গল্প। তখন জসিম কাজ করতেন অ্যাকশন ডিরেক্টর হিসেবে, আর আরমান অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকশন ডিরেক্টর। কিছুদিনের মধ্যেই তারা দলের পাকাপোক্ত রূপ দেন। গঠন করেন জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ।
অবশ্য দলটির এই নামকরণ দলের কেউ করেননি। নামটি দিয়েছিলেন এমদাদ নামের একজন পোস্টার ডিজাইনার। তার সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছিল এখানে আকাশ নীল সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে। তার বুদ্ধি মতো, জসিমের J আরমানের A মাহবুবের M বাবুলেরB-এর সঙ্গে বহুবচনের S যোগ করে দলের নাম দেয়া হল JAMBS (জ্যাম্বস)।
দলের নামকরণের পর দলের অফিসও নেয়া হল। ওই গুলিস্তান বিল্ডিংয়েই। এবার তারা নিজেরাই একটা বিগ বাজেটের অ্যাকশন সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা আঁটতে শুরু করলেন। এমন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন। দেশের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা-অঙ্গনেও এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। জ্যাম্বসের সিনেমা বানানোর পরিকল্পনাও থমকে গেল। তখন তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন দোলন। সঙ্গে বাবুল ও চুন্নু-ও হলমালিকদের কাছ থেকে কিছু টাকা জোগাড় করলেন। আধাআধি বখরায় জ্যাম্বস গ্রুপ প্রথম সিনেমা বানানোর কাজে হাত দিল। ভারতের সোলে সিনেমার ছায়াবলম্বনে লেখা হল চিত্রনাট্য। নাম রাখা হল— দোস্ত দুশমন।
১৯৭৬ সালে সিনেমাটির কাজ শুরু হল। পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হল দেওয়ান নজরুলকে। নায়ক-নায়িকা হিসেবে অভিনয় করলেন ওয়াসিম-শাবানা। সঙ্গে সোহেল রানা-সুচরিতা। এই সিনেমাতেই প্রথমবারের মতো অভিনয় করেন জসিম। ডাকাত গাফফার খাঁ-র চরিত্রে। পোস্টারে লিখে দেয়া হল— ভারতের সোলে ছবির ছায়া অবলম্বনে। শুটিংয়ের সেটও বানানো হল বেশ খরচ করে। এফডিসির ২ নম্বর বিল্ডিংয়ের পেছন থেকে রেললাইন পর্যন্ত গ্রাম বানানো হল। সাফল্যও ধরা দিল। সিনেমা সুপার-ডুপার হিট।
‘দোস্ত দুশমন’ সিনেমার দৃশ্যে সোহেল রানা ও ওয়াসিম
এরপর জ্যাম্বস আরও বেশ কিছু সিনেমা বানায়। কাজ করে অসংখ্য ছবিতে। জ্যাম্বসের জনপ্রিয় কাজগুলোর মধ্যে আছে— ওস্তাদ সাগরেদ, জনি, আক্রোশ, বাইদা, মাস্তান, কালিয়া, বাংলার নায়ক, গরিবের ভাই, ভাইজান, জিদ্দি, কাজের বেটি রহিমা, হিরো, মাস্তান রাজা, ডাকু মনসুর, বাহাদুর, মহেশখালির বাঁকে, আলিবাবা, সিন্দাবাদ ইত্যাদি।
তখনও জসিম নায়ক হননি। তখনও পর্যন্ত তিনি কেবলই দুর্দান্ত অ্যাকশন ডিরেক্টর। বাংলাদেশের সিনেমার অ্যাকশন স্টান্টে তার অবদানও অনেক। সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যে সাউন্ড ইফেক্টের ব্যবহার তিনিই প্রথম চালু করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বন্দুকের ব্যবহার তো করতেনই। সঙ্গে অ্যাকশন দৃশ্যে তলোয়ার ব্যবহার, ঘোড়ার ব্যবহার (এমনকি পাহাড়েও), ফেন্সিং ইত্যাদি মূলত জসিমেরই সংযোজন। এসব অ্যাকশন স্টান্টে নিজেও অংশগ্রহণ করতেন তিনি। ফেন্সিংয়ে নাকি তিনিই ছিলেন সেরা। একবার নাকি তলোয়ার দিয়ে স্টান্ট করতে গিয়ে আরেকটু হলে আঙুলই হারাতে বসেছিলেন। আর একবার পাহাড়ে ঘোড়া নিয়ে স্টান্ট করতে গিয়ে সবাই-ই বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছিল। তাগড়া ঘোড়াগুলো সবাইকেই কম-বেশি ফেলে দিচ্ছিল। একমাত্র জসিমকেই ওরা ধরাশায়ী করতে পারেনি।
জ্যাম্বস গ্রুপের অন্যতম কাণ্ডারি জসিম প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ও সুভাষ দত্তের সবুজ সাথী সিনেমায়। অ্যাকশন স্টান্টের পরিচালনায় যথারীতি জ্যাম্বস গ্রুপ। তারপর খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে অ্যাকশন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
থেমে থাকেনি জ্যাম্বস গ্রুপও। একে একে তারা কাজ করে পরিস্থান, গীত, ওয়ারেন্ট, আব্দুল্লাহ, দস্যু ফুলন, ধর্ম আমার মা, বাহাদুর, রাজদুলালী ইত্যাদি সিনেমায়। গ্রুপটি যেসব সিনেমায় কাজ করেছে, সেগুলোর অধিকাংশেরই নায়ক জসিম।
জ্যাম্বস গ্রুপের অন্যতম কাণ্ডারি নায়ক জসিম
সম্ভবত জ্যাম্বস গ্রুপ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে হাতি আমার সাথী সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে। সিনেমাটির নায়ক ছিলেন জসিম। তার ডামি হিসেবে কাজ করেছিলেন চুন্নু। লামা পাহাড়ে শুটিং হওয়া সিনেমাটির বেশ কিছু দৃশ্যে রীতিমতো ভয়ংকর প্রাণীদের সঙ্গে স্টান্ট করতে হয়েছিল। একটা দৃশ্যে তো অঘটন ঘটেই গেল। দৃশ্যটা ছিল, একটা অজগর সাপ, মাথা ঘুরিয়ে জিব বের করবে। কিন্তু অজগর তো আর সহজে মাথা ঘোরায় না। অনেকক্ষণ ধরে অজগরটাকে খোঁচাখুঁচি করা হল। শেষমেশ খেপে গিয়ে অজগরটা মাথা ঘোরাল, সামনে যাকে পেল, তাকেই কামড়ে ধরল। পরে সাপের মুখে রড ঢুকিয়ে, চার-পাঁচজনে মিলে তাকে টেনে বের করা হল। তারপর সোজা হাসপাতাল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বেঁচে যায় সে। এরপর থেকে সাপের দৃশ্যের স্টান্ট করতে হলে, আগে সাপটির মুখের খানিকটা সেলাই করে দেয়া হত। এখন অবশ্য সাপের মুখে এক ধরনের প্লাস্টিকের ক্যাপ ব্যবহার করা হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় সবকিছুই শেষ হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর একাধারে মুক্তিযোদ্ধা, অ্যাকশন ডিরেক্টর এবং অ্যাকশন হিরো জসিম মারা যান। ২০০০ সালে জ্যাম্বস গ্রুপ ছেড়ে দেন মাহবুব। এদিকে বাংলাদেশের সিনেমাজগতেও অন্ধকার যুগ নেমে আসে। নির্মিত হতে থাকে নিম্নরুচির অশ্লীল সব সিনেমা। সব মিলিয়ে ভেঙে যায় বাংলাদেশের সিনেমার প্রথম অ্যাকশন স্টান্টগ্রুপ— জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ।
(লেখাটির বেশ কিছু তথ্য ইমরান উজ জামান-এর একটি প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত)