মহানায়ক মান্না: ঢাকাই সিনেমার জন্য একজন অভিনেতার চেয়ে বেশী কিছু!

মহানায়ক মান্না

মহানায়ক মান্না

সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার, ঢাকাই সিনেমার দর্শকরা যাকে মান্না নামে চেনেন। আর তার ভক্তরা ভক্তরা তাকে মহানায়ক মান্না হিসেবেই ডাকেন। মান্নার অভিনয়, সিনেমা, বক্স অফিস রাজত্ব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক লিখা হয়েছে। বাংলা সিনেমায় একজন অভিনেতা হিসেবে মান্নার সিনেমা বা সফলতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আজকের এই লিখায় একটু ভিন্ন কিছু নিয়ে কথা বলবো। আপনি যদি মান্নাকে নিয়ে পড়াশোনা করেন তাহলে দেখবেন আমাদের ঢাকাই সিনেমার জন্য তিনি শুধুমাত্র একজন অভিনেতার চেয়ে বেশী কিছু ছিলেন। নির্মাতা থেকে শুরু করে তার সহকর্মী সবার কাছেই মান্না নামটার গুরুত্ব এক অন্যরকম অনুভূতির নাম। চিত্রানায়ক মান্নার এরকম কিছু বিষয় নিয়েই আলোচনার চেষ্টা থাকবে এই লিখায়।

১। গডফাদার বিহীন সুপারস্টার
মহানায়ক মান্না ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) আয়োজিত নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে নির্বাচিত হন। আর ১৯৮৫ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘পাগলী’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তার ঢালিউডে অভিষিক্ত হয়েছিলেন এই তারকা। তবে তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ছিলো ‘তওবা’। ১৯৮৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ (২০০৮) পর্যন্ত মান্না চব্বিশ বছরের কর্মজীবনে তিন শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এই সিনেমাগুলোর দর্শকদের বিনোদিত করার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত হাসি ফুটিয়েছে নির্মাতাদের মুখে। ঢালিউডে যে কয়েকজন তারকা আছেন যারা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে, কোন ধরনের গডফাদার ছাড়া সিনেমায় নিজের অবস্থান শক্ত করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মান্না। অ্যাকশন, রাজনৈতিক, সামাজিক, রোম্যান্টিক থেকে শুরু করে ফ্যান্টাসি সব ধরনের সিনেমায়ই তিনি ছিলেন অনন্য এবং ভরসার নাম।

২। ভাবনায় সিনেমা
মান্না তার কর্মজীবনে নিজের সিনেমার নিয়ে যতটুকু ভাবতেন তার চেয়ে বেশী ভাবতেন বাংলা সিনেমার সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে। সালমান শাহের মৃত্যুর পর পুরো ইন্ডাস্ট্রি যখন তার কাঁধে এসে পরে তখন তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন বাংলা সিনেমার উন্নয়নের জন্য। তারকাবহুল সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন নিরন্তর। তার সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তার চেয়ে জুনিয়র অভিনেতা অভিনেত্রীরা পেয়েছেন একটি বিশাল দর্শক সমাজের কাজে পরিচিত। এই অভিনেতা অভিনেত্রীরাই পরবর্তিতে বাংলা সিনেমায় কাজ করেছেন দাপটের সাথে। এছাড়া নিজে প্রযোজনা করেছেন বিশাল বাজেটের একের পর এক সিনেমা। তার প্রযোজিত ‘লুটতারাজ’, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, ‘দুই বধু এক স্বামী’, ‘আমি জেল থেকে বলছি’, ‘পিতা মাতার আমানত’ এর মত সিনেমাগুলো বক্স অফিসকে চাঙ্গা রেখেছে অনেক দিন। তার প্রযোজিত সিনেমাগুলোর সব কয়টিই ছিলো তারকাবহুল এবং বড় বাজেটের।

৩। একজন নেতা মান্না
আজকের শিল্পী সমিতি নিয়ে যে নোংরামি হচ্ছে সেটা এই সমিতির ইতিহাসের সাথে কোনভাবেই মাননসই নয়। একটি পদকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য কতটা নীচে নামা যায় তারই প্রদর্শনী চলছে ঢালিউডে। ব্যক্তিগত স্বার্থ চিরতার্থ করার জন্য যেকোন কিছু করার মত অবস্থা দেখতে পাচ্ছি আমরা। অথচ, এই সিমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মহানায়ক মান্না দায়িত্ব পালনের সময় তিনি নিজের জন্য নয় কাজ করে গেছেন সিনেমার জন্য, সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের জন্য। তার নেতৃত্বের অন্যতম বড় উদাহরণ হচ্ছে গত শতকের শেষের দিকে যখন ঢালিউডে অশ্লীলতা জেকে বসেছিলো। সে সময়ে বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতার কারনে সরে গিয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু মান্না সেটা করেননি। অশ্লীলতার বিরুদ্ধে জনমত এবং আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়েননি এই মহানায়ক। দুঃসময়ে সিনেমাকে আগলে রেখেছিলেন তিনি।

৪। বাংলা সিনেমা নিয়ে দুরদর্শিতা
ক্যাবল টিভির সম্প্রসারণের কারনে আমাদের সিনেমা যে চরম প্রতিযোগিতার মধ্যে পরবে এবং তার বিপরীতে টিকে থাকার জন্য আমাদের মান উন্নয়ন করতে হবে সেটা মান্না বলে গিয়েছিলেন আজ থেকে এক দশকেরও আগে। তার ছেলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, বোম্বের সিনেমা দেখে দেখে আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম আমাদের সিনেমার ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে যাবে। তারা তখন বোম্বের সিনেমার সাথে আমাদের সিনেমার তুলনা করবে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের নেক্সট জেনারেশন যারা আসবে তারা আমাদের ব্যাপারে খুব শেকি হয়ে যাবে… আমাদের ফিল্মের ব্যাপারে। কারন আমরা যখন ছোট ছিলাম আমরা এতকিছু দেখিনি। তারা কিন্তু তুলনা করবে।‘ মান্নার মৃত্যুর এত বছর পর ঢালিউড তার কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

৫। স্পষ্টবাদী
ঢাকাই সিনেমায় মহানায়ক মান্না স্পষ্টবাদী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজের মনের কথাটা কোন ধরনের রাখঢাক না রেখেই বলতেন এই তারকা। একটি টিভি অনুষ্ঠানে সিনেমার জগত নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন সেটা তারই প্রমাণ বহন করে। সিনেমা জগত নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে চলচ্চিত্র জগতের মত স্বার্থপর কোন জগত আর নেই। এখানে সবাই বাণিজ্যিক। হৃদয়, প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, চাওয়া-পাওয়া সবই নাটক। সিনেমার কেউ যদি বুকে হাত দিয়ে বলে আমরা সবাই এক পরিবার; না মিথ্যা কথা। এখানে সবাই আলাদা।‘

আজ ১৪ বছর হলো মহানায়ক মান্না আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তার কর্মে, সিনেমার জন্য তার উৎসর্গে। আজ বাংলা সিনেমা তার জৌলুস হারিয়ে টিকে আছে না থাকার মত। সিনেমার নিম্নমান, তারকাদের মধ্যকার সৌহার্দের অভাব, অন্তর্কোন্দল – সব মিলিয়ে ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সিনেমা। একজন অভিনেতা নয়, আজ ঢাকাই সিনেমা অনুভব করছে একজন নেতা মান্নাকে। সিনেমাকে উন্নত শুধুমাত্র সিনেমার মানুষই করতে পারবে। তার জন্য দরকার একজন আত্নত্যাগী নেতার, যার অভাবে ধংশের দ্বারপ্রান্ত ঢাকাই সিনেমা। ঢালিউডের বর্তমান পরিস্থিতি ভীষণভাবে প্রমাণ করে ঢাকাই সিনেমার জন্য মহানায়ক মান্না একজন অভিনেতার চেয়ে বেশী কিছু ছিলেন!

আরো পড়ুনঃ
মহানায়ক মান্না: নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এক ‘তেজি পুরুষ’
স্মৃতিতে অম্লান মহানায়ক মান্না: কতটুকু মনে আছে মান্নার সিনেমার যাত্রা
মৃত্যুর একযুগ পর নাম বদলে অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে মান্নার শেষ সিনেমা

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d