মিমি রিভিউ: কৃতি শেননের অভিনয় সমৃদ্ধ একটি অনন্য মাস্টারস্ট্রোক

মিমি রিভিউ

চলচ্চিত্রের নামঃ মিমি (২০২১)
মুক্তিঃ জুলাই ২৬, ২০২১
অভিনয়েঃ কৃতি শেনন, পঙ্কজ ত্রিপাটি, সাই থামানকার, সুপ্রিয়া পাঠাক, মনোজ পাওয়া, আকাশ সোনালী, ইভেনলি এডওয়ার্ড, আইডেন হুইটক প্রমুখ।
পরিচালনাঃ লক্ষন উটেখার
প্রযোজনাঃ ম্যাডডক ফিল্মস এবং জিও স্টুডিও
পরিবেশনাঃ নেটফ্লিক্স এবং জিও সিনেমা
কাহিনীঃ লক্ষন উটেখার এবং রোহান শঙ্কর
চিত্রনাট্যঃ লক্ষন উটেখার এবং রোহান শঙ্কর
সম্পাদনাঃ মানিশ প্রধান
চিত্রগ্রহনঃ আকাশ আগারওয়াল
সংগীতঃ এ আর রহমান

প্রারম্ভিক কথাঃ প্রায় বিশ বছর আগে নির্মাতা আব্বাস মাস্তান ‘চোরি চোরি চুপকে চুপকে’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডের মূলধারার সিনেমা সারোগেসি ব্যাপারটিকে উপস্থাপন করেছিলেন। এরপর সারোগেসি নিয়ে বলিউডে আরো কয়েকটি সিনেমা নির্মান হতে দেখা গেছে, কিন্তু এরমধ্যে কোনটাই দর্শকের কাছে তেমন স্মরণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। সম্প্রতি নির্মাতা লক্ষন উটেখার নির্মান করেছেন একই বিষয় নিয়ে নতুন একটি সিনেমা যার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৃতি শেনন। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মারাঠি সিনেমা ‘মালা আই ভায়েচ্ছি’ সিনেমার উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘মিমি’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্লাটফর্ম নেটফ্লিক্সে। তাহলে কেমন হলো সারোগেসি নির্মির নতুন এই সিনেমাটি? সারোগট মা হিসেবে পর্দায় কেমন ছিলেন কৃতি শেনন? ‘মিমি’ কি পারবে দর্শকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকতে না আগের সিনেমাগুলোর মতই হারিয়ে যাবে অতলে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা কর হবে ‘মিমি’ সিনেমার বিস্তারিত রিভিউতে।

কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘মিমি’ সিনেমার গল্প শুরু হয় আমেরিকান দম্পতি সামার (ইভেনলি এডওয়ার্ড) এবং জন (আইডেন হুইটক) এর একজন সারোগেট মায়ের খোঁজ দিয়ে। তাদের সন্তানের জন্য তারা ভারতের একজন তরুণীকে চাচ্ছেন যে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে শক্তিশালী হবে। সারোগেসি নিয়ে কাজ করা একটি হাসপাতালে কাউকে পছন্দ না হওয়ার কারনে এই দম্পতি অন্য জায়গায় একজন সারোগেট মায়ের খোঁজ করতে থাকে। সেখানে এ বিষয়ে তাদের আলাপ হয় একজন ট্যাক্সিচালক ভানুপ্রতাপ পাণ্ডে (পঙ্কজ ত্রিপাটি) এর সাথে। ভানু প্রতাপ ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সেই আমেরিকান দম্পতিকে সাহায্যের অঙ্গীকার করে।

এদিকে ছোট শহর রাজস্থান বসবাসকারী এক স্বপ্নবাজ তরুণী মিমি মানসিং রাঠোর (কৃতি শেনন) বলিউডে নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। একটি ড্যান্স ক্লাবে মিমিকে দেখে তাকে নিজেদের সারোগেট সন্তানের সম্ভাব্য মা হিসেবে পছন্দ করে। ভানুপ্রতাপ তাদের চাহিদা অনুযায়ী সারোগেট মা হওয়ার জন্য মিমিকে প্রস্তাব দেয়। প্রাথমিকভাবে মিমি সেই প্রস্তাবে রাজী হয়না এবং বলিউডের নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সারোগেট মা হওয়ার বদলে আমেরিকান দম্পতি মিমিকে ২০ লক্ষ্য টাকা দেয়ার কথা বলে। বলিউডে নিজের অবস্থান তৈরির জন্য টাকার প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে মিমি তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়। কিন্তু মিমি বুঝতে পারে যে, গর্ভাবস্থায় তার শারীরিক পরিবর্তন তাকে পরিবার থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। এরপর সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগের কথা বলে মিমি মুম্বাইয়ে চলে আসে এবং নিজের গর্ভে আমেরিকান দম্পতির সন্তান ধারন করে।

কিন্তু কিছুদিন পর টেস্টে সামার এবং জন জানতে পারে যে মিমির গর্ভে বেড়ে উঠা তাদের সন্তান ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্ম নিবে। এরকারনে এই সন্তানকে জন্ম না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সামার এবং জন। তারা ভানুকে বলে মিমি যেন সেই সন্তানকে জন্ম না দিয়ে গর্ভপাত করে ফেলে। এরপর মিমির সাথে দেখা না করেই সামার এবং জন আমেরিকা ফিরে যায়। ভানুপ্রতাপ বিষয়টি মিমিকে জানালে সিনেমাটি অন্য এক মোড় নেয়। মিমি কি সামার এবং জনের কথামত গর্ভপাত করে সন্তানকে নষ্ট করে দিবে নাকি আবেগের বশবর্তী হয়ে অন্যের সন্তান নিজ দায়িত্বে জন্ম দিবে? এরকম পরিস্থিতে মিমি কি ফিরে যাবে তার পরিবারের কাছে নাকি নিজেই নামবে জীবন যুদ্ধে? জন্মের পর এই সন্তানকে কার পরিচয়ে বড় করবে মিমি? এরকম একটি দন্ধময় সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় সিনেমার গল্প।

গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ আগেই বলেছি সারোগেসি নিয়ে সিনেমা বলিউডে নতুন কিছু নয়। এর আগেই সারোগেসি নিয়ে বলিউডে সিনেমা নির্মিত হয়েছে কিন্তু প্রেক্ষাপট এবং গল্পের ধরনের দিক থেকে সারোগেসি নিয়ে নির্মিত অন্য সিনেমাগুলো থেকে ‘মিমি’ সিনেমাটি আলাদা। মারাঠি সিনেমার উপর ভিত্তি করে লক্ষন উটেখার এবং রোহান শঙ্কর সময়পযোগী একটি গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন। সারোগেসিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হলেও সিনেমাটিতে প্রাধান্য পেয়েছে এক সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা, অনাগত সন্তানের কারনে নিজের স্বপ্ন বিসর্জনের যন্ত্রনা। সেই সাথে গল্পে উঠে এসেছে পারিবারিক মূল্যবোধের গল্প। পারিবারিক বিনোদনের সিনেমার সম্ভাব্য সব উপাদানই ছিলো ‘মিমি’ সিনেমার গল্পে।

গল্পের পাশাপাশি ‘মিমি’ সিনেমার চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন লক্ষন উটেখার এবং রোহান শঙ্কর। আর সন্দেহাতীতভাবে গল্পের মত সিনেমাটির চিত্রনাট্যে রচনায়ও দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তারা। একটি ভালো গল্পের সিনেমা অনেক সময় খারাপ চিত্রনাট্যের কারনে যেমন মুখ থুবড়ে পরে তেমনি একটি গড়পড়তা গল্পকে টেনে নিয়ে যেতে সুলিখিত একটি চিত্রনাট্য। সারোগেসি মায়ের খোঁজের এই গল্পকে একটি উপভোগ্য সিনেমা হিসেবে পর্দায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি সুলিখিত চিত্রনাট্যরে চেষ্টায় শতভাগ সফল ছিলেন এই দুই লেখক। পুরো সিনেমাতে দর্শককে ধরে রাখার জন্য টানটান উত্তেজনার পাশাপাশি সময়োপযোগী কৌতুক এবং আবেগের সংমিশ্রণ।

পরিচালনাঃ লক্ষন উটেখার এর আগে কৃতি শেননকে নিয়ে ‘লুকা চুপি’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন। ভালো গল্প এবং সুলিখিত চিত্রনাট্যরে পাশাপাশি লক্ষন উটেখারের পরিচালনা সিনেমাটিকে দিয়েছে নতুন রুপ। সংবেদনশীল একটি গল্পের সাথে এই নির্মাতা চাতুর্যের সাথে মিশিয়েছেন অমলিন রসিকতা। সিনেমাটি নিয়ে এই নির্মাতারা ভিশনের সাথে পরিচালনার একটি সুন্দর সংযোগ স্থাপনে সফলতার সাথে উৎরে গেছেন তিনি। সেই সাথে জীবনের অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে আপানাকে উচ্চস্বরে হাসাতে সম্ভাব্য সব করেছেন লক্ষন এবং অবধারিতভাবে সেখানেও সফল ছিলেন সম্ভাবনাময়ী এই পরিচালক।

অভিনয়ঃ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৃতি শেনন এবং পঙ্কজ ত্রিপাটি। নাম ভূমিকায় একজন সারোগেট মায়ের চরিত্রে কৃতির অভিনয় অনেক দিন মনে রাখবে সিনেমাটির দর্শক। যতবারই পর্দায় এসেছেন নিজের সৌন্দর্য এবং অভিনয় গুন দিয়ে বিমোহিত করেছেন সবাইকে। কৃতি শেনন জনপ্রিয় তারকা এবং আগেই কয়েকটি সিনেমায় নিজের অভিনয় প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন এই অভিনেত্রী। তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রে এই প্রথম তাকে দেখা গেছে পর্দায় এবং সেটা একটি নারী কেন্দ্রিক সিনেমায়। কৃতির প্রতি নির্মাতাদের এই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন শতভাগ। মিমি চরিত্রটির কয়েকটি ধাপ রয়েছে এবং প্রতিটি ধাপ একটি থেকে অন্যটি আলাদা। এই আলাদা আলাদা ভাগে নিজের চরিত্রকে পর্দায় সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কৃতি শেনন।

কৃতির পাশাপাশি আরো একজনের অভিনয়ের কথা আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, তিনি হচ্ছেন পঙ্কজ ত্রিপাটি। ভানুপ্রতাপ নামের একজন ট্যাক্সিচালকের চরিত্রে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন এই অভিনেতা। সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যেকে আনন্দময় করে তুলতে নিজের স্বভাবসুলভ অভিনয় দিয়ে যে হাস্যরসের যোগান দিয়েছেণ তিনি তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। কৃতি এবং পঙ্কজ ছাড়া সিনেমাটির অন্যান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা নিজেদের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনা গল্প এবং চিত্রনাট্যের সাথে যথোপযুক্ত ভাবে মাননসই। আকাশ আগারওয়ালের চিত্রগ্রহণ সিনেমাটিকে দিয়েছে এক আলাদা আবেদন। রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গাকে সিনেমার দৃশ্যপটের সাথে সুনিপুনভাবে ভাবে ফুতয়ে তুলেছেন আকাশ। গল্পের ধারাবাহিকতা এবং দৃশ্যকে দর্শকের কাছে উপভোগ্য করার ক্ষেত্রে আকাশ আগারওয়ালের চিত্রগ্রহণ প্রশংসার দাবীদার। এছাড়া সিনেমাটির সম্পাদনায় মানিশ প্রধান ভালো কাজ করেছেন। সিনেমাটিকে দর্শকদের কাছে উপভোগ্য করতে মানিশ প্রধানের সম্পাদনা সাহায্য করেছে বেশ অভিনব কায়দায়।

উপসংহারঃ ‘মিমি’ একটি পরিপূর্ন পারিবারিক বিনোদনের সিনেমা। সুন্দর গল্প, সুলিখিত চিত্রনাট্য এবং সুনিপুণ পরিচালনা – সব মিলিয়ে সিনেমাটি একটি নির্মল বিনোদনের সমার্থক। পঙ্কজ ত্রিপাটি সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডে ভিন্ন ধারার অভিনেতা হিসেব নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছেন কিন্তু ‘মিমি’ সিনেমার মাধ্যমে কৃতি ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। আপনি যদি কৃতি শেননের ভক্ত হয়ে থাকেন আপনার জন্য সিনেমাটি অবশ্যই দর্শনীয় আর আপনি যদি কৃতির ভক্ত না হয়ে থাকেন তাহলে ‘মিমি’ দেখে নতুন করে ভেবে দেখুন কেন আপনি তার ভক্ত না। সর্বপরি, বিনোদনের জন্য সিনেমাটি একটি সম্পূর্নতার উদাহরণ।

আরো পড়ুনঃ
ব্ল্যাক উইডো রিভিউ
কোল্ড কেস রিভিউ
ট্যাংরা ব্লুজ রিভিউ

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d