রাধে রিভিউ: সালমান খানের আরো একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু

রাধে রিভিউ

চলচ্চিত্রের নামঃ রাধেঃ ইউর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই (২০২১)
মুক্তিঃ মে ১৩, ২০২১
অভিনয়েঃ সালমান খান, দিশা পাটনি, রনদীপ হোদা এবং জ্যাকি শ্রফ প্রমুখ।
পরিচালনাঃ প্রভু দেবা
প্রযোজনাঃ সালমান খান, সোহেল খান এবং রিল লাইফ প্রাইভেট লিমিটেড
পরিবেশনাঃ জি স্টুডিওস (প্রেক্ষাগৃহ এবং ওটিটি)
কাহিনীঃ কোরিয়ান ‘দ্যা আউটলো’ সিনেমার অনুকরণে
চিত্রনাট্যঃ এসি মুগিল এবং বিজয় মৌর্য
সংলাপঃ বিজয় মৌর্য
সম্পাদনাঃ রিতেশ সোনি
চিত্রগ্রহনঃ আয়ানাঙ্কা বোস
সংগীতঃ সাজিদ ওয়াজিদ, দেবি শ্রী প্রসাদ এবং হিমেশ

প্রারম্ভিক কথাঃ সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর বক্স অফিস এবং সমালোচকদের ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছিল নিজের সেরা সময়কে পিছনে ফেলে এসেছেন বলিউডের ভাইজান সালমান খান। কিন্তু ‘দাবাং ৩’ এরপর সালমান খানের মুক্তি প্রতীক্ষিত ‘রাধেঃ ইয়র মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই’ সিনেমাটি নিয়ে বলিউড সংশ্লিষ্টদের মাঝে কাজ করছিলো উত্তেজনা। গত বছরের ঈদে মুক্তির কথা থাকলেও করোনা মহামারীর কারনে পিছিয়ে যায় সিনেমাটির মুক্তি। এক বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে ২০২১ সালের ঈদে মুক্তি পায় সিনেমাটি। প্রাথমিকভাবে একই সাথে প্রেক্ষাগৃহ এবং ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তির কথা থাকলেও করোনার দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাবের কারনে অনেকটা সরাসরি ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটি। তাহলে কেমন হলো ভাইজানের নতুন সিনেমা? দর্শকদের প্রত্যাশা কতোটা পূরণ করতে পারলো এই সিনেমা। ‘দাবাং ৩’ ব্যার্থ হলেও নির্মাতা প্রভু দেবা কি পেরেছেন তার ‘ওয়ান্টেড’ ঝলক ফিরিয়ে আনতে ‘রাধে’ দিয়ে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা থাকবে এই রিভিউতে।

কাহিনী সংক্ষেপঃ দিল্লী থেকে মুম্বাইয়ে আসা একজন ড্রাগ ডিলার রানা (রনদীপ হুদা) এবং একজন এনকাউন্টার স্পেশালিষ্ট রাধে (সালমান খান) এর কাহিনী নিয়ে আবর্তিত এই সিনেমার কাহিনী। রানার মূল টার্গেট মুম্বাইয়ের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং ক্লাবের তরুন তরুণী যাদের কাছে নেশা জাতীয় দ্রব্য বিক্রি করে টাকা আয় করা। এই লক্ষ্যে রানা মুম্বাইয়ের দুই স্থানীয় গ্যাংস্টারকে হত্যা করে। শুধু তাই নয় ড্রাগ ডিলারের এই মামলাটি নিয়ে কাজ করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত দুই পুলিশ অফিসারকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। মুম্বাইয়ে ক্রমবর্ধমান এই ড্রাগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়োগ দেয়া হয় রাধেকে।

এরপর থেকে সিনেমার গল্প পুরোটাই রাধে এবং রানার মধ্যকার লড়াইয়ের। নিজের ব্যবসাকে আরো শক্তিশালী করতে রানা একে একে হত্যা করতে থাকে তার পথে বাধাদানকারী সবাইকে। অন্যদিকে রাধে ছক আঁকতে থাকে রানাকে থামানোর। এরমধ্যে পুলিশের পক্ষ্য থেকে ড্রাগের মামলাটি থেকে রাধেকে সরিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন একজন অফিসারকে। তাহলে রাধে কি হেরে যাবে এই সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে? রাধে কি পারবেন তার ওয়াদা রক্ষা করতে? রানাকে থামাকে কি ছক আঁকে রাধে? এইসব প্রশ্নের উত্তরে এগিয়ে যায় সিনেমাটির গল্প।

গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ কোরিয়ান আলোচিত সিনেমা ‘দ্যা আউটলো’ এর অনুকরণে নির্মিত হয়েছে ‘রাধে’ সিনেমাটি। শক্তিশালী বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে পরিপূর্ন একটি গল্পের সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সময়ের সাথে গল্পের শক্তিশালী গাঁথুনি নির্মান এবং চরিত্রগুলোকে পূর্নতা দিতে ব্যার্থ এই সিনেমা। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে সহকারী চরিত্র সবগুলোতে এক ধরনের সম্পূর্নতা দেখা গেছে। রাধে এবং রানা – এই দুই চরিত্রকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে গিয়ে সম্ভাবনাময় অন্য চরিত্রগুলো আড়ালে থেকে গেছে যা সিনেমার গল্পকে পূর্নতা দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী চিত্রনাট্য দূর্বল গল্পকেও পর্দায় অন্যমাত্রা দিয়ে থাকে। কিন্তু ‘রাধে’ সিনেমার ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়নি। সিনেমার দূর্বল চিত্রনাট্য গল্পের দূর্বলতাকে আরো বড় করে তুলেছে। একদম অনুমানযোগ্য একটি গল্পকে এই চিত্রনাট্য করেছে আরো বেশী অনুমেয়। সমস্যা, সমস্যা সৃষ্টিকারী এবং সমাধানদাতা – তিনটি সোজা এবং সাধারণ ভাগে রচনা করা হয়েছে এই সিনেমার চিত্রনাট্য। এছাড়া সিনেমায় দিয়া (দিশা পাটনি) চরিত্রটি মনে হয়েছে অনেকটা জোরপূর্বক আনা হয়েছে। মুল গল্পের প্রেক্ষাপটের সাথে দিয়া চরিত্রের যৌক্তিক কোন সংযোগ তৈরি করতে পারেননি এসি মুগিল এবং বিজয় মৌর্য। পাশাপাশি সিনেমাতে জ্যাকি শ্রফের চরিত্রটি তার মত একজন অভিনেতার জন্য অপমানজনক।

সংলাপের দিক থেকেও গল্প এবং চিত্রনাট্যের পথে হেঁটেছে ‘রাধে’। ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সালমান খান অভিনীত ‘ওয়ান্টেড’ সিনেমার একটি সংলাপ ঘুরে ফিরে বলতে দেখা গেছে সালমান খানকে। কিন্তু ‘রাধে’ সিনেমায় শক্তিশালী কোন সংলাপ পাওয়া যায়নি।

পরিচালনাঃ মাসাল বা ম্যাস দর্শকদের উপযোগী সিনেমা নির্মানে নির্মাতা প্রভু দেবার আলাদা একটা অবস্থান রয়েছে। ‘ওয়ান্টেড’ এবং ‘রাউডি রাথর’ সিনেমাগুলোর ব্যাবসায়িক সফলতা সেই ইঙ্গিতই দেয়। কিন্তু ‘রাধে’ সিনেমায় প্রভু দেবা তার সেই ম্যাজিক দেখাতে পুরোপুরি ব্যার্থ। সালমান খানকে নিয়ে ২০০৯ সালের সুপারহিট ‘ওয়ান্টেড’ সিনেমায় প্রভু দেবা যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন তা এই সিনেমায় দেখা যায়নি। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাবাং ৩’ সিনেমার মত ‘রাধে’ সিনেমাটিও অসংলগ্ন নির্মানের দুষে দুষ্ট ছিলো। সিনেমার মূল চরিত্র ‘ওয়ান্টেড’ সিনেমার আদলে তৈরি করা হলেও ওই সিনেমায় পরিচালক হিসেবে যে সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন তার প্রতি যতাযত সম্মান প্রদর্শন করতে পারেননি প্রভু দেবা।

অভিনয়ঃ সংযত কারনেই সিনেমার প্রধান আকর্ষন হিসেবে আছেন সালমান খান। কিন্তু অভিনয়ের দিক থেকে সালমান খান তার নিজের ‘সুপারস্টার’ বৃত্ত থেকে বের হতে আরো একবার ব্যার্থ হয়েছেন। একজন সুপারস্টারের ইমেজ থেকে বের হয়ে একজন অভিনেতা হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেছেন তিনি। তার পর্দা উপস্থিতি যতেষ্ট প্রাণবন্ত হলেও তা দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য যতেষ্ট ছিলো না।

অন্যদিকে ‘রাধে’ সিনেমার অন্যতম প্রধান অর্জন রানা চরিত্রে রনদীপ হুদা। একজন দুর্ধর্ষ এবং পাশবিক ড্রাগ ডিলার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন রনদীপ হুদা। তার পর্দা উপস্থিতি এবং সংলাপ বলার ধরন দৃশ্যগুলোকে ক্ষেত্র বিশেষে অন্য মাত্রা দিয়েছে। সম্ভবত খলচরিত্রে রনদীপ হুদা সিনেমার মূল চরিত্রকেও ছাপিয়ে গেছেন।

দিশা পাটনির উপস্থিতি গল্পে যেমন অবাঞ্ছিত, তেমনি তার পর্দা উপস্থিতিও ছিলো বিরক্তিকর। সালমান খানের সাথে বেমানান লাগার পাশপাশি তার অভিব্যাক্তি এবং সংলাপ বলার ধরন পুরো সিনেমাতে তাকে করেছে অবাঞ্ছিত। জ্যাকি শ্রফের চরিত্রটিও দিশা পাটনির মত অবাঞ্ছিত মনে হয়েছে। তার মত একজন অভিনেতা সিনেমাতে যতটুকু প্রভাব বিস্তারের প্রত্যাশা ছিলো সেটা পুরোপুরি অনুপস্থিত মনে হয়েছে। এই কয়েকটি চরিত্রের বাইরে সিনেমার অন্য চরিত্রগুলো তেমন উল্লেখ করার মত ছিলো না। ছোট ছোট কিছু চরিত্রে অভিনেতারা নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক অভিনয় করেছেন।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ আয়ানাঙ্কা বসের চিত্রগ্রহণ মুটোমুটি ভালো ছিলো। তবে কিছু দৃশ্যে তিনি তার মেধার ব্যবহার করতে সক্ষম ছিলেন বলা যাবে না। অন্যদিকে রিতেশ সোনির সম্পাদনা কিছুটা হলেও দর্শকদের সাহায্য করবে। কারন রিতেশ সিনেমাটির দৈর্ঘ দুই ঘন্টার কাছাকাছি রাখতে পেরেছেন। তার সম্পাদনা ভালো ছিলো বলা যাবে না তবে সিনেমার দৈর্ঘ কম রেখে তিনি দর্শককে তাড়াতাড়ি অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেছেন।

উপসংহারঃ আপনি যদি সালমান খানের অন্ধ ভক্ত হয়ে থাকেন অথবা কোন প্রত্যাশা এবং অনুতাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন তাহলে দেখুন এই সিনেমা। এছাড়া যদি একশন এবং বিনোদনের আশায় সিনেমাটি দেখতে চান তাহলে আরো একবার ভাবুন। একজন বলিউড সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আমি আশা করি এটাই সালমান খানের শেষ খারাপ সিনেমা হোক। ‘রেস ৩’, ‘ভারত’ এবং ‘দাবাং ৩’ এরপর খারাপ সিনেমার তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলো ‘রাধেঃ ইউর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই’।

আরো পড়ুনঃ
মুম্বাই সাগা রিভিউ: সঞ্জয় গুপ্তের নিজস্ব ধারার আরো একটি গ্যাংষ্টার-পুলিশ লড়াইয়ের উপাখ্যান
লাক্সমি রিভিউঃ অক্ষয়ের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে দুর্বল সিনেমা

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d