শমশেরা রিভিউ: দুর্বল গল্প আর চিত্রনাট্যে বড় প্রচেষ্টার বড় হতাশা

চলচ্চিত্রের নামঃ শমশেরা (২০২২)
মুক্তিঃ জুলাই ২২, ২০২১
অভিনয়েঃ রনবীর কাপুর, সঞ্জয় দত্ত, ভানি কাপুর, সৌরভ শুক্লা, রোনিত রয়, ত্রিধা চৌধুরী, পিতোবাস ত্রিপাঠী প্রমুখ।
পরিচালনাঃ করণ মালহোত্রা
প্রযোজনাঃ আদিত্য চোপড়া
পরিবেশনাঃ যশ রাজ ফিল্মস
কাহিনীঃ নীলেশ মিশ্র এবং খিলা বিষ্ট
চিত্রনাট্যঃ একতা পাঠক মালহোত্রা ও করণ মালহোত্রা
সংলাপঃ পীযূষ মিশ্র
সম্পাদনাঃ শিবকুমার ভি পানিকার
চিত্রগ্রহনঃ অয়ন গোস্বামী

প্রারম্ভিক কথাঃ রাজকুমার হিরানি পরিচালিত ‘সাঞ্জু’ সিনেমার মুক্তির চার বছর পর ‘শমশেরা’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় ফিরেছেন রনবীর কাপুর। করণ মালহোত্রা পরিচালিত এই সিনেমাটি যশ রাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত বিগ বাজেটের সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া সিনেমাটিতে সঞ্জয় দত্ত খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। করোনা মহামারীর কারনে বেশ কয়েকবার পিছিয়ে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত এই সিনেমাটি। করোনার কারনে বলিউড সহ ভারতীয় সিনেমা দর্শকদের মাঝে দেখা গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। চলতি বছরে বলিউডের বেশ কয়েকটি বিগ বাজেটের সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। চলতি বছরে যশ রাজ ফিল্মসের ‘জয়েসভাই জোর্দার’ এবং ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ সিনেমাগুলোর ব্যর্থতার পর ‘শমশেরা’ সিনেমাটির প্রতি সবার প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। সিনেমাটি কি শেষ পর্যন্ত সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছিলো? আজকের এই রিভিউতে থাকছে তার বিস্তারিত পর্যালোচনা।

কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘শমশেরা’ একজন বিদ্রোহী এবং তার গোত্রের গল্প নিয়ে নির্মিত। খামেরান হল একটি যোদ্ধা উপজাতি যারা মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় রাজপুতদের সাহায্য করেছিল। রাজপুতরা পরাজিত হওয়ার পর খামেররা চলে যায় এবং কাজা শহরে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে। কাজা বাসিন্দারা তাদের নিম্ন বর্ণের মর্যাদার কারণে তাদের নির্বাসিত করে। খামেররা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়। অন্য কোন উপায় না পেয়ে, তারা লুণ্ঠনে নামে এবং কাজার ধনী বাসিন্দাদের জীবনকে নরকে পরিণত করে।

শমশেরা (রনবীর কাপুর) এই গোত্রের নেতা এবং তার নির্দেশনায় খামেররা বেশ কুখ্যাত এবং ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কাজার বাসিন্দারা খামেরদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে যান। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ্য থেকে ইন্সপেক্টর শুদ্ধ সিংকে (সঞ্জয় দত্ত) দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা খামেরানদের আক্রমণ করে এবং তাদের প্রায় পরাজিত করে। শুদ্ধ সিং তখন শমশেরাকে একটি প্রস্তাব দেয়। তিনি তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং বিনিময়ে তিনি বাকি খামেরানদের একটি দূরবর্তী স্থানে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেবেন যেখানে তারা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। শমশেরা সে প্রস্তাবে রাজি হলে, তাকে এবং বাকি আদিবাসীদের কাজা ফোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে, শুদ্ধ সিং তাদের সাথে প্রতারণা করে এবং তিনি সকল খামেরানকে বন্দী করে নির্যাতন শুরু করেন।

শমশেরা ব্রিটিশ এবং শুদ্ধ সিংকে তার অসন্তোষ স্পষ্ট করে দেয়। তখন শুদ্ধ সিং তাকে আরেকটি প্রস্তাব দেয়। খামেররা যদি ৫,০০০ গ্রাম সোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হয় তবে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এইবার, তারা একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই প্রস্তাবকে আনুষ্ঠানিক করে তোলে। শমশেরা জানতে পারে যে পুকুরে একটি গোপন সুড়ঙ্গ রয়েছে যা বাইরের আজাদ নদীর সাথে সংযুক্ত। তিনি সুড়ঙ্গটি খুঁজে বের করতে চান এবং পালাতে চান যাতে তিনি তহবিলের ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু শমশেরা পালানোর সময় ধরা পড়ে যায়। পালানোর আগে শমশেরা তার স্ত্রীকে (ইরাবতী হর্ষে) বলেছিলেন যে তিনি যদি কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েন তবে তাকে অস্বীকার করতে হবে। তাই, তিনি ঘোষণা করেন যে শমশেরা একজন কাপুরুষ যে খামেরানদের পিছনে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তিনি তার সহকর্মী খামেরানদের জীবন বাঁচানোর জন্য এটি করেন। এরপর খামেররা শমশেরাকে পাথর মেরে হত্যা করে।

শমশেরার গর্ভবতী স্ত্রী বাল্লি নামে এক ছেলের জন্ম দেন। ২৫ বছর পর বাল্লিকে (রনবীর কাপুর) একজন উদাসীন যুবক হিসেবে দেখা যায়। শমশেরার প্রতি তার কোন শ্রদ্ধা নেই কারণ সে তার বাবাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে জেনেই বড় হয়েছে। শমশেরার বিশ্বস্ত সহযোগী পীর বাবা (রনিত রায়) তাকে প্রশিক্ষণ দেন যা তাকে সমস্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম করে তোলে। শুদ্ধ সিং বাল্লিকে অপমান করার পরে, তার মা তাকে তার বাবার সম্পর্কে সত্য বলে। বাল্লি তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে কাজা দুর্গ থেকে পালানোর চেষ্টা করে এবং সফল হয়। তিনি গোপন সুড়ঙ্গটি খুঁজে বের করে পালিয়ে যান এবং নাগিনা শহরে পৌঁছান। এরপর যা ঘটে তা সিনেমাটির বাকি অংশ তৈরি করে।

গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ সিনেমাটির গল্প লিখেছেন নীলেশ মিশ্র এবং খিলা বিষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে বক্স অফিসে সফল বা দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য সিনেমা পর্যালোচনা করলে সে বিষয়টির প্রাধান্য পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে সিনেমার শক্তিশালী একটি গল্প। ‘শমশেরা’ সিনেমার মত বড় বাজেটের একটি সিনেমার ক্ষেত্রে এই জায়গাতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। নীলেশ মিশ্র এবং খিলা বিষ্টের গল্প খুবই গতানুগতিক এবং সেকেলে। গল্পের যেমন নতুনত্ব নেই, তেমনি নেই কোন মুহুর্ত যা দর্শকদের সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম হয়।

গল্পের মত এই সিনেমাটির চিত্রনাট্যও দুর্বল। একতা পাঠক মালহোত্রা এবং করণ মালহোত্রার চিত্রনাট্য খুবই সরল সমীকরণের মত এবং অনুমানযোগ্য ভাবে এগিয়েছে। সিনেমাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরের দৃশ্যে কি হতে যাচ্ছে সেটা দর্শক খুব সহজেই অনুমান করতে পারে। চিত্রনাট্যে দর্শকদের জন্য স্মরণীয় কোন মুহুর্ত উপহার দিতে পারেননি লেখকরা। পীযূষ মিশ্রের সংলাপগুলো মোটামুটি। তবে ‘কাজে ডাকাত, ধর্মে স্বাধীন’ ছাড়া অন্য কোনো সংলাপ দর্শকদের মনে দাগ কাটতে পারবে না। এই ধরনের একটি সিনেমায় স্মরণীয় এবং হার্ড-হিটিং ওয়ান-লাইনার থাকা উচিত ছিল।

পরিচালনাঃ করণ মালহোত্রার নির্দেশনা তার মানদণ্ডের অনেক নীচে ছিলো ‘শমশেরা’ সিনেমার ক্ষেত্রে। ইতিবাচক দিক বলেতে তিনি বড় পরিসরে জাঁকজমকপূর্ন একটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। কয়েকটি দৃশ্য, বিশেষ করে প্রথমার্ধে, খুব ভাল কাজ করে এবং দর্শকদের একরকম পয়সা ভাসুলের অভিজ্ঞতা দেয়। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে সিনেমাটি মারাত্মকভাবে পড়ে যায়। কেউ এক মাইল দূরে থেকে অনুমান করতে পারে যে পরবর্তীতে কী ঘটতে চলেছে, বিদ্রোহীরা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হোক বা বাল্লির রাণীর মুকুট চুরি করুক।

‘শমশেরা’ সিনেমাটির শুরুটা ভালোভাবে করেছেন করণ মালহোত্রা। খামেরদেড় ফাঁদে পরা এবং দাস হয়ে যায় থেকে শুরু করে যে দৃশ্যে বাল্লিকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করা হয় এবং যখন সে তার বাবার সম্পর্কে সত্য জানতে পারে তখন একটি দুর্দান্ত মুহুর্ত তৈরি করে। এছাড়া কাযা থেকে তার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি তালির যোগ্য এবং এখান থেকে যে কেউ সিনেমাটি আরও ভাল হওয়ার প্রত্যাশা করে। এরপর যখন সে সহকর্মী খামেরানদের সাথে দেখা করে এবং লুটপাট শুরু করে সিনেমাটি দর্শকদের কিছুটা হলেও আশাবাদী করে তোলে।

কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে সিনেমাটি খেই হারিয়ে ফেলে। কারণ এটি অনুমানযোগ্য এবং খুব সরলভাবে এগিয়ে যায়। বিদ্রোহীরা যেভাবে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ট্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত ওয়ান-টেক শট কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এটি প্রত্যাশিত হিসাবে কার্যকর হয় না, কারণ মনে হয় মুকুট লুট করা শিশুর খেলা। সিনেমাটির সমাপ্তি পুরানো এবং অসংখ্যবার আগে দেখা গেছে এমন কিছু দিয়ে সাজানো। দ্বিতীয়ার্ধে সিনেমাটি নিয়ে দর্শকরা সহজেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হবে।

অভিনয়ঃ অভিনয়ের কথা বলতে গেলে, রনবীর কাপুর শমশেরা এবং বাল্লি চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তার সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করে চকলেট হিরোর যে ইমেজ তিনি গড়েছিলেন ‘শমশেরা’ সিনেমার মাধ্যমে সেটা ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। আর রনবীর সেখানে সফলতা দেখাতে পেরেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। সিনেমাটির গল্প এবং চিত্রনাট্য হতাশ করলেও রনবীর তার জায়গায় ছিলেন সেরা। শমশেরা লুক যেখানে খুবই ড্যাশিং ছিলো সেখানে বাল্লি চরিত্রে তিনি ছিলেন অনেকটা উচ্ছল এবং উদাসীন।

‘অগ্নিপথ’ এবং ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ২’ সিনেমার মাধ্যমে খলনায়ক চরিত্রে সঞ্জয় দত্ত নিজের যে ইমেজ তৈরি করেছিলেন, সেটা নষ্ট করেছেন ‘শমশেরা’ সিনেমায়। পুরো সিনেমায় সঞ্জয় দত্তের অভিনয় ‘ওভার এক্টিং’-এ ভরপুর ছিলো। অপ্রয়োজনীয় হাসাহাসি এবং কৌতুক দিয়ে সিনেমাটিতে নিজের চরিত্রকে করেছেন বিরক্তিকর। অন্যদিকে ভানি কাপুরকে দেখতে সুন্দর লেগেছে। কিন্তু সিনেমাটিতে তার চরিত্রটি ভালভাবে ফুটে উঠে নি এবং এটি তার অভিনয়কেও প্রভাবিত করে।

শমশেরার বন্ধু এবং বাল্লির প্রশিক্ষক চরিত্রে রনিত রায় নির্ভরযোগ্য ছিলেন বরাবরের মতই। এছাড়া ইরাবতী হর্ষের উপস্থিতি একটি বিশাল চিহ্ন রেখে যায়। সৌরভ শুক্লা (দুধ সিং) নিজের জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন। ক্রেগ ম্যাকগিনলে ঠিক আছে যদিও একজন ন্যায্য ব্রিটিশ অফিসারের চরিত্রটি একটি আকর্ষণীয় ধারণা ছিল। সৌরভ কুমার (চোহা), চিত্রক বন্দোপাধ্যায় (রাশো), মহেশ বলরাজ (উপ্রেতি), রুদ্র সোনি (পিতাম্বর) এবং প্রখর সাক্সেনা (ভুরা) নিজেদের চরিত্রে মাননসই ছিলেন।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ অনয় গোস্বামীর সিনেমাটোগ্রাফি দর্শনীয় এবং লাদাখের লোকেলকে সুন্দরভাবে ক্যাপচার করে। অ্যাক্রোপলিস, সুমিত বসু, স্নিগ্ধা বসু এবং রজনীশ হেদাও-এর প্রোডাকশন ডিজাইন ভালো ছিলো। ফ্রাঞ্জ স্পিলহাউ এবং পারভেজ শেখের অ্যাকশন কিছুটা বিরক্তিকর তবে এই নির্দিষ্ট সিনেমার জন্য মাননসই ছিলো। শিবকুমার ভি পানিকারের সম্পাদনা ঝরঝরে কিন্তু আরো অনেক বেশি আকর্শনীয় হতে পারত। ।

উপসংহারঃ সর্বপরি অনুমানযোগ্য গল্প আর চিত্রনাট্যে ‘শমশেরা’ সিনেমাটি একটি ভালো সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে। রনবীর কাপুর, সঞ্জয় দত্ত, রোনিত রায় এবং ভানি কাপুরের মত তারকাদের নিয়ে করণ মালহোত্রার প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু এরকম আয়োজনের একটি সিনেমার জন্য সে গল্প এবং চিত্রনাট্য পছন্দ করা হয়েছে সেটা এই প্রচেষ্টার প্রতি একধরণের অবিচার। যাই হোক রনবীর কাপুরের জন্য হলেও সিনেমাটি একবার দেখতে পারেন।

আরো পড়ুনঃ
সুরিয়াবংশী রিভিউ: নিজস্ব স্টাইলে এখন পর্যন্ত রোহিত শেঠির সেরা সিনেমা
বেলবটম রিভিউ: অনুমানযোগ্য গল্প আর চিত্রনাট্যে হিরোইজমের সরল সমীকরণ

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d