কোল্ড কেস রিভিউ: প্রত্যাশার পূরনে ব্যর্থ পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের নতুন থ্রিলার

কোল্ড কেস রিভিউ

চলচ্চিত্রের নামঃ কোল্ড কেস (২০২১)
মুক্তিঃ জুন ৩০, ২০২১
অভিনয়েঃ পৃথ্বীরাজ সুকুমারন, অদিতি বালান, লক্ষ্মী প্রিয়া চন্দ্রমৌলী, অনিল নেদুমাংগার, সুচিত্র পিল্লাই, আথমিয়া রাজন প্রমুখ।
পরিচালনাঃ তনু বালাক
প্রযোজনাঃ অন্ত জোসেফ, জমন টি জন এবং শামির মোহাম্মদ
পরিবেশনাঃ অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও
চিত্রনাট্যঃ শ্রীনাথ ভি নাথ
সম্পাদনাঃ শামির মোহাম্মদ
চিত্রগ্রহনঃ গিরিশ গাঙ্গাধারান
সংগীতঃ প্রকাশ এলেক্স

প্রারম্ভিক কথাঃ বিগত কয়েক বছর ধরে থ্রিলার সিনেমার জন্য মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অনন্য। আর থ্রিলার সিনেমার ক্ষেত্রে পৃথ্বীরাজ সুকুমারন নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। এই তারকার কোন থ্রিলার সিনেমা মানেই দর্শকদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। করোনা মহামারীর মধ্যেই দৃশ্যধারন হওয়া এই তারকার ‘কোল্ড কেস’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে সম্প্রতি ওটিটি অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও’তে। ক্রাইম এবং হররের সাথে থ্রিলার ধাঁচের গল্পের সিনেমাটি কেমন হল? দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণে কতটা সফল ছিলো পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের নতুন এই সিনেমা? আজকের রিভিউতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই থাকছে বিস্তারিত আলোচনা।

কাহিনী সংক্ষেপঃ সিনেমার গল্পের প্রধান দুটি চরিত্র এ সি পি সত্যজিৎ (পৃথ্বীরাজ সুকুমারন) এবং মেঘা (অদিতি বালান)। সত্যজিৎ কেরালার অন্যতম সফল পুলিশ কর্মকর্তা অন্যদিকে মেঘা একজন টিভি উপস্থাপিকা যিনি প্যারানরমাল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান করে থাকেন। গল্পের শুরুতে দেখা যায় মেঘা তার ব্যাক্তিগত এবং চাকুরী জীবন নিয়ে সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত জটিলতার পাশাপাশি টিভিতে তার পরিচালিত অনুষ্ঠানের টিআরপি’ও নিম্নমুখী। তবে মেঘার সবচেয়ে বড় শক্তিশালী দিক হচ্ছে ব্যাক্তিগত জীবনে সমস্যার ছায়া সে তার পেশাদার জীবনে পরতে দেয়নি। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে একজন সিঙ্গল মায়ের জীবন নিয়ে আত্নবিশ্বাসী মেঘা কেরালায় নতুন একটি বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করে।

অন্যদিকে মাছ ধরতে গিয়ে কেরালার একটি লেকে একজন মাঝি পলিথিনে মোড়ানো একটি মাথার খুলি পায়। কোন ধরনের ক্লু ছাড়া পুরো কেসটি পুলিশের কাছে আক্ষরিক অর্থেই চেহারা বিহীন কেস হয়ে দাঁড়ায়। এই জটিল কেসটির সমাধানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করে এসিপি সত্যজিৎ। একদম শূন্য নির্দেশনা থেকে কেসের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে সত্যজিৎ এগিয়ে যায় তদন্ত নিয়ে। অন্যদিকে নতুন বাড়িতে উঠার পর থেকেই মেঘার সাথে ঘটতে থাকে সব অস্বাভাবিক ঘটনা। প্যারানর্মাল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টিভিতে অনুষ্ঠান করা মেঘাকে মুখোমুখি হতে হয় নিজের বাড়িতে ঘটতে থাকা প্যারানর্মাল ঘটনার। এই পরিস্থিতিতে মেঘা জারা জাচ্ছাই (সুচিত্র পিল্লাই) এর সাহায্য চায়। জারা প্যারানর্মাল বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ এবং তিনি আত্নার সাথে কথা বলতে পারেন। মেঘার অনুরোধে জারা মেঘার বাড়িতে যান এবং সেখানে ঘটতে থাকা ঘটনার দেখে বাড়িতে আত্নার উপস্থিতি নিশ্চিত করে। জারা আরো বলে যে, এখানে যে আত্মাটি আছে সে মেঘাকে তার কোন একটি গোপন বিষয় বলতে চায় এবং তা উম্মচনে মেঘার সাহায্য চায়।

এদিকে এ সি পি সত্যজিৎ সেই কঙ্কাল কেসটি সমাধানের অনেক কাছাকাছি চলে আসে। সত্যজিৎ যে কেসের তদন্ত করছে তার সাথে মেঘার জীবনে ঘটতে থাকা অস্বাভাবিক ঘটনার কি কোন মিল আছে? সত্যজিৎ কি পারবে এরকম চেহারা বিহীন একটি কেসের রহস্য উম্মচন করতে? মেঘা কি পারবে সেই অতৃপ্ত আত্মার ইচ্ছে পূরণ করতে? মেঘার মাধ্যমে কি সত্য উম্মচন করতে চাচ্ছে সেই আত্মা? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আপনাকে দেখতে হবে পৃথ্বীরাজের নতুন থ্রিলার সিনেমা ‘কোল্ড কেস’।

গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ গল্পের দিক থেকে ‘কোল্ড কেস’ সিনেমার গল্প গতানুগতিক ধারারই বলা যায়। অতৃপ্ত আত্মার কোন এক অজানা সত্যের সন্ধানে কারো সাহায্যের চেষ্টা। তবে গতানুগতিক হরর গল্পের সাথে ক্রাইম থ্রিলারের একটা মিশ্রণ নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমার গল্প। দুটি সমান্তরাল তদন্তের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে সিনেমার গল্প। তবে একটি থ্রিলার সিনেমার গল্পে যে উত্তেজনার প্রত্যাশা তা গল্পে সেরকম পাওয়া যায়নি। আর সিনেমাটির গল্পের সবচেয়ে দূর্বল দিক ছিলো ক্লাইম্যাক্স। গল্পের ধারাবাহিকতায় ক্লাইম্যাক্সে যে উত্তেজনার প্রত্যাশা ছিলো তা ক্লাইম্যাক্সের একটু আগেই পানসে হয়ে গেছে। সিনেমার শেষে এসে অবশ্য সিনেমাটির দ্বিতীয় পর্বেরও একটা ইঙ্গিত রেখেছেন নির্মাতা।

গতানুগতিক গল্পের প্লটের পাশপাশি সিনেমাটির চিত্রনাট্যেও ছিলো দূর্বলতা। ক্রাইম এবং হরর থ্রিলারের সিনেয়ার চিত্রনাট্যে যে উপাদানগুলির গভীরতা এবং পরিমার্জনা দরকার ছিলো সিনেমার বাকী অংশে দেখা যায়না। এছাড়া সিনেমাতে মেঘার চরিত্রে আবেগের যে প্রয়োজন দরকার ছিলো চিত্রনাট্যে সেটাকে গ্রায্য করা হয়নি। চিত্রনাট্যে সবকিছু এতো সহজ এবং সমান্তরালে রচনা করা হয়েছে যে, দর্শক সিনেমাটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া সত্যজিৎ এবং তার সহকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের তদন্তের যে গতিশীলতা সেটা চিত্রনাট্যে আরো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনটা অনুধাবনীয়। অন্যদিকে সিনেমাটির সংলাপের প্রভাবটা অনেকটাই উপেক্ষিত থেকে গেছে। সত্যজিৎ এবং তার টিমের সদস্যের মধ্যের কথোপকথনে থ্রিলার গল্পের আমেজ পুরোপুরি অনুপস্থিত। কেসের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা, উপস্থাপনা এবং পর্যালচনা অনেকটাই ক্লাসরুমে লেকচার দেয়ার মত মনে হয়েছে। এছাড়া সিনেমাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ন চরিত্র মেঘার কাছেও প্রভাব ফেলার মত কোন সংলাপ ছিলো না।

পরিচালনাঃ নির্মাতা তনু বালাক পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘কোল্ড কেস’। প্রথম সিনেমায় থ্রিলার নির্মানের যে সাহস দেখিয়েছেন তনু সেখানে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। গল্পের ধারা বর্ননা থেকে শুরু করে মূখ্য চরিত্রগুলোর যে বিন্যাস একজন নির্মাতার স্বপ্নকে পূর্নতা দেয় সেখানে তনু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারনেনি।
অভিনয়ঃ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পৃথ্বীরাজ সুকুমারন এবং অদিতি বালান। সাধারণত থ্রিলার সিনেমার জন্য পৃথ্বীরাজ সুকুমারন এখন পর্যন্ত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘থ্রিলার কিং’ হিসেবে। ‘কোল্ড কেস’ সিনেমায় পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের সেই ঝলক পুরোপুরি দেখা যায়নি। তার পর্দা উপস্থিতি অবশ্যই দর্শকদের কিছুটা স্বস্থি দিবে কিন্তু একটি থ্রিলার সিনেমায় এই অভিনেতার প্রতি দর্শকদের যে প্রত্যাশা সেটা পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে অদিতি বালান পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের পাশাপাশি সিনেমাটির অন্যতম কেন্দ্রীয় জায়গায় ছিলেন। নিজের চরিত্রে অদিতি মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। তবে কিছু কিছু দৃশ্যে এই অভিনেত্রীর অভিব্যাক্তিতে অনেকটা রবোটিক ব্যাপার ছিলো। একজন সিঙ্গল মায়ের চরিত্রে যে লড়াই এবং আবেগের অভিব্যাক্তি প্রয়োজন ছিলো সেটা দেখা যায়নি তার মাঝে। এছাড়া নিজের ছোট বোনের আত্মহত্যার বিষয়ে তার উদাসীনতা তার চরিত্রকে অনেকটাই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এছাড়া সিনেমার অন্যান্য চরিত্রে অভিনয়কৃত শিল্পীরা নিজেদের জায়গায় মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ দুর্বল গল্প এবং চিত্রনাট্যের মাঝে সিনেমাটির সবচেয়ে ভালো দিক সম্ভবত চিত্রগ্রহন। সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যের এঙ্গেল এবং সেই সাথে ক্যামেরার গতি সব মিলিয়ে চিত্রগ্রহন সিনেমাতে দর্শকদের কিছুটা স্বস্থি দিবে। তবে গল্প এবং চিত্রনাট্যের মত সিনেমাটির সম্পাদনায় দেখা গেছে দূর্বলতার ছাপ। বিশেষ করে সিনেমাটির প্রথম অর্ধেক প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী লম্বা ছিলো। এছাড়া ক্লাইম্যাক্সকে আরো বেশী উত্তেজনাকর করার যে সুযোগ ছিলো সেটা সম্পাদকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।

উপসংহারঃ সবকিছু বিবেচনায় ‘কোল্ড কেস’ সিনেমাটি থ্রিলার সিনেমার মধ্যে দুর্বলতম একটি সিনেমা। ক্রাইম, হরর এবং থ্রিলার – তিন উপাদানের মিশ্রণে সিনেমা নির্মান করতে গিয়ে কোন উপাদানই ভালোভাবে উঠে আসেনি সিনেমায়। আপনি যদি থ্রিলার সিনেমার এবং পৃথ্বীরাজ সুকুমারনের ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে দেখতে পারেন সিনেমাটি। তবে অবশ্যই নিজের প্রত্যাশা সংবরণ করে দেখতে বসবেন। ‘দৃশ্যাম’ এবং ‘কোল্ড কেস’ দুইটি সিনেমাই মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রির হলেও ‘কোল্ড কেস’ সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেনা।

আরো পড়ুনঃ
আর্মি অফ দ্যা ডেড রিভিউ
রাধে রিভিউ
দৃশ্যাম ২ রিভিউ

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d