এফ ৯ রিভিউ: দূর্বল গল্প আর চিত্রনাট্যে অ্যাকশন এবং স্টান্টের ভরপুর প্রদর্শনী

চলচ্চিত্রের নামঃ এফ ৯ – ফাস্ট সাগা (২০২১)
মুক্তিঃ জুন ২৫, ২০২১
অভিনয়েঃ ভিন ডিজেল, মিশেল রড্রিগেজ, জর্দানা ব্রেওস্টার, টাইরিস গিবসন, লুদাক্রিস, নাথালি ইমানুয়েল, চার্লিজ থেরন, জন কেনা, ফিন কোল, সান ক্যাং প্রমুখ।
পরিচালনাঃ জাস্টিন লিন
প্রযোজনাঃ নীল এইচ মর্টিজ, ভিন ডিজেল, জাস্টিন লিন, জেফ, জো রোথ, ক্লাইটন টাউসেন্ড, সামান্তা ভিনসেন্ট
পরিবেশনাঃ ইউনিভার্সেল পিকচার্স
কাহিনীঃ জাস্টিন লিন, আলফ্রেড ব্রোটেলো এবং ডেনিয়েল ক্যাসি
চিত্রনাট্যঃ ডেনিয়েল ক্যাসি এবং জাস্টিন লিন
সম্পাদনাঃ ডাইলিন হাইস্মিথ, ক্যালি মাটসুমুতু এবং গ্রেগ ডি’আরিয়া
চিত্রগ্রহনঃ স্টিফেন এফ উইনডেন
সংগীতঃ ব্রায়ান টেইলার

প্রারম্ভিক কথাঃ হলিউডের সিনেমা ফ্রাঞ্ছাইজিগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল এবং জনপ্রিয় ফ্রাঞ্ছাইজি ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’। অ্যাকশন এবং দুর্দান্ত সব গাড়ির স্টান্টের জন্য বিখ্যাত এই ফ্রাঞ্ছাইজিটি। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে এই সিরিজের নবম পর্ব। নতুন এই পর্বে ফিরিয়ে আনা হয়েছে আগের কয়েকটি পর্বের হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু চরিত্র। ট্রেলার প্রকাশের পর থেকেই সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের মাঝে দেখা গেছে উত্তেজনা। কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে একাধিকবার সিনেমাটির মুক্তির তারিখ পিছিয়ে গিয়ে অবশেষে ২৫শে জুলাই মুক্তি পেয়েছে এই সিনেমা। এদিকে কিছুদিন আগেই ভিন ডিজেল জানিয়েছেন ১১তম পর্ব দিয়ে শেষ হচ্ছে এই ফ্রাঞ্ছাইজি। তাহলে কেমন হলো সিরিজের নিবম পর্ব ‘এফ ৯: ফাস্ট সাগা’? দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণে কতটা সফল ছিলো এই সিনেমা? আজকের রিভিউতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।

কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘এফ ৯’ সিনেমাটির গল্প শুরু হয় ১৯৮৯ সালের একটি কার রেসের ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে। সেখানে দেখা যায় কার রেসে মারা যান ডোম (ভিন ডিজেল) এর বাবা টরেটো। টরেটোর মৃত্যুর জন্য ডোমের ছোট ভাই জ্যাকব টরেটো (জন কেন) কে দায়ী করা হলে জ্যাকব ডোমের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর সিনেমাটির দৃশ্যপটে আসে বর্তমান, যেখানে ডোম এবং লেটি (মিশেল রদ্রিগেজ) ডোমের ছেলেকে নিয়ে শান্তিপূর্ন জীবন যাপন করছে। এই অবস্থায় রোমান (টাইরিস গিবসন), তেজ (লুদাক্রিস) এবং রামসি (নাথালি ইমানুয়েল) একটি খবর নিয়ে ডোমের কাছে আসে। তারা ডোমকে জানায় যে জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা মিঃ নোবডি ডোমের দলের পুরনো শত্রু সাইফার (চার্লিজ থেরন) কে নিয়ে জেলে যাওয়ার সময় তাদের প্লেন এক অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে পরে ক্রাশ হয়ছে এবং এর ধ্বংসাবশেষ সেন্ট্রাল আমেরিকার একটি দেশ মন্টিকুইন্টোতে আছে।

তেজ এবং রামসি ধারণা করে যে এই ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মিঃ নোবডি ডোমের দলকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু ডোম মন্টিকুইন্টোতে যেতে প্রাথিমিকভাবে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু লেটি ইতিমধ্যে রোমান, তেজ এবং রামসির সাথে যোগ দেয়। এরপর শেষ মুহুর্তে এসে ডোমও তাদের সাথে যোগ দেয় এবং মন্টিকুইন্টোতে সেই প্লেনের ধ্বংস হয়ে যাওয়া অংশ পর্যবেক্ষন করতে যায়। মন্টিকুইন্টোতে সেই অভিযানেই ডোম জানতে পারে এই প্লেন ক্রাশের পিছনে তার ছোট ভাই জ্যাকবের হাত রয়েছে। জ্যাকব এই প্লেন ক্রাশের মাধ্যমে সাইফারকে তার উত্তর ইউরোপিয়ান বস অট্টো (থ্রু এরস্টার রাসমুসেন) এর কাছে পৌঁছে দেয়।

এদিকে অট্টো সেই প্লেনে পাওয়া একটি সিক্রেট ডিভাইসের অর্ধেক অংশ উদ্ধার করে বাকি অর্ধেকের সাথে যুক্ত করে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নেটয়ার্ক নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এর মাধ্যমে অট্টো বিশ্বের প্রতিটি দেশের নিরপত্তা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হবে এবং নিজের ইচ্ছেমত প্রতিটি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আঘাত আনতে পারবে। আর এ কাজে তাকে সহায়তা করে সাইফার। বিশ্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অট্টোর হাত থেকে বাঁচাতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে লড়াইয়ে নামে ডোম এবং তার দল। এদিকে সিনেমার কয়েক জায়গায় অট্টো তার বাবার কথা বলেছে যদিও সিনেমায় সে চরিত্রকে দেখানো হয়নি। তাহলে প্রতিবারেরমত ডোম কি পারবে তার নতুন মিশনে সফল হতে? এবার ডোমকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার ভাইয়ের সাথে, তাহলে কেমন হবে সে লড়াই? এরকম এক পরিস্থিতিতে এগিয়ে যায় সিনেমাটির গল্প।

গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ ফ্রাঞ্ছাইজির সিনেমা মানেই দর্শনীয় সব স্টান্ট এবং দুর্দান্ত অ্যাকশন। তবে সিনেমার সফলতা অনেকটাই নির্ভর করে সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য। বাকি অন্যান্য বিষয়গুলো সেই গল্প এবং চিত্রনাট্যকে সমর্থনের মাধ্যমে উপভোগ্য একটি সিনেমার রুপ দেয়। ‘এফ ৯: ফাস্ট সাগা’ সিনেমার গল্পে এর আগের পর্বগুলোর মত সেই তীক্ষ্ণতা অনুপস্থিত ছিলো। ডোমের পরিবারের সাথে এবং জ্যাকবের সাথে ডোমের সম্পর্কের সমীকরণ অনেকটাই খাপছাড়া মনে হয়েছে। এছাড়া এই পর্বে ফিরিয়ে আনা হয়েছে সিনেমাটির টোকিও ড্রিফট পর্বের হান চরিত্রটি। ফিরিয়ে আনা হলেও এই সিনেমায় হানের তেমন কোন ভূমিকা ছিলো না। আর যেটুকু ছিলো তাতে মনে হয়ে হানকে শুধু ফিরিয়ে আনার তাগিদেই গল্পে তার চরিত্রটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সম্ভবত সিনেমাটির পরের পর্বে হানের চরিত্রের গুরুত্ব পারতে পারে আর হানের পর যদি দশম পর্বে নির্মাতারা গিসেল ইশার (গাল গ্যারট) – কে ফিরিয়ে আনেন নির্মাতারা তাহলে অবাক হব না। তবে পরের পর্বে ব্রায়ান চরিত্রটি যে ফিরে আসছে সেটা সিনেমার শেষ দৃশ্যে নিশ্চিত করেছেন নির্মাতারা।

চিত্রনাট্য বিবেচনায় গল্পের চেয়ে হয়তো কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে ‘এফ ৯: ফাস্ট সাগা’। তবে সিনেমাটির অন্যান্য পর্বগুলোর মত এই পর্বের চিত্রনাট্যে দুর্বলতা স্পষ্ট ছিলো। এছাড়া এই ফ্রাঞ্ছাইজির চরিত্রগুলো সবসময়ই কিছুটা অতিমানবিক ছিলো, কিন্তু এই পর্বের চিত্রনাট্যে চরিত্রগুলো যেকোন সুপারহিরো চরিত্রের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী মনে হয়েছে। এছাড়া শক্তিশালী পারিবারিক মুল্যবোধের কথা বলা সিনেমাটিতে হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সাথে ডোম এবং মিয়ার দৃশ্যগুলোতে সেই আবেগের অনুপস্থিতি দেখা গেছে। তবে বরাবরের মত এই ফ্রায়ঞ্চাইজির অন্য সিনেমাগুলোর মত গাড়ির স্টান্টের দৃশ্যগুলো দৃষ্টনন্দন লেগেছে। আর অ্যাকশন এবং স্টান্টে নতুনত্ব আনতে চুম্বকের ব্যবহার কিছুটা ভিন্নতা এনেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

পরিচালনাঃ নির্মাতা জাস্টিন লিন ‘এফ ৯’ সহ ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজের সর্বাধিক ৫টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। এই পর্বেও জাস্টিন লিন নিজের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ‘ফাস্ট ফাইভ’ সিনেমার পর এই নির্মাতার প্রতি সবার প্রত্যাশাও ছিলো আকাশচুম্বী। ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস ৬’ সিনেমায় সে প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা গেলেও ‘এফ ৯’ সিনেমায় সেখানে কিছুটা ছেদ দেখা গেছে। এছাড়া মন্টিকুইন্টোতে ডোম এবং তার দলকে সে দেশের সেনাবাহিনীর ধাওয়ার দৃশ্য চূড়ান্ত অযৌক্তিকতা দেখা গেছে। অ্যাকশনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জাস্টিন এই দৃশ্যে সিনেমার চরিত্রগুলো অতিমানবিকতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর মহাকাশে রোমান এবং তেজকে নিয়ে দৃশ্যটি পুরোপুরি হাস্যকর লেগেছে। সম্ভবত এই সিনেমার মাধ্যমে ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজের নিজস্ব ফিজিক্স তত্ত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন নির্মাতা জাস্টিন লিন।

অভিনয়ঃ অভিনয়ের দিক থেকে ‘ফাস্ট ৯’ সিনেমার প্রধান তারকাদের সবাইকে খুব বেশী ক্লান্ত লেগেছে। বিশেষ করে ভিন ডিজেল এবং মিশেল রদ্রিগেজের মধ্যকার রসায়ন এই পর্বে অনুপস্থিত ছিলো মনে হয়েছে। তবে অ্যাকশন এবং স্টান্টের দিক থেকে সিনেমাটির সব শিল্পীরা নিজেদের সেরাটা উপহার দিয়েছেন বলা যায়। টাইরিস গিবসন, লুদাক্রিস এবং নাথালি ইমানুয়েলের মধ্যকার রসায়ন বরাবরের মতই উপভোগ্য ছিলো। কিন্তু সীমিত পর্দা উপস্থিতির কারনে চার্লিজ থেরনের এই সিনেমায় করার মত তেমন কিছু ছিলোনা।

হান চরিত্রে সাং ক্যাং ফিরে আসলেও পর্দায় তেমন প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়নি। ভিন ডিজেল এবং মিশেলের মত তাকেও অনেক ক্লান্ত মনে হয়েছে এই সিনেমায়। অন্যদিকে জ্যাকব চরিত্রে জন কেনার অভিনয়ের চেয়ে অ্যাকশন আর স্টান্টেই বেশী দেখা গেছে। তার চরিত্র তিনি ভালোভাবেই পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন। অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতারা তাদের নিজেদের জায়গায় মুটোমুটি ভালো অভিনয় করেছেন।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ ‘এফ ৯’ সিনেমাটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিলো স্টিফেন এফ উইনডেনের চিত্রগ্রহণ। ফাস্ট অ্যাকশন এবং স্টান্টের দৃশ্যে ভরপুর এরকম একটি সিনেমার দৃশ্যগুলো বেশ ভালভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন এই চিত্রগ্রাহক। চুম্বকের আকর্ষনে সাজানো অ্যাকশন দৃশ্যগুলো উইডেনের চাতুর্যে ফুতে উঠেছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। তবে সিনেমাটির সম্পাদনায় কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। সিনেমার দৈর্ঘ কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে দিয়ে সিনেমাটির ঘটনা প্রবাহে অনেক বেশী দ্রুতগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সম্পাদনায় আরো কিছুটা তীক্ষ্ণতা প্রদর্শনের সুযোগ ছিলো বলে মনে হয়েছে।

উপসংহারঃ ‘এফ ৯’ সিনেমাটি সবসময়ই যেকোন ধরনের যৌক্তিকতার উর্ধে। এই ফ্রাঞ্চাইজির প্রতিটি পর্বের চরিত্রগুলো সিনেমাটির মতই অতিমানবিক রূপে হাজির হয়েছেন পর্দায়। গল্প এবং চিত্রনাট্যে দূর্বলতা থাকলেও সিনেমাটির অ্যাকশন এবং স্টান্টের কারনে দর্শক ধরে রাখতে সক্ষম হবে। ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ এবং অ্যাকশন সিনেমা ভক্তদের ভালো লাগবে সিনেমাটি। সম্ভবত গল্প এবং চিত্রনাট্যের দুর্বলতা আড়াল করতেই অ্যাকশন এবং স্টান্টের ভরপুর প্রদর্শনী দেখা গেছে সিনেমাটিতে। লজিক বাদ দিয়ে শুধু বিনোদনের ম্যাজিক উপভোগ করতে চাইলে দেখতে পারেন ‘এফ ৯: ফাস্ট সাগা’।

আরো পড়ুনঃ
ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস ফ্রাঞ্চাইজি তালিকাঃ খারাপ থেকে ভালো অনুযায়ী
ব্ল্যাক উইডো রিভিউ
আর্মি অফ দ্যা ডেড রিভিউ

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত

%d