দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার কাছে নাস্তানাবুদ বলিউডঃ কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার

দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার

ভক্ত সংখ্যার দিক থেকে যে কোন আঞ্চলিক চলচ্চিত্র শিল্প থেকে এগিয়ে বলিউড। হিন্দি ভাষা বলিউডকে ভারতের চলচ্চিত্রের বাজারের বড় একটি অংশকে দর্শক হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে, দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলি বলিউডের আড্ডায় আঞ্চলিক সিনেমার বেশ বড় একটি অনুগত ভক্ত সমাজ তৈরি করেছে। ‘বাহুবলী’, ‘রোবট’, ‘কেজিএফ’ এবং সর্বশেষ ‘পুষ্পা’ সিনেমাগুলোর হিন্দি ভাষায় সাফল্য সেটাই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাগুলো আঞ্চলিক বাজারের বাইরে ভারতজুড়ে মুক্তি পাচ্ছে প্যান-ইন্ডিয়া সিনেমা হিসেবে।

বর্তমানে দক্ষিণ ভারতীয় যে সিনেমাগুলো প্যান-ইন্ডিয়া মুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে সে সিনেমাগুলো ২০২২ সালে ভারতীয় সিনেমার বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের পর্যালোচনায় দেখা গেছে চলতি বছরে হিন্দি ভাষায় সিনেমার বক্স অফিস আয়ের ৫০% এর বেশী দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার দখলে থাকবে। মূলত বলিউডের সিনেমার বাজারে বলিউডকে ছাপিয়ে যাবে এই সিনেমাগুলো। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার এই সাফল্য ইঙ্গিত দেয় যে, দক্ষিণের নির্মাতারা এমন কিছু করছেন যা বলিউডের নির্মাতারা করছেন না। এরকম কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো আজকের এই লিখায়।

১। গল্প বাছাইয়ে নিজস্বতা
গল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার নিজস্ব একটি ধরন আছে। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার নির্মাতারা গল্পের প্রেক্ষাপট নিয়ে গভীর গবেষণা করেন। এই গবেষণার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করে যে চিত্রনাট্য যেন বাস্তবতা থেকে খুব বেশী দূরে না থাকে। কিছু বাণিজ্যিক বিষয়বস্তু ছাড়াও, তাদের গল্প অনবদ্য। এমনকি যদি তারা বাণিজ্যিক উপরকন প্রদর্শন করে, দর্শকরা ট্রেলার থেকেই তার বিনোদনের উপকরণ বুঝতে পারে। মূলত, প্রেক্ষাগৃহে ঢোকার আগে দর্শকরা জেনে যায় সিনেমাটি বিনোদনমূলক নাকি বার্তানির্ভর হবে।

এমনকি যদি তারা তাদের দর্শকদের কাছে একটি এলিয়েন ধারণা চিত্রিত করে, সেটা বাস্তবকে ভিত্তি করে নির্মান করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৬ সালে ‘ভেট্টইয়াদু ভিলাইয়াদু’ নামে একটি তামিল চলচ্চিত্র ছিল যার বিষয়বস্তু ছিলো সমকামিতা। সিনেমাটিতে এই চরিত্রের চিত্রায়ন এত সূক্ষ্ম ছিল যে দর্শকদের মনে হয়েছিল এটি বাস্তব কিছু। এখন, এই সমকামিতাকে ‘দোস্তানা’ বা বলিউডের সিনেমায় দেখানো অন্যান্য সমকামী চরিত্রের সাথে তুলনা করুন। সেই তুলনায় বুঝতে পারবেন এগুলোকে বাস্তব থেকে ভিন্ন কিছু হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই চরিত্রগুলোর চারপাশের সামাজিক পরিবেশ বলিউডের সিনেমায় সবসময়ই উপেক্ষিত থেকে গেছে।

২। পরিচালনা
দর্শকরা ভালো খারাপ অভিনয়ের পার্থক্য জানেন। যদিও তারা স্পষ্টভাবে এটি প্রকাশ করতে পারে না, তারা হতাশ হয়ে সিনেমা হল ছেড়ে চলে যায়। এক্ষেত্রে বলিউড নির্মাতাদের থেকে এগিয়ে দক্ষিণের নির্মাতারা। তারা প্রাণহীন চরিত্রে প্রাণ দিতে পেরেছেন। আপনি যদি একটি দক্ষিণ ভারতীয় একটি সিনেমা দেখেন এবং তার হিন্দি সংস্করণ দেখেন তাহলে আপনি পার্থক্যটি বুঝতে সক্ষম হবেন। দক্ষিণের পরিচালকরা সিনেমায় এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ মহড়া নিশ্চিত করে যে, সিনেমাটির নির্মানে সামান্য থেকে কোনও সূক্ষ্ম ত্রুটি নেই। চরিত্র, অ্যাকশন, ব্যাকগ্রাউন্ডের ইউনিফর্ম থিম হল দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দ্বারা যত্ন নিয়ে সাজানো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।

৩। অভিনয়
স্বজনপ্রীতি মানব প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। বলিউড মনে হয় বিষয়টিকে বেশী সিরিয়াসলি মেনে নিয়েছে। কিন্তু, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা এই ধারনা থেকে আলাদা। তাদের সিনেমায়ও স্বজনপ্রীতি রয়েছে কিন্তু এর প্রকৃতি বলিউডের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বলিউডে, নতুন প্রতিভারা প্রথম রাউন্ডেই বিতাড়িত হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা নতুন প্রতিভাকে স্বাগত জানায়। এটি নিশ্চিত করে যে এমনকি স্বজনপ্রীতিমূলক বাচ্চারাও তাদের পেশার ক্ষেত্রে তাদের সেরাটা দিতে বাধ্য হয়। কারন তারা জানে যদি তারা নিজেদের সেরাটা নিশ্চিত করতে না পারে, তাদের প্রতিস্থাপনের জন্য নতুনদের একটি দীর্ঘ লাইন সেখানে অপেক্ষা করছে।

নতুনদের সাথে প্রতিভাবান অভিনেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা শিল্পে নতুন গতিশীলতা দেয়। বছরের পর বছর ধরে, দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। যেমন ধরুন ‘বাহুবলী’ সিনেমায় প্রভাস বা ‘অর্জুন রেড্ডি’ সিনেমায় বিজয় দেবেরকোন্ডা। প্রকৃতপক্ষে, ‘অর্জুন রেড্ডি’ সিনেমায় বিজয় দেবেরকোন্ডার খ্যাতি সিনেমাটি রিমেক করে নিজেকে প্রথমসারির তারকাদের কাতারে নিয়ে আসতে শাহিদ কাপুরকে বাধ্য করেছিল।

৪। প্রযুক্তি যথোপযুক্ত ব্যবহার
একুশ শতক সিনেমায় প্রযুক্তির অভিযোজনের সবচেয়ে বড় সাক্ষী হয়ে রয়েছে। যদিও বেশিরভাগ শিল্প এখনও একটি সূত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে, দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প এই অভিযোগের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ‘বাহুবলী’ সিনেমায় যেভাবে ভিএফএক্স ব্যবহার করা হয়েছিল তাতেই তা স্পষ্ট। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা বাস্তব জীবনের সাথে একীভূত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে। প্রযুক্তি ব্যবহার করার সময় পর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতার সাথে মিল রাখার ক্ষেত্রে কোন সমঝোতা করেন না দক্ষিণের নির্মাতারা। প্রযুক্তির ব্যবহার দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে পর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতার চিত্রকে আরো মসৃণ করে।

৫। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রচার
একদিকে, বলিউড নিজেদের শেকড় ভুলে পুরো মেতেছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি নিয়ে এবং ধারাবাহিকভাবে দর্শকদের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাগুলি ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার গল্প নিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। তারা সমালোচনার নামে পরিবারতন্ত্রকে হেয় করে না। সন্তানের জন্ম উদযাপন, কলেজ জীবন, পরিবার-ভিত্তিক প্রেমের গল্প, বিবাহ; হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের ঐতিহ্যবাহী সভ্যতাকে চিত্রিত করা করছে। অন্যদিকে, পশ্চিমের কিছু দর্শকদের খুশি করার জন্য বলিউড তার নিজস্ব অনুরাগীদের সিনেমা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে।

বলিউডের প্রভাবশালী নির্মাতা করণ জোহর একসময় দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাকে সুস্থ প্রতিযোগী বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর থেকে তারা আঞ্চলিকতার বাধা ভেঙেছে এবং নিজেদের সিনেমাকে প্যান-ইন্ডিয়া গ্রহণযোগ্যতা দিতে সফল হয়েছে। এখন বলিউডে অনেক প্রতিযোগী রয়েছে। বলিউডের সিনেমার প্রতিযোগীদের মধ্যে রয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প এবং এছাড়া নদিয়া সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও চালু হতে চলেছে। বলিউড যদি নিজেদের উন্নতি নিশ্চিত না করে তাহলে তারাও একসময় ডারউইনের বিলুপ্তি তথ্যের পথে হাঁটবে।

আরো পড়ুনঃ
পট পরিবর্তনের বছর ২০২২: দক্ষিনের দখলে ভারতীয় সিনেমার বাজার

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d