রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’: বলিউডে গ্যাংস্টার সিনেমার ধারা বদলের উপ্যাখ্যান

রাম গোপাল ভার্মার 'সত্যা'

রাম গোপাল ভার্মার 'সত্যা'

১৯৯৫ সালে আমির খান এবং ১৯৯৭ সালে সঞ্জয় দত্তকে নিয়ে যথাক্রমে ‘রঙ্গিলা’ এবং ‘দৌড়’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করেন দক্ষিনি সিনেমার নির্মাতা রাম গোপাল ভার্মা। এর মধ্যে ‘রঙ্গিলা’ সিনেমাটি ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হলেও বক্স অফিসে ব্যর্থ হয় ‘দৌড়’। এরপর এই নির্মাতা ঘোষনা তার নতুন সিনেমার। রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ সিনেমাটির কলাকুশলীরা বর্তমানে নিজেদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৯৭ সালে তারা সিনেমা দর্শকদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত ছিলেন। সিনেমাটিতে রাম গোপাল ভার্মার সাথে ছিলেন অনুরাগ কাশ্যপ যিনি বলিউডে মাত্রই সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। সৌরভ শুক্লা এবং মনোজ বাজপেয়ীর কয়েকটি সিনেমা সমালোচকদের কাছে প্রশংসা কুড়ানো ছাড়া তেমন কোন অর্জন নেই। বিশাল ভরদ্বাজ কম্পোজার হিসেবে যাত্রা শুরু করছেন সে সময়ে। এছাড়া মকরন্দ দেশপান্ডে এবং অপূর্ব আসরানি, সন্দীপ চৌতা এবং আদিত্য শ্রীবাস্তব সবাই ক্যারিয়ারে ভালো সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।

সিনেমাটির সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই বলিউডে নিজেদের অবস্থান গড়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। আর তাদের নিয়েই দক্ষিনের সিনেমার এক স্বপ্নবাজ নির্মাতা নির্মান করেন বলিউডে গ্যাংস্টার সিনেমার ধারা বদলের উপ্যাখ্যান ‘সত্যা’। ১৯৯৮ সালের ৩রা জুলাই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। মুক্তির প্রথম দুই থেকে তিন দিন বক্স অফিসে সিনেমাটির আয় ছিলো হতাশাজনক। সম্ভবত রাম গোপাল ভার্মা ‘দৌড়’ সিনেমার পর তার দ্বিতীয় ব্যার্থ সিনেমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ‘সত্যা’ মুক্তির আগেই অবশ্য রাম গোপাল ভার্মা তার নতুন সিনেমা ‘কৌণ’ এর কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। বলিউডের সবার মনে প্রশ্ন ছিলো ‘সত্যা’ সিনেমার পর রাম গোপাল ভার্মা কি আবারো হিন্দি সিনেমা নির্মানের সুযোগ পাবেন? নাকি তাকে ফিরতে হবে তেলুগু সিনেমায়?

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সিনেমাটির বক্স অফিস আয় বাড়তে থাকে। দর্শকরা সিনেমাটির রিভিউতে আকৃষ্ট হয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমাতে থাকে। নিজে দেখে এসে বন্ধুদের সাথে সিনেমাটি নিয়ে কথা বলে, পরিবারের অন্যদের সাথে আলোচনা করে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ সিনেমার প্রশংসা। ফলশ্রুতিতে বলিউড একটি ব্যবসা সফল সিনেমার পাশাপাশি পেয়ে যায় একজন নির্মাতার। যে নির্মাতা পরবর্তিতে বদলে দেন বলিউড সিনেমার চিরাচরিত গল্প বলার ধরন। বলিউডে রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ সিনেমার বহুমুখী প্রভাবের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গ্যাংস্টার সিনেমার ধারা।

রাম গোপাল ভার্মার 'সত্যা'

হিন্দি সিনেমায় দর্শকরা সাধারণত ভূমিহীন কৃষক, রিকশাচালক, সেনা বাহিনীর ডাক্তার, সার্কাস ক্লাউনদের জীবনের গল্প দেখেছিল। এসবের মধ্যে কর্মজীবী শহুরে অপরাধীর জীবনকে গুরুত্বের সাথে অন্বেষণ করার কথা কেউ ভাবেনি। অবশ্যই, হিন্দি সিনেমায় গ্যাংস্টার ছিল, তবে তারা বেশিরভাগই ব্যতিক্রম ছিল – যেমন অজিত এবং প্রেম নাথের অভিনয় করা গডফাদারদের মতো কিংবা ‘পারিন্দা’ (১৯৮৯) সিনেমায় নানা পাটেকরের সাইকোটিক আন্নার মতো। সেসময় খুব কম চলচ্চিত্র নির্মাতা একজন সাধারণ অপরাধীকে নিয়ে বলা গল্পের সম্ভাবনা বিবেচনা করেছিলেন। ‘সে যে কেউ হতে পারে’, যেমনটা সুকেতু মেহতা ম্যাক্সিমাম সিটিতে দাউদ ইব্রাহিমের সংস্থার একজন শুটার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লিফট ম্যান, আমার মামার অফিসের পিয়ন, আমার গাড়িতে যাওয়ার সময় ফুটপাতে হাঁটছেন এমন যে কেউ।’

কিন্তু রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ সিনেমাটি কল্পনা করেছে একজন গ্যাংস্টারের জন্য একটি দিন, এক সপ্তাহ, এক মাস কেমন হতে পারে। তাদের মধ্যে একজন সাধারণ মানুষের আচরণ ছিলো, তারা যখন চাকরিতে ছিল তখনই নয় বরং তারা যখন মদ্যপান করে এবং তাদের স্ত্রীদের সাথে তর্ক করে এবং ডেটে যায়। দুই বছর আগে ‘ইস রাত কি সুবাহ না’ (১৯৯৬) সিনেমায় সুধীর মিশ্র গ্যাংস্টারদের পরিবারের লোক হিসাবে দেখিয়েছিলেন। সিনেমাটির সেরা দৃশ্যগুলির মধ্যে একটি ছিল আশিস বিদ্যার্থী যখন ব্যবসার কথা বলার চেষ্টা করে তখন তার বাবা, বোন এবং ভাইদের বিরোধিতা। ‘সত্যা’ এই ধারণাটি গ্রহণ করে গল্পের ধরনটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। ভার্মার সিনেমাটি আধুনিকতার আদলে ছিলো না, ফটোগ্রাফি অশোভিত ছিল, ছিলো রুক্ষ ভাষার ব্যবহার। সিনেমাটির এর বেশিরভাগই বাস্তব লোকেশনে চিত্রায়িত করা হয়েছিলো যা সিনেমাটিকে একটি বাস্তব গল্পের রূপ দিয়েছে।

তবে সংগঠিত অপরাধের নৈতিক পতনে ভার্মা আগ্রহী ছিলেন না। তিনি শুধুমাত্র একটি নিষ্ঠুর এবং ক্যারিশম্যাটিক দুনিয়ায় আসা এবং যাওয়া দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ সিনেমাটি বলিউডে গ্যাংস্টার সিনেমার ধারা বদলের যা যাত্রা শুরু করেছিলো তা শীঘ্রই অন্যরাও অনুসরণ করা শুরু করেন। এই ধারার পরের সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। সঞ্জয় দত্তের পুরষ্কার জয়ী অভিনয়ের সাথে গল্প বলার ধরনের কারনে ‘বাস্তব’ নামের সিনেমাটি হয়ে উঠে আরো একটি অগ্রযাত্রা। এরপর অনুরাগ কাশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ (২০০৪) ছিল ভার্মার সিনেয়ার তথ্যচিত্রের একটি সম্প্রসারণ। বিশাল ভরদ্বাজের ‘মকবুল’ (২০০৩) সিনেমাটিতে সাথে উক্ত হয়েছিলো কিছু কবিতা। তারপর ‘কোম্পানি’ (২০০২) এবং ‘সরকার’ (২০০৫) দিয়ে ভার্মা আবারো নিজের ঘরানায় ফিরে আসেন। পরের কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে ক্রাইম ফিল্ম আসতে থাকে, যার মধ্যে অনেকগুলিই ভার্মার নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে নির্মিত হয়েছিলো।

প্রথম শতকে গ্যাংস্টার সিনেমাগুলো নতুন এক রাস্তায় হাঁটলেও ২০০০ সালের দিকে এসে আবারো কিছুটা পুড়নো ঘরনায় ফিরতে শুরু করে। বলিউডে গ্যাংস্টার সিনেমার নতুন ধারার ক্ষেত্রে রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ প্রভাবক হিসেবে কাজ করলেও সেটা পূর্নতা পায় ‘কোম্পানি’ সিনেমার মাধ্যমে। দাউদ ইব্রাহিম এবং ছোটা রাজনের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে নির্মিত হয়েছিলো ‘কোম্পানি’। কিন্তু পরবর্তিতে ডি (২০০৫), শুটআউট এট লোখান্ডওয়ালা (২০০৭) এবং ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই (২০১০) সিনেমাগুলো দিওয়ার (১৯৭৫) এবং ধর্মাত্ম (১৯৭৫) সিনেমাগুলোর পথে হাঁটতে থাকে।

এরপর বলিউডে গ্যাংস্টার ভিত্তিক সিনেমার ধারাপাতে দেখা গেছে নতুন মোড়। রাজনৈতিক গল্পে ‘সরকার’ এবং সাহিত্য নির্ভর ‘মকবুল’ সিনেমাগুলোর তারই ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া এই গ্যাংস্টার ধারার সিনেমায় দেখা গেছে আরো কিছু ধারা। নির্মিত হয়েছে রোম্যান্টিক গ্যাংস্টার ড্রামা (গ্যাংস্টার, ২০০৬), এমনকি কমেডি নির্ভর (মুন্নাভাই এমবিবিএস, ২০০৩)। সময়ের ধারাবাহিকতায় গ্যাংস্টার সিনেমাগুলো শহুরে গল্প থেকে ছড়িয়ে গেছে গ্রাম্য এলাকায়। গ্রামে গ্যাংস্টারদের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওমকারা (২০০৬), রক্ত চরিত্র (২০১০) এবং গ্যংস অব ওয়াসিপুর (২০১২)। বলিউডের দর্শকরা পরবর্তিতে বোম্বে ভেলভেট (২০১৫) এর মত পিরিওডিক গ্যাংস্টার সিনেমা দেখেছেন।

রাম গোপাল ভার্মার ‘সত্যা’ সিনেমাটি বলিউড সিনেমাকে গভীরভাবে পরিবর্তন করেছেন, কিন্তু সেটা তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে যারা এতে কাজ করেছেন, এর সাফল্য থেকে উপকৃত হয়েছেন এবং নিজেরাই বলিউড সিনেমাকে পরিবর্তন করেছেন। অনুরাগ কাশ্যপ এক ডজন ফিচার পরিচালনা করেছেন এবং উপহার দিয়েছেন ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ এর মত গত দশকের সেরা হিন্দি ছবি। সৌরভ শুক্লা দেশের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড চরিত্র অভিনেতাদের একজন। ‘মকবুল’, ‘ওমকারা’ এবং ‘হায়দার’ (২০১৪) দিয়ে শেক্সপিয়ার ট্রিলজি দিয়ে বিশাল ভরদ্বাজ ভারতীয় সিনেমায় একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করেছিলেন। অপূর্ব আসরানি লিখেছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শহীদ (২০১২) এবং আলিগড় (২০১৫) এর মত সিনেমা। মনোজ বাজপেয়ী ‘সত্যা’ এবং ‘শূল’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক প্রজন্মের অভিনেতাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন এবং অন্য প্রজন্মকে ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ সিনেমার মাধ্যমে।

নিজের স্থানীয় ভাষা তেলেগুতে সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে শুরু করা ভার্মা তার ‘সত্যা’ দিয়ে বলিউডে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। ‘রঙ্গিলা’ একটি বড় হিট ছিল, কিন্তু এর সাফল্যের কৃতিত্ব দাবীদার হয়ে উঠে আমির খান, উর্মিলা মাতোন্ডকর এবং এ.আর. রহমানের সঙ্গীত। কিন্তু ‘সত্যা’ ছিল রাম গোপাল ভার্মার সিনেমা। সিনেমাটি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে তিনি তারকা ছাড়াই একটি সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন। একটি স্লিপার হিট দেওয়ার পরে, তিনি বলিউডে সেটা কাজে লাগাতে পারতেন, খান এবং কাপুরদের নিয়ে সিনেমা করতে পারতেন। কিন্তু পরিবর্তে সে পথে না হেঁটে তিনি নতুন প্রতিভা উপর বিশ্বাস রেখে নিয়মিত বাজী খেলতে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে রাম গোপাল ভার্মা নিজের অবস্থান ধরে রাখতে না পারলেও তার ওমর সৃষ্টি ‘সত্যা’ বলিউডে গ্যাংস্টার সিনেমার ধারা বদলের উপ্যাখ্যান হয়েই থাকবে।

আরো পড়ুনঃ
হলিউডের যে সিনেমাগুলো বলিউড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছিলো
সত্যম শিবম সুন্দরম: কালের প্রবাহে যৌনতা থেকে শৈল্পিক সিনেমার উদাহরণ
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সোনালী সময়ের সিনেমার গল্পঃ রায়হান মুজিবের ‘আত্ন অহংকার’

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d