শাহরুখ খানের এক দশক: ‘সুপার হিরো’ থেকে ‘জিরো’ (প্রথম পর্ব)

শাহরুখ খানের এক দশক

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকটা (২০০১ থেকে ২০১০) শাহরুখ খানের দখলেই ছিলো বলা যায়। ২০০৮ সালের শেষে এসে ‘গজিনী’ দিয়ে আমির খান এবং ২০১০ এ এসে ‘দাবাং’ দিয়ে সালমান খানের বলিউড বক্স-অফিসে উত্তানের আগে পর্যন্ত শাহরুখ খানের দখলেই ছিলো বলিউড বক্স-অফিস। আর ওই দশক শাহরুখ শেষ করেছিলেন কারন জোহর পরিচালিত ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমা দিয়ে। আইপিএল এ পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেয়ার পক্ষে কথা বলার কারনে ওই সময়ে শিব সেনাদের তোপের মুখে সিনেমাটি। শিব সেনাদের প্রতিরোধ এবং বিক্ষোভের কারনে সিনেমাটির প্রদর্শন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে বক্স-অফিসে আশানুরূপ ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয় সিনেমাটি। ভারতীয় বক্স-অফিসে ৭৩ কোটি রুপি আয় করে হিট (বক্স অফিস ইন্ডিয়া) সিনেমার  তকমা পায় ‘মাই নেম ইজ খান’। শুধু তাই নয় ওই বছর এই সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতার পুরষ্কারও জেতেন শাহরুখ খান। চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক বলিউডে শাহরুখ খানের এক দশক এবং তার বিস্তারিত।

একবিংশ শতকের প্রথম দশক পুরষ্কার জয়ের মাধ্যমে শেষ করা শাহরুখ খান নতুন দশক (২০১১ থেকে ২০২০) শুরু করেন নতুন অঙ্গীকার নিয়ে। সেই অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে ২০১১ সালে শাহরুখ খান ঘোষনা দেন দুইটি সিনেমার। এরমধ্যে আছে শাহরুখ খানের সবচেয়ে স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘রা ওয়ান’ এবং ফারহান আকতার পরিচালিত ‘ডন ২’। সিনেমা দুটি মুক্তির জন্য শাহরুখ খান বছরের সবচেয়ে বড় তিনটি উৎসবের মধ্যে দুইটি বেছে নেন। দিওয়ালি উপলক্ষে মুক্তি পায় তার প্রযোজনায় সুপার হিরো ভিত্তিক সাইন্স ফিকশন সিনেমা ‘রা ওয়ান’ আর ক্রিসমাস উপলক্ষে মুক্তি পায় ‘ডন ২’। দিওয়ালির উৎসব, বলিউডের সবচেয়ে বড় সুপারস্টারের বিগ বাজেটের সাইন্স-ফিকশন সিনেমা, বছরজুড়ে প্রচারনা, প্রিভিউতে সমালোচদের প্রশংসা সবমিলিয়ে ‘রা ওয়ান’ এর প্রতি প্রত্যাশা আকাশচুম্বী!

এই অবস্থায় মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি বক্স-অফিসে করে বাম্পার শুরু। কিন্তু মুক্তির ৩/৪ দিনের মাথায় ধূসর হতে থাকে সিনেমাটি নিয়ে প্রত্যাশার স্ফুলিঙ্গ। দর্শকদের মন জয় করতে ব্যর্থ সিনেমাটি নিয়ে টুইটার জুড়ে শুরু হয় হাসাহাসি আর মিম তৈরির হিড়িক। সবকিছু মিলিয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহেই বক্স-অফিসে মুখ থুবড়ে পরে সিনেমাটি। প্রথম সপ্তাহের বাম্পার ব্যবসার সুবাদে শেষ পর্যন্ত ১১৪ কোটি রুপি আয় করে বক্স অফিসে হিট সিনেমার তকমা পায় ‘রা ওয়ান’। তবে এই আয় কোনভাবেই সিনেমাটির প্রতি প্রত্যাশার প্রতিফলন ছিল না। সিনেমাটির প্রতি শাহরুখ খানের আবেগ এত প্রকট ছিল যে, টুইটারে ‘রা ওয়ান’ নিয়ে মজা করার কারনে একটি পার্টিতে শিরিষ কুন্দর (ফারাহ খানের স্বামী) – কে প্রকাশ্যে থাপ্পড় মেরে বসেন বলিউডের কিং খান।

শাহরুখ খানের এক দশক

এরপর ওই বছরের ক্রিসমাসে মুক্তি পায় ফারহান আকতার পরিচালিত সিনেমা ‘ডন ২’। অমিতাভ বচ্চনের ‘ডন’ সিনেমার রিমেকে ক্লাইমেক্সে এসে সিনেমার গল্প ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন পরিচালক ফারহান আকতার। তারই ধারাবাহিকতায় ‘ডন’ ফ্রাঞ্চাইজিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান ‘ডন ২’ সিনেমার মাধ্যমে। সমালোচকদের প্রশংসা নিয়ে ক্রিসমাসের সময়ে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি ১০৬ কোটি রুপি আয় করে এবং ‘রা ওয়ান’ এর মত এই সিনেমাটিও বক্স অফিসে হিট তকমা পায়। তবে ফারহান আকতারের অসাধারন নির্মানশৈলীর পাশাপাশি দুর্দান্ত সংলাপে ভরপুর সিনেমাটি প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয়। অনেকেই মনে করেন ‘রা ওয়ান’ সিনেমার নেগেটিভ প্রভাবের কারনে ‘ডন ২’ সিনেমা হলে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও নতুন দশকের শুরুটা দুইটা হিট সিনেমা দিয়ে করেছিলেন বলিউড বাদশা। আর উল্লেখ্য যে, ‘রা ওয়ান’ সিনেমার স্পেশাল ইফেক্টের জন্য জাতীয় পুরস্কার সহ ওই বছরের সবকটি পুরস্কার জিতে তার প্রতিষ্ঠান রেড চিলিস ভিএফএক্স।

২০১১ সালে দুইটি অ্যাকশন সিনেমার পর ২০১২ সালে শাহরুখ খান আবার ফিরে আসেন তার স্বাছন্দ্যের রোম্যান্টিক সিনেমায়। এই বছরের দিওয়ালিতে মুক্তি যশ রাজ ফিল্মসের ইয়াশ চোপড়া পরিচালিত সিনেমা ‘যাব তাকে হ্যা জান’। লম্বা সময় বিরতি দিয়ে যশ চোপড়ার পরিচালনা, এ আর রহমানের সংগীত, সময়ের জনপ্রিয় দুই নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফ এবং আনুশকা শর্মা, দিওয়ালিতে মুক্তি – স্মরণীয় হয়ে থাকার মোট যথেষ্ট উপলক্ষ্য ছিল সিনেমাটির কাছে। কিন্তু মুক্তির আগে একই দিনে অজয় দেবগন অভিনীত ‘সন অফ সর্দার’ সিনেমার মুক্তি নিয়ে জল ঘোলা হয়ে উঠে। যশ রাজ ফিল্মসের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে আদালতে মামলা পর্যন্ত করেন অজয় দেবগন। ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযারী জানা গিয়েছিলো যে ”যাব তাকে হ্যা জান’ সিনেমাটির প্রেক্ষাগৃহ নিশ্চিত করার জন্য সালমান খানের ‘এক থা টাইগার’ এবং আমির খানের ‘ধুম ৩’ সিনেমার সাথে এটাকে বান্ডেল করে চুক্তির চেষ্টা করেছিল যশ রাজ ফিল্মস।

অন্যদিকে সিনেমাটি মুক্তির কিছুদিন আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই সিনেমার কিংবদন্তী পরিচালক যশ চোপড়া। যাইহোক, এতকিছুর পরও শেষ পর্যন্ত সমান সমান প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিলো সিনেমা দুটি। কিন্তু আগের দুইটি সিনেমার মোট এই সিনেমাও মুক্তির পর দর্শকদের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূর্ন করতে পারেনি। বক্স অফিসে মাত্র ১০২ কোটি রুপির ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। শাহরুখ খানের সিনেমার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে যে বিস্তর ফারাক তৈরী হচ্ছে সেটা আরো একবার দৃশ্যমান হতে থাকে সবার কাছে। কারন ইতিমধ্যে ১০০ কোটি রুপি বলিউডে সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপেক্ষাকৃত অনেক কম জনপ্রিয় তারকাদের সিনেমা নিয়মিত ১০০ কোটি রুপি আয় করছে, তাই স্বভাবতই শাহরুখ খানের মত তারকার সিনেমার প্রতি প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল।

সাধারনত ঈদের উৎসবকে উপলক্ষ্য সিনেমা মুক্তি দিয়ে থাকেন বলিউডের ভাইজান সালমান খান। কিন্তু ২০১৩ সালে সালমান খানের কোন সিনেমা না থাকার কারনে ঈদে নিজের সিনেমা মুক্তির ঘোষনা দেন শাহরুখ খান। ২০১৩ সালের ঈদে মুক্তি পায় রোহিত শেঠি পরিচালিত রোম-কোম সিনেমা ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’। প্রিভিউ থেকেই প্রশংসায় ভাসতে থাকে সিনেমাটি, ফলশ্রুতিতে ঈদের লম্বা ইউকেন্ডে বাম্পার ব্যবসা করে রেকর্ড করে সিনেমাটি। রোহিত শেঠীর বানিজ্যিক সিনেমার ফর্মুলা, দীপিকা পাডুকোনের সাথে শাহরুখ খানের পর্দা রসায়ন – সব মিলিয়ে আরো একবার বক্স-অফিসে নিজের ঝলক দেখান কিং খান।  ২০০৯ সালের আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার ২০২ কোটি রুপির রেকর্ড ভেঙে বলিউডের সবচেয়ে বেশি আয়ের সিনেমা হয় ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’। যদিও বেশি স্থায়ী হয়নি এই রেকর্ড, কয়েক মাসের ব্যবধানে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ এর রেকর্ড ভঙ্গ করে সবচেয়ে বেশি আয়ের সিনেমার রেকর্ড করে আমির খানের ‘ধুম ৩’। তবুও রোহিত শেঠীর হাত ধরে ২০১৩ সালকে নিজের সৌভাগ্যের বছরে পরিণত করেন বলিউড বাদশা।

‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ সিনেমার মাধ্যমে ২০০৮ সালের ‘রাব নে বানাদি জোড়ি’ সিনেমার পর ২০১৩ সালে শাহরুখ খান পেলেন ব্লকবাষ্টার সিনেমার স্বাদ। তবে বানিজ্যিক সফলতা পেলেও সিনেমাটির মান নিয়ে প্রশ্নই থেকে গেছে, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে বক্স অফিসে সফলতাই মুখ্য হয়ে উঠে সবার কাছে। একটি সফল বছর শেষ করে শাহরুখ খান ২০১৪ সালে শাহরুখ খান হাত মেলান তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু ফারাহ খানের সাথে। এই বছর মুক্তি পায় ফারাহ খান অভিনীত তারকাবহুল সিনেমা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। ২০০৭ সালের বর্ষসেরা সিনেমা ‘ওম শান্তি ওম’ সিনেমার পর আরো একবার একসাথে ফারাহ-শাহরুখ-দীপিকা ত্রয়ীর সিনেমা। ২০১৪ সালের শাহরুখ খানের প্রিয় উৎসব দিওয়ালিতে মুক্তি পাওয়ার আগে বেশ আলোচনার জন্ম দেয় সিনেমাটি।

মুক্তির পর প্রথম দিন রেকর্ড  পরিমান আয় করে সিনেমাটি। তবে আগের সিনেমাগুলোর মত এই সিনেমা ভালো গল্পের অভাবের কারনে সমালোচিত হয়। প্রথম সপ্তাহে ভালো ব্যবসা করলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রত্যাশা অনুযায়ী দর্শক টানতে ব্যর্থ হয় শাহরুখ খানের নতুন এই সিনেমা। ফলশ্রুতিতে, বক্স অফিসে ১৭৮ কোটি রুপি আয়ের মাধ্যমে সুপার হিট হয় সিনেমাটি। অন্যদিকে সিনেমার মান নিয়ে সমালোচনাতো ছিলই, কিন্তু শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা আর স্টারডামের উপর ভোর করে বানিজ্যিকভাবে উৎরে যেতে সক্ষম হয় ফারাহ খান পরিচালিত এই সিনেমা। দর্শক এবং সমালোচকদের কাছ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া সিনেমাটিই ছিলো মূলত এই দশকে বলিউড বাদশার শেষ ক্লিন হিট। বলিউডে রাজকীয় ক্যারিয়ারে শাহরুখ খানের পরের গল্পটা শাহরুখ খান এবং তার ভক্তদের জন্য হতাশার ছিলো।

আরো পড়ুনঃ
বলিউডের তিন খানের দুই দশকঃ অভিনেতা ও সুপারস্টার আমির খান (প্রথম পর্ব)
বলিউডের তিন খানের দুই দশকঃ অভিনেতা ও সুপারস্টার আমির খান (দ্বিতীয় পর্ব)

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d