বয়কট প্রচারণা কি আসলেই সিনেমার বক্স অফিস সংগ্রহকে প্রভাবিত করছে?

বয়কট প্রচারণা

বয়কট প্রচারণা

বলিউডের সিনেমার জন্য চলতি বছরটি একটি কালো অধ্যায় হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে রোহিত শেঠি পরিচালিত ‘সুরিয়াবংশী’ সিনেমার মাধ্যমে মহামারী পরবর্তি বলিউডের মুক্তি ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিলো। সিনেমাটির মুক্তিকে কেন্দ্র করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন বলিউড নির্মাতারা। মুক্তির পর সিনেমাটির বক্স অফিসে সাফল্য নতুন করে আশার আলো দেখায় বলিউডকে। বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে মুক্তি দিতে থাকে তাদের সিনেমা। নতুন সিনেমার মুক্তির তারিখ ঘোষণায় মুখরিত হয়ে উঠে বলিউড।

কিন্তু সেই আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসের ছন্দপতন হতে বেশী সময় লাগে নি। মুক্তির পর বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরতে থাকে বড় বাজেটের সব সিনেমা। কবির খানের পরিচালনায় রনভির সিং অভিনীত ‘৮৩’ সিনেমাটির ডিজাস্টার দিয়ে ২০২১ সাল শেষ করা বলিউড নতুন বছরে মুখোমুখি হয় আরো কঠিন বাস্তবতার। যদিও বছরের শুরুতে সঞ্জয়লীলা বানসালি পরিচালিত ‘গাঙ্গুবাই কাঠিওয়ারি’ সিনেমাটি বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করে, বছরে প্রথম দিন মাসেই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরে ‘বচ্চন পাণ্ডে’, ‘রানওয়ে ৩৪’, ‘জার্সি’, ‘হিরোপান্তি’ এরমত আলোচিত সিনেমাগুলো।

তবে এই সময়ে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি অপ্রত্যাশিতভাবে বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার হিসেবে আবির্ভুত হয়। কিন্তু এই সিনেমাটির সাফল্য স্বাভাবিক বক্স অফিসে হিসেবে বিবেচনা করাটা অযৌক্তিক হবে। কারন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি বক্স অফিসে এত আয়ের পিছনে ভারতের সরকারী দলে রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশী কাজ করেছে। ভারতজুড়ে সিনেমাটির ট্যাক্স মওকুফ থেকে শুরু করে সরকারী নেতাদের টিকেট কিনে সবাইকে দেয়া সিনেমাটির বক্স অফিস সাফল্যকে অনেক প্রভাবিত করেছে।

চলতি বছরে বলিউডের সিনেমার বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরার সাথে বয়কট প্রচারণা বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে বার বার। নতুন কোন সিনেমা মুক্তির ঘোষণা আসলে বা মুক্তির সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দর্শকদের একটি অংশকে সিনেমাটি বয়কটের ডাক দিতে দেখা গেছে। অতীতের বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সিনেমাটির মূল তারকাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন অনেকে। আর যখন কোন তারকার বিরুদ্ধে কোন ইস্যু না পাওয়া যায়, তখম সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুকে টেনে পুরো বলিউডকে বয়কটের ডাক দেন তারা।

সর্বশেষ ১১ই আগস্ট মুক্তিপ্রাপ্ত আমির খান অভিনীত ‘লাল সিং চাড্ডা’ এবং অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘রক্ষা বন্ধন’ সিনেমাগুলো ডিজাস্টার হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে অক্ষয় কুমার বা ‘রক্ষা বন্ধন’ সিনেমার বিরুদ্ধে বয়কট প্রচারণা এতোটা জোরালো না হলেও সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরেছে। সেই প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন নির্দিষ্ট পর্যালচনার দাবী রাখে। বয়কট প্রচারণা কি আসলেই বলিউডের সিনেমাগুলোর বক্স অফিস সংগ্রহকে প্রভাবিত করছে? এ প্রসঙ্গে অনেকেই নিজেদের মত করে চিন্তা করছেন।

বয়কট প্রচারণা যদি আসলেই সিনেমাগুলো বক্স অফিসকে প্রভাবিত করত, তাহলে আলিয়া ভাটের ‘গাঙ্গুবাই কাঠিওয়ারি’ ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হত না। কারন বয়কট ডাকের অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে বলিউডের স্বজনপ্রীতি। সে ক্ষেত্রে আলিয়া ভাটের সিনেমাটি সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হওয়ার কথা ছিলো, অতচ বাস্তবতা পুরপুরি ভিন্ন। এছাড়া বয়কট ডাক ছিলো না অক্ষয় কুমারের ‘বচ্চন পাণ্ডে’, ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’ এবং ‘রক্ষা বন্ধন’ সিনেমাগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরও সিনেয়ামগুলো বক্স অফিসে ডিজাস্টার হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে।

বয়কটের কারনে সিনেমাগুলোর বক্স অফিস সংগ্রহে প্রভাব প্রসঙ্গে বলিউডের ট্রেড বিশেষজ্ঞ এবং চলচ্চিত্র সমালোচক তারন আদর্শ বলেন, ‘বয়কট প্রচারণার কিছুটা প্রভাবতো অবশ্যই আছে। এটা আমাদের মেনে নেয়া উচিৎ। এমনকি আমির খানও বিষয়টি বিবেচনা করেছেন। তিনি এর প্রভাব অনুভব করেছিলেন তাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।‘ তবে একটি সিনেমার বিষয়বস্তু যদি ভালো হয় তাহলে বয়কটও সে সিনেমা দেখতে দর্শকদের আটকে রাখতে পারবে না বলে মনে করছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘যেকোন সিনেমা যদি বিষয়বস্তুর দিক থেকে ভালো হয় তাহলে বয়কট, পরীক্ষা, আইপিএল, খারাপ আবহাওয়া বা অন্য কোন প্রতিকূলতার বিপরীতে দাড়িয়ে থাকতে পারে। লাল সিং চাড্ডা সিনেমাটি বিষয়বস্তুর দিক থেকে দুর্বল ছিলো। এছাড়া একজন প্রথমসারির তারকা যখন সিনেমা নির্মান করেন সেটা সব শ্রেণির দর্শকদের জন্য নির্মান করা উচিৎ। বড় বাজেটের সিনেমা শুধু মাল্টিপ্লেক্স দর্শকদের জন্য নির্মান করাটা অযৌক্তিক। লাল সিং চাড্ডা সিনেমাটি বড় বাজেটে নির্মিত হয়েছিলো কিন্তু সব দর্শকের কথা মাথায় রেখে নির্মান করা হয়নি।‘

তবে তারন আদর্শের কথার বিপক্ষেও মত দিয়েছেন অনেকে। বলিউডের ট্রেড বিশেষজ্ঞ অতুল মোহান বলেন, ‘বয়কট প্রচারণার কোন প্রভাব আছে বলে আমি মনে করিনা। সেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়কটের ডাক দেয়া হচ্ছে তার কি কোন প্রভাব আদৌ আছে? লাল সিং চাড্ডা সিনেমাটি শুরুটাও ভালো করতে পারেনি।‘ সিনেমায় আকর্ষনিয় বিষয়বস্তু না থাকার কারনেই সিনেমাগুলো বক্স অফিসে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন তিনি।

একই মতামত দিয়েছেন প্রযোজক এবং ব্যবসায়িক পর্যালোচক গিরীশ জোহর। তিনি বলেন, ‘বয়কটকে আমি কারন বলে বিশ্বাস করি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুবই ছোট একটি অংশ যা সিনেমার সংগ্রহকে প্রবাভিত করার ক্ষমতা রাখে। সিনেমার শুরুটা কখনোই মানুষের মুখের কথার উপর নির্ভর করেনা। আমির খানের ‘থাগ অফ হিন্দুস্থান’ সিনেমাটি নিয়েও দর্শকদের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো, কিন্তু সিনেমাটি প্রথম দিন বক্স অফিসে রেকর্ড পরিমাণ আয় করেছিলো। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আমরা কোন সিনেমার ভালো শুরু দেখতে পাইনি।‘

এছাড়া বয়কটের ডাক বলিউডে এই প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকটি সিনেমার বিরুদ্ধে বয়কটের প্রচারণা দেখা গেছে। কিন্তু মুক্তির পর সেই সিনেমাগুলো বক্স অফিসে রীতিমত ঝড় তুলে। ‘পিকে’, ‘দাঙ্গাল’, ‘পদ্মাবত’ সিনেমাগুলো এই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। সাম্প্রতিক সিনেমাগুলো ব্যবসায়িক ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে এই সিনেমাগুলোর মহামারীর আগের। কিন্তু মহামারীর পর সিনেমার ক্ষেত্রে দর্শকদের রুচির বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া শুধু বলিউডে নয় চলতি বছরে দক্ষিণের সিনেমাগুলোও ব্যবসায়িকভাবে সুবিধা করতে পারছে না।

২০২২ সালে যে সিনেমাগুলো বক্স অফিসে ভালো করেছে সেগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ইভেন্ট সিনেমা ছিলো। ‘বাহুবলী’ সিরিজের পর রাজামৌলীর নতুন সিনেমা নিয়ে দর্শকদের অপেক্ষা অনেকদিনের। সিনেমাটি নিয়ে সবার আগ্রহ ছিলো আকাশচুম্বী। অন্যদিকে ‘কেজিএফ’ সিনেমার বিশাল সাফল্যের পর ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ২’ নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ ছিলো অনেক। বক্স অফিসে ব্যর্থ সিনেমাগুলো সবচেয়ে বড় কারন হিসেবে গল্প এবং বিষয়বস্তুর দূর্বলতাই বেশী দায়ী।

এদিকে সামনে মুক্তি অপেক্ষায় রয়েছে আরো কয়েকটি বড় বাজেটের সিনেমা। ধারাবাহিকভাবে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’, ‘বিক্রম ভেধা’, ‘রাম সেতু’, ‘ভাইজান’, ‘পাঠান’ এবং ‘টাইগার ৩’ সিনেমাগুলো। সন্দেহাতীতভাবেই এই প্রতিটি সিনেমা বয়কট প্রচারণা মোকাবেলা করতে যাচ্ছে। এই সিনেমাগুলোর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়কট প্রচারণা শুরু করেছেন দর্শকদের একটি অংশ। মুক্তির পর সিনেমাগুলো বয়কট প্রচারণার কারনে প্রভাবিত হয় নাকি বিষয়বস্তুর জোরে সব বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় সেটা সময়ই বলে দিবে।

আরো পড়ুনঃ
একাধিক ফ্লপের পর বক্স অফিসে হিট সিনেমার জন্য মরিয়া যে সুপারস্টাররা
৬ মাসে ৬ ডিজাস্টার: বলিউড বক্স অফিসে সিনেমা প্রতি ক্ষতি ১০০ কোটির বেশী!
‘বয়কট’ ডাক সত্ত্বেও বক্স অফিসে হিট হওয়া বলিউডের ৬টি সিনেমা

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d