সিল্ক স্মিতা: পরিচারিকা থেকে ‘বোল্ড’ ছবির আইকন এবং রহস্যময় মৃত্যু

সিল্ক স্মিতা

সিল্ক স্মিতা

২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছিলো ‘দ্য ডার্টি পিকচার’, যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিদ্যা বালন, নাসিরউদ্দিন শাহ, ইমরান হাশমি এবং তুষার কাপুর সহ আরো অনেকে। সিনেমাটি বক্স অফিসে সফলতার পাশাপাশি সমালোচকদেরও প্রশংসা কুঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। এছাড়া সিনেমাটিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন বিদ্যা বালন। সিনেমাটিতে বিদ্যা বালন অভিনয় করেছিলেন বিতর্কিত অভিনেত্রী সিল্ক স্মিতার চরিত্রে। চেন্নাইয়ে একজন অভিনেত্রীর পরিচারিকা থেকে ‘বোল্ড’ ছবির আইকন হয়ে উঠার জন্য সিল্ক স্মিতা বিখ্যাত। তার মৃত্যুটাও ছিলো বিতর্কিত। পুলিশের তদন্তে সিল্ক স্মিতার মৃত্যুটি নিছক আত্নহত্যা হিসেবে বিবেচিত হলেও, তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য আজো রয়ে গেছে। পরিচারিকা থেকে ‘বোল্ড’ ছবির আইকন হয়ে উঠা সেই আলোচিত বা সমালোচিত সিল্ক স্মিতাকে নিয়ে কিছু কথা বলবো আজকের এই লিখায়।

আসল নাম বিজয়লক্ষ্মী, তাঁর এই নামটা মনে রাখেননি প্রায় কেউই। সকলের কাছে তিনি সিল্ক স্মিতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৬০ সালের ২ ডিসেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের ইলোরুতে এক তেলুগু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। টাকার অভাবে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ছাড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর। অথচ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা জানা সিল্ক পরবর্তী কালে ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলতেন। আকর্ষণীয় চেহারা হওয়ায় বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেদের কাছ থেকে কুপ্রস্তাব পেতে শুরু করেছিলেন। তাঁকে সচরাচর বাড়ি থেকে বেরতে দিতেন না তার মা। দরিদ্র মা-বাবা তাই সিল্কের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেবেন ঠিক করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে এক গরুর গাড়ির চালকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার সেই বিবাহিত জীবন ছিল আরও দুঃসহ। বিয়ের পর থেকে তাঁর উপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। সে সব মানতে না পেরে একসময় বাড়ি থেকে পালিয়ে চেন্নাই চলে আসেন সিল্ক স্মিতা। ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ সিনেমায় বিদ্যা বালন এই সবদৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন দুর্দান্ত ভাবেই। বাড়ি থেকে পালিয়ে চেন্নাইয়ে এক অভিনেত্রীর বাড়িতে প্রথম পরিচারিকার কাজ পান তিনি। তিনি ওই অভিনেত্রীর মেকআপে সাহায্য করতেন। এক দিন ওই অভিনেত্রীর বাড়িতে এক পরিচালক আসেন। সিল্ক স্মিতা তাঁর বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। এ নিয়ে অভিনেত্রী তাঁকে ব্যঙ্গ করেছিলেন। সিল্কও প্রত্যুত্তরে জানিয়ে দেন, এক দিন এ রকমই বড় গাড়ি চেপে তিনি যাবেন। আর সেই গাড়িটা তাঁর নিজের হবে। এর পরই নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার জেদ চেপে যায় তাঁর।

সিল্ক স্মিতা

সিনেমার পর্দায় সিল্ক স্মিতার যাত্রা শুরু হয়েছিলো একটি মালয়ালম ফিল্মে ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন পরিচালক বিনু চক্রবর্তী যিনি পরবর্তিতে সিল্কের মেন্টর হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। কী ভাবে কথা বলতে হয়, কী ভাবে চলতে হয়, সব কিছু বিনু এবং তাঁর স্ত্রী নিজে হাতে সিল্ককে শিখিয়েছিলেন। তাঁদের কাছেই সিল্ক স্মিতা ইংরেজিতে কথা বলতে শেখেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সিল্কের শরীরী ভাষা একেবারে বদলে যায়। ১৯৮০-র তামিল ছবি ‘বন্দিচক্করম’ ছিল তাঁর প্রথম সিনেমা, যেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ফিল্মে তিনি এক জন বার গার্ল হয়েছিলেন আর তাঁর চরিত্রের নাম হয়েছিল ‘সিল্ক’। সেই থেকেই বিজয়লক্ষ্মী হয়ে উঠেন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘বোল্ড’ শব্দের প্রায় সমার্থক ‘সিল্ক স্মিতা’।

নিজের অভিনয় দিয়ে সিল্ক এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, কোনও ফিল্মে তাঁর একটি আইটেম ড্যান্স যুক্ত হরে দিলেই সেই সিনেমা হিট হয়ে যেত। তবে তাঁর ভক্তের সংখ্যা যতটা ছিল, তাঁর বন্ধুর সংখ্যা ততটাই কম ছিল। কম কথা বলা সিল্কের হাতেগোনা কয়েক জন বন্ধু ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, সিল্ক ছিলেন শিশুর মতো নরম মনের মানুষ। পর্দায় যতটাই সাহসী হিসাবে তুলে ধরা হত তাঁকে, বাস্তবে তিনি ছিলেন ঠিক তার উল্টো। অত্যন্ত দায়িত্বশীল, নরম হৃদয় এবং শিশুসুলভ এক জন মানুষ ছিলেন তিনি। ছোট থেকেই তাঁর জীবন ছিল কষ্টে ভরা কিন্তু নিজের সাথে লড়াই করে প্রচুর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই  ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন সিল্ক স্মিতা। সে সময়ে ভারতের প্রেক্ষাগৃহগুলোর সামনে ম্যাটিনি বা ইভনিং শো যেমন জটলা বানাতে পারত, নুন শো তেমনটি পারত না। কারণ, ওই সিল্ক স্মিতা নামক রহস্য, যা সামাজিকতার বাইরে এক ‘অন্য’ বলয়, যেখানে ‘জটলা’ হয় না। হওয়াটা সমীচীন না!

১৯৯৬ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ক্যারিয়ারের চূড়ায় থাকা অবস্থায়ই রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁর। চেন্নাইয়ে নিজের বাড়িতে থেকে উদ্ধার হয়েছিল তাঁর ঝুলন্ত দেহ। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পুর্ণ যৌবনেই তিনি বিদায় নেন নুন শো’র আলোছায়া থেকে। জানা গেছে, মৃত্যুর আগে তাঁর এক বন্ধুকে ফোন করে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন সিল্ক। কিন্তু তাঁর বন্ধু যতক্ষণে পৌঁছন, ততক্ষণে সিল্কের মৃত্যু হয়েছিল। ময়নাতদন্তে তাঁর শরীরে প্রচুর অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছিল বলে জানিয়েছিলো পুলিশ আর বলেছিলো তিনি আত্মঘাতী হয়েছিলেন। যদিও এই সিল্কের আত্নহত্যার বিষয়টি মেনে নেননি অনেকেই। মৃত্যুর এত বছর পর আজও সিল্কের জীবনের মত তার মৃত্যুও রয়ে গেছে রহস্যময়! অসমাপ্ত কিছু পাণ্ডুলিপির মত সিল্ক স্মিতা রয়ে গেছেন একটি দীর্ঘশ্বাস হয়ে।

আরো পড়ুনঃ
লেডি সুপারস্টার নয়নতারা: পুরুষ শাসিত তামিল সিনেমায় নারী স্টারডাম!
সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে প্রভাবিত করা আনুশকা শেঠি অভিনীত ৬টি শক্তিশালী চরিত্র
নাম তার শাবানা: রত্না থেকে বাংলা সিনেমার একজন কিংবদন্তি হয়ে উঠার গল্প

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d