প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়: বুম্বাদা থেকে যেভাবে টলিউডের ‘মিস্টার ইন্ডাস্ট্রি’

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়

সৃজিত মুখার্জী পরিচালিত ‘অটোগ্রাফ’ সিনেমায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে একটা সংলাপ বলতে শুনেছিলাম আমরা। সুপারস্টারের চরিত্রে অভিনয় করা সে সিনেমায় ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করতে তিনি বলেছিলেন ‘আমিই ইন্ডাস্ট্রি!’ কলকাতা সিনেমার বাণিজ্যিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে টলিউডের বাণিজ্যিক দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে নিয়ে চলেছিলেন দেড় দশক। শিশু শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করে হয়েছেন টলিউডের অলিখিত অভিভাবক। দেড় দশক ধরে একটা ইন্ডাস্ট্রিকে একা ধরে রাখতে পারার ক্ষমতাটা অবিশ্বাস্যই বটে। ‘আমিই ইন্ডাস্ট্রি!’ দাবী করাটা সম্ভবত তার মুখেই মানায়। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় –  বুম্বাদার সিনেমার যাত্রা বিবেচনায় ইন্ডাস্ট্রি বলতে এখনও তাঁকে চেনে টলিউডে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বুম্বাদা থেকে টলিউডের ‘মিস্টার ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে গল্পের কিছু অংশ নিয়ে কথা বলবো আজকের এই লিখায়।

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যাকে সবাই বুম্বাদা বলে চেনে জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৯৬২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি কলকাতা বাংলা সিনেমার নায়ক হিসাবে শীর্ষস্থানে আছেন প্রসেনজিৎ। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন বিখ্যাত বাংলা এবং হিন্দি ছবির নায়ক বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্র। ১৯৬৮ সালে বাবা বিশ্বজিৎ পরিচালিত ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসাবে প্রথম অভিনয় করেন এই টলিউড সুপারস্টার। আর ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দুটি পাতা’ সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসাবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর চার বছর পর মুক্তি পায় এই অভিনেতার অমর সিনেমা ‘অমর সঙ্গী’। এরমধ্যে ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ সালে দুটি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন প্রসেনজিৎ, কিন্তু সিনেমা দুটি ব্যবসায়িক ভাবে ব্যার্থ হলে পরে আর কোন হিন্দি সিনেমায় দেখা যায়নি তাকে। একের পর এক বাণিজ্যিক সফল সিনেমা উপহার দিয়ে বুম্বাদা একসময় হয়ে উঠেন টলিউডের বাণিজ্যিক সিনেমার সবচেয়ে বড় ধারন এবং বাহক। গলায় গামছা দিয়ে গ্রামের মাঠে ঘাটে নাচের কিংবা মারপিটের দৃশ্য দিয়ে কলকাতা বাংলা সিনেমাকে বাণিজ্যিক সফলতার ধারায় ফিরিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। ‘মিস্টার ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে উঠার অদম্য সেই যাত্রার শুরুটাও ছিলো এই সিনেমাগুলো দিয়ে।

যে সিনেমাগুলো দিয়ে প্রযোজকদের লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত নিশ্চিত করেছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সেরকম সিনেমায় তাকে দেখা গেছে গত দশকের শুরু পর্যন্ত। ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত গড়ে ১০/১২টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যার বেশীরভাগই ছিলো ব্যবসা সফল। আর এই সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর গল্পের প্রেক্ষাপট যেমন ভিন্ন ছিলো তেমনি ছিলো তার চরিত্রের বৈচিত্র। বাংলা সিনেমার দর্শকরা ২০০৪-০৫ পর্যন্ত প্রসেনজিৎকে সেই ‘প্রতিশোধ’, ‘জবাব চাই’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘শশুড়বাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘অমরসঙ্গী’ ধরনের সিনেমার জন্য চিনত। নিজের সেই সোনালী সময়ে তিনি অভিনয় করেছেন একাধিক নায়িকার সাথে। এর মধ্যে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটি ছিলো সবচেয়ে সফল। একের পর এক সিনেমায় নিজেদের পর্দা রসায়ন দিয়ে এই জুটি মুগ্ধ করেছিলো সিনেপ্রেমীদের। সে সময়ে প্রসেনজিৎ ছাড়া ইন্ডাস্ট্রির আর কোনও অভিনেতাকে নিয়ে সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে ভাবতে হত নির্মাতাদের। যে দেড় দশক ধরে ইন্ডাস্ট্রিকে একা টেনে নিয়ে গেছেন বুম্বাদা, সে সময়ে দর্শক প্রসেনজিৎ ছাড়া আর কাউকেই তখন তেমন হিরো হিসেবে দেখত চাইতো না।

এতটুকু আলোচনার পর একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, শুধু কি তাহলে বাণিজ্যিক সিনেমায়ই সফল ছিলেন প্রসেনজিৎ? অথবা শুধু সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্যই তাকে বানিয়ে দিলো ‘মিস্টার ইন্ডাস্ট্রি’? এই প্রশ্নের সোজাঝাপ্টা উত্তর দেয়া সম্ভব। কিন্তু সেই উত্তর বা আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রসেনজিৎ অভিনীত ভিন্নধারার কিছু সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমার নায়ক হিসেবে যারা প্রসেনজিতের ছবি এঁকেছিলেন তাদেরকে সেই চিন্তায় বড় একটা ধাক্কা দেন কলকাতার প্রখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। একাধিক বার জাতীয় পুরষ্কার জয়ী এই নির্মাতা প্রসেনজিৎকে আবিষ্কার করেছিলেন এক নতুন রূপে। এরপর তিনি বাংলা সিনেমার দর্শকদের উপহার দেন অন্য এক প্রসেনজিৎ। ‘চোখের বালি’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’, ‘১৯শে এপ্রিল’, ‘দোসর’ এর মতো সিনেমায় দর্শক পেয়েছে অভিনেতা প্রসেনজিৎকে। ঋতুপর্ণ ঘোষের স্পর্শে প্রসেনজিৎ টলিউডে বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি গড়ে তোলেন নিজের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান। ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে কাজ করার পর টলিউড পেয়েছিলো এক অন্য প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। আর ঋতুপর্ণ ঘোষের পর দর্শকদের কাছে প্রসেনজিৎকে আবারো অন্যভাবে চিনিয়েছেন যে মানুষটি, তিনি হলেন গৌতম ঘোষ। গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ সিনেমার মাধ্যমে প্রসেনজিৎ তার দর্শককে চমকে দিলেন আরো একবার।

এবার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে আমার নিজের একটি মতামত নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। আমার ক্যাম্পাসের এক ছোট ভাইয়ের কাছে শুনে আমি ‘২২শে শ্রাবণ’ সিনেমাটি দেখেছিলাম। এই সিনেমাটি দেখার পর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নিয়ে আমার নিজের ধারনার যে পরিবর্তন হয়েছিলো তা অবিশ্বাস্য। সৃজিত সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত এই সিনেমায় প্রসেনজিৎকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম এক অনন্য রুপে। একটি সিনেমার শৈল্পিক দিক সম্মুনত রেখে বাণিজ্যিক উপাদান কিভাবে নিয়ে আসা যায় তা দেখিয়েছেন সৃজিত মুখার্জি। আর তার সেই স্বপ্নবাজীর সবচেয়ে বড় বাজির ঘোড়া ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ‘২২শে শ্রাবণ’ দেখার পর আমি একে একে এই নির্মাতা-অভিনেতা জুটির সিনেমাগুলো দেখা শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় ‘অটোগ্রাফ’ সিনেমায় খোঁজে পাই সেই ‘মিস্টার ইন্ডাট্রি’কে। সে সময়ে প্রসেনজিৎ একধরনের ইমেজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। বানিজ্যিক সিনেমা থেকে বিষয়বস্তু এবং চরিত্র নির্ভর সিনেমার দিকে বেশী মনোযোগ দিচ্ছিলেন। সৃজিত মুখার্জি ‘অটোগ্রাফ’ সিনেমাটি কলকাতা বাংলা দর্শকদের সামনে অন্য একর প্রসেনজিতকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর এই জুটির উপহার দিয়েছেন ‘জাতিস্মর’, ‘মিশর রহস্য’, ‘ইয়েতি অভিযান’ এবং ‘গুমনামী’ এরমত আলোচিত সিনেমা। এই প্রতিটি সিনেমায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দর্শক দেখেছেন নতুন রূপে, পূর্নতার প্রতীক হিসেবে।

এবার দেখা যাক ইন্ডাস্ট্রির অনুজ তারকাদের সাথে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সমীকরণ। এ প্রসঙ্গে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করতে চাই। প্রসেনজিৎ পরবর্তি টলিউডের অন্যতম শীর্ষ দুই তারকা জিত এবং দেব। এই দুই তারকার সাথে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সমীকরণটা কেমন তা নিয়ে আলোচনা ছিলো উক্ত প্রতিবেদনে। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জিতের সাথে প্রসেনজিতের সম্পর্কটা শীতল রয়ে গেছে আর শীতলতা জিতের তরফ থেকেই। এই দুই তারকাকে নিয়ে সিনেমা নির্মানের পরিকল্পনা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে উঠেনি। বিরসা দাশগুপ্তের ‘ওয়ান’ সিনেমায় জিতকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে ছবিতে জিত সহ-প্রযোজক হওয়ার দাবি করার কারনে সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও প্রসেনজিৎ ঘনিষ্ঠমহলে অনেক সময়েই বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রসেনজিৎ। অন্যদিকে প্রসেনজিতের ‘আমি ইন্ডাস্ট্রি’র ধারণাটি পছন্দ নয় জিতের। প্রকারান্তরে ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার জন্য ‘সিনিয়র মোস্ট’ হিসেবে প্রসেনজিৎকেই দায়ী করেন জিত। তবে দেবের সঙ্গে প্রসেনজিতের সম্পর্ক অনেক সহজ। ‘চাঁদের পাহাড়’ এবং ‘বুনোহাঁস’ সিনেমার সময় প্রসেনজিৎ দেবের প্রশংসা করেছেন। এছাড়া দেবের প্রযোজনায় ‘ককপিট’ সিনেমায় অতিথি চরিত্রেও দেখা গেছে প্রসেনজিৎকে।

বাংলা সিনেমায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের পথ চলা এখনো অব্যাহত এবং সেটা এখনো দাপুটে। কলকাতা বাংলা সিনেমায় তার এই অবদানের জন্যে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি বুম্বাদার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। ৬০ বছর বয়সেও টালিউডে বুম্বাদা সমান জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য। প্রসেনিজতের এই বৈচিত্রময় সিনেমা জীবন আজও অনুপ্রেরণা দিচ্ছে অসংখ্য নতুন তারকাদের। একজন অভিনেতার পরিচয়কে ছাপিয়ে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ইন্ডাস্ট্রি। আগামী দিনেও টলিউডের এই মহিরূহকে বাংলা সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনুপ্রেরণার হিসেবেই দেখবে। আর এটাই হোক বুম্বাদা থেকে টলিউডের ‘মিস্টার ইন্ডাস্ট্রি’ হওয়ার যাত্রায় যে পরিশ্রম এবং বিসর্জন তিনি দিয়েছেন তার প্রতিদান।

আরো পড়ুনঃ
কলকাতা বাংলা সিনেমার নতুন দিনের রুপকার সৃজিত মুখার্জির সেরা ছয় সিনেমা!

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d