সিনেমা হলো আমরা যে সমাজে বাস করি সেই সমাজের চিন্তাভাবনার প্রতিফলনের একটি মাধ্যম। এশিয়া বিশেষ করে ভারতীয় পপ সংস্কৃতি এবং এতে নারীদের চিত্রায়ন আমাদের জীবনের বাস্তবতার একটি বড় প্রতিফলন। একই সাথে সমাজে বিদ্যমান আচার-আচরণগুলিও সিনেমা নির্মানের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। তবে কিছু সিনেমা আছে যা দর্শকদের সুস্পষ্ট এবং স্টেরিওটাইপের বাইরে দেখতে সাহায্য করে। যে সিনেমাগুলো আমাদের সমাজে প্রচলিত দুর্বৃত্তায়ন তুলে ধরে এবং তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে পক্ষপাত দূর করতে সাহায্য করে। সিনেমায় পুরুষতান্ত্রিক রীতিনীতিকে শক্তিশালী এবং সূক্ষ্ম উভয় উপায়ে ভেঙে দিয়েছে বলিউডের এমন দশটি নারী কেন্দ্রিক সিনেমা নিয়ে আলোচনা থাকছে এই লিখায়।
১। দিল ধাড়কনে দো
জয়া আখতার পরিচালিত ‘দিল ধাড়কনে দো’ সিনেমাটি নারীবাদের একটি ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে নির্মিত হয়েছে। সিনেমাটিতে দেখা গেছে সানি গিল (ফারহান আখতার) আয়েশার (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) স্বামীকে শিক্ষিত করেছেন। রাহুল বোস (আয়েশার স্বামী) অনেকটা ছদ্মবেশী নারীবাদী চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং তিনি নিজেকে একজন উদারপন্থী মানুষ বলে বিশ্বাস করেন। একজন নারীকে কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ মানেই নারীবাদী নয়, বরং নারীকেই তার জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হওয়া উচিত – এই বার্তা নিয়েই নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি।
২। কি এবং কা
কারিনা কাপুর এবং অর্জুন কাপুর অভিনীত ‘কি এবং কা’ সিনেমাটি বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করতে না পারলেও অবশ্যই দর্শকদের মানসিকতা তৈরি এবং বিশ্বাসকে বদলে দিতে সফল হয়েছিল। এটি সমাজের প্রচলিত একাধিক স্টেরিওটাইপ ভাঙতে অবদান রেখেছিল। সিনেমাটিতে দেখা গেছে কিয়া (কারিনা) যখন উপার্জনকারী, কবির (অর্জুন) পারিবারিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করে থাকে। পঙ্কজ ত্রিপাঠির মতোই তিনি সাহসী একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ত্রিপাঠী যখন একজন অভিনেতা হওয়ার জন্য মুম্বাইতে সংগ্রাম করছিলেন, তখন তার স্ত্রী একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অন্যদিকে ত্রিপাঠী অভিনয়ের জন্য অডিশন দেওয়ার পাশাপাশি বাড়ির কাজ করতেন।
৩। জাব উই মেট
‘জাব উই মেট’ সিনেমায় কারিনা কাপুর অভিনীত গীত চরিত্রটি একজন মহিলার আত্মনির্ভরশীল হওয়ার এবং তার ভুল ও দায়িত্বের মালিক হওয়ার গুরুত্ব প্রদর্শন করেছিল। গীতের জীবনের ঘটনাগুলো তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেনি, এরপর সে তার পরিবার বা আদিত্য (শাহিদ কাপুর) এর কাছে ফিরে না গিয়ে নিজেকে একটি চাকরিতে মনোনিবেশ করেছিলো। সিনেমাটির মাধ্যমে নারীর স্বনির্ভরতা এবং স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন নির্মাতা।
৪। ইংলিশ ভিংলিশ
এই সিনেমাটি আমাদের শিখিয়েছে যে একজন মহিলা কখনই কিছু শিখতে সময় নেন না। একজন নারী যা চায় তার সব কিছু অর্জন করতে পারে এবং একই সাথে লাডুও তৈরি করতে পারে। সিনেমাটি দেখিয়ে দেয় যে ভাষা শ্রেষ্ঠত্বের কোন নিদর্শন নয়। শশী (প্রয়াত শ্রীদেবী) একটি নির্দিষ্ট ভাষা না জানার কারনে রসিকতার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সিনেমাটির শেষে দেখা যায় শশী ইংরেজিতে একটি অর্থপূর্ণ ভাষণ দেন এবং সেই সাথে নিজের বানানো লাডু পরিবেশন করেন। সিনেমাটির মাধ্যমে নির্মাতা দেখিয়েছেন যে ইচ্ছে থাকলে একজন নারী যেকোনো কিছু অর্জন করতে পারে।
৫। মারদানি
বলিউডে নির্মিত অন্যতম সেরা নারী কেন্দ্রিক এই সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রানী মুখার্জি। সিনেমাটিতে রানী মুখার্জি শিবানী শিবাজি রায় চরিত্রে মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে একজন নারীও একজন কঠোর পুলিশ হতে পারেন। একজন পুলিশ হিসাবে তার দক্ষতার জন্য তাকে প্রশ্ন করা হলে নিজের শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তিনি। সেই প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি তার পুরুষ সহযোগীদের থেকে একটুও কম দক্ষ নন।
৬। পিঙ্ক
অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘পিঙ্ক’ সিনেমাটি বলিউডে নির্মিত নারী কেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য। সিনেমাটিতে দীপক সেহগাল (অমিতাভ বচ্চন) সমাজে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির দ্বারা মহিলাদের জন্য তৈরি করা নিয়মবই প্রদর্শন করেন। তিনি সমাজকে ব্যাখ্যা করেন যে সম্মতি প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যদি কেউ একজন মহিলা সম্পর্কে উত্তেজক কিছু খুঁজে পায়, তবে তা তার পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার কারনে।
৭। মেরি কম
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত ‘মেরি কম’ সিনেমাটি অবশ্যই অনেক ভারতীয় পিতামাতা এবং স্বামীর চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। এই সিনেমাটি তাদের সনাতনী চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একজন মহিলার স্বপ্নে বিশ্বাস করতে সাহায্য করে। ভারতের একজন মহিলা বক্সারের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি একজন মহিলার সংকল্প এবং তার স্বামীর সমর্থনে তিনি যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন সেটাই দেখিয়েছে।
৮। এংরি ইন্ডিয়ান গডেসেস
বলিউডের প্রথম নারী বাডি এই সিনেমাটিতে নারীদের বিভিন্ন অথচ পরিচিত পরিস্থিতিতে দেখানো হয়েছে। সাতজন মহিলার এবং কীভাবে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে তাদের জীবন পরিবর্তন হয় সেই গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সিনেমা। সিনেমাটি লিঙ্গ সমতার জন্য একটি লড়াই সম্পর্কে ছিল, একই লড়াই সাতটি ভিন্ন ভিন্ন নারীর সাতটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে একই প্রেক্ষাপট অনুসরণ করা হয়েছে।
৯। লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা
নারীর বিশেষ যে দিকগুলো একজন পুরুষের জানা দরকার সেটা দেখানোর কারনে সিনেমাটি অবশ্যই বিতর্কের দাবী রাখে। যেহেতু এটি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে আমাদের চারপাশের বিশ্বের নৃশংস বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসা ওয়েব ছাড়া আর কিছুই নয়। ফিল্মটি বৈবাহিক ধর্ষণকে নির্দেশ করে, প্রকাশ করে যে মহিলারা মাংসের বিরল টুকরা নয় এবং একজন মহিলার ইচ্ছা একজন পুরুষের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
১০। লাস্ট স্টোরিস
এই সিনেমার মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় সমাজের সাংস্কৃতিক ও যৌন নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নির্মাতারা। এটি ভারতীয় সমাজে সবচেয়ে বেশি ভ্রুকুটি করা বিষয়বস্তুকে মোকাবেলা করে কিন্তু নারীর দিক থেকে এটি বর্ণনা করে। সিনেমাটি পিতৃতন্ত্রের অনেক বিষয়ের সমালোচনা করে, যেমন তালাকপ্রাপ্ত নারীদের মানহানি এবং সন্তান ধারণের গৌরব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সাহসী উপায়ে যৌন আনন্দের জন্য নারীদের চারপাশের নিষিদ্ধ বিষয়গুলিতে ফোকাস করে।
নারী কেন্দ্রিক সিনেমা সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডে বেশ জনপ্রিয় হলেও সমাজের প্রচলিত পুরুষতন্ত্রের নিয়ম ভঙ্গের দুঃসাহস খুব কম সিনেমায়ই দেখা গেছে। উপরে উল্লেখিত সিনেমাগুলো সমাজের প্রচলিত সেই ধারনা এবং বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই দশটি নারী কেন্দ্রিক সিনেমাগুলো সেই ধারনাকেই নতুন করে সবাইকে ভাবতে বাধ্য করে।
আরো পড়ুনঃ
সিল্ক স্মিতা: পরিচারিকা থেকে ‘বোল্ড’ ছবির আইকন এবং রহস্যময় মৃত্যু
লেডি সুপারস্টার নয়নতারা: পুরুষ শাসিত তামিল সিনেমায় নারী স্টারডাম!