ঢালিউডের জুটি: ঢাকাই সিনেমার আলোচিত যত নায়ক-ভিলেন জুটি

সিনেমায় জুটি প্রথা অনেক পুরনো বিষয়। গল্পের ভাবকে দর্শকদের কাছে উপভোগ্য করে তুলতে সিনেমায় জুটির অবদান অনস্বিকারর্য। তবে সিনেমায় জুটি প্রথা অনেক রকমের হতে পারে যেমন, নায়ক-নায়িকা জুটি, নায়ক-পরিচালক জুটি, নায়ক-ভিলেন জুটি ইত্যাদি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের সিনেমায়ও বিভিন্ন সময় দেখা গেছে এরকম কিছু জুটি। এই জুটিগুলো একসাথে কাজ করা মানেই ছিল প্রযোজকের বিনিয়োগের নিশ্চয়তা। সেই তারকাদের পাশাপাশি এই জুটিগুলোর নিজস্ব একটি দর্শকগোষ্টি ছিলো। ঢালিউডে অ্যাকশন নির্ভর সিনেমা জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে পর্দায় নায়ক-ভিলেন জুটি হয়ে উঠে নির্মাতাদের অন্যতম নির্ভরতার প্রতিক। সেই ধারাবাহিকতায় ঢাকাই সিনেমার দর্শকরা দেখেছেন একাধিক নায়ক-ভিলেন জুটি। ঢালিউডের জুটি নিয়ে আলোচনার আজকের পর্বে থাকছে ঢাকাই সিনেমার দর্শক মাতানো আলোচিত কিছু নায়ক-ভিলেন জুটির গল্প।

১। জসীম-আহমেদ শরীফ
সিনেমায় ভিলেন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তিতে ঢালিউডের অন্যতম সেরা অ্যাকশন তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন চিত্রনায়ক জসীম। আর সিনেমার প্রথাগত ভালো এবং মন্দের লড়াইয়ে পর্দায় তার সাথে জুটি বাধেন আহমেদ শরীফ। নায়ক জসিমের সিনেমাগুলো দেখলেই অনুমান করা যায় পর্দায় তার সঙ্গে ভিলেন হিসেবে আহমেদ শরীফের জুটি কতটা নির্ভরযোগ্য ছিলো। ৫০টিরও বেশি সিনেমায় দেখা গেছে এই নায়ক-ভিলেন জুটিকে। সিনেমাগুলোর বেশীরভাগই ছিলো ব্যবসা সফল। এই জুটির আলোচিত সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘লালু মাস্তান’, ‘লোভ লালসা’, ‘জিদ্দি’, ‘হিংসা’, ‘কালিয়া’, ‘বাংলার নায়ক’, ‘টাইগার’, ‘স্বামী কেন আসামী’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘রাজাবাবু’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’ উল্লেখযোগ্য। সানফ্লাওয়ার মুভিজ, মেরিনা মুভিজ, পরিচালক মোতালেব হোসেন, এ জে মিন্টু এবং মনোয়ার খোকনের সিনেমায় নিয়মিত দেখা গেছে তাদের।

২। জসিম-জাম্বু
আহমেদ শরীফের পর জসীমের সাথে আরো একজন খলনায়ককে দেখা যেত নিয়মিত। তিনি হলেন বিশাল দেহী অভিনেতা জাম্বু। সিনেমার প্রধান ভিলেনের চরিত্রে না হলেও জাম্বু নিয়মিত অভিনয় করেছেন জসীমের সিনেমায়। নায়ক জসীমের যে শারীরিক গঠন ছিলো তাতে তার বিপরীতে পর্দায় সমান্তরালে অভিনয় করেছেন জাম্বু। ঢালিউডে অ্যাকশন সিনেমার যে ধারা জসীম শুরু করেছিলেন সেটাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে তার বিপরীতে দেহের বিশাল আকৃতি, টাক মাথা, ভয়ঙ্কর চোখ, ভারী কণ্ঠের জাম্বু ছিলেন নির্মাতাদের অন্যতম ভরসা।

৩। ইলিয়াস কাঞ্চন-এটিএম শামসুজ্জামান
নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য নায়িকাদের সাথে অভিনয়ের পাশাপাশি ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনয় করেছেন অসংখ্য ভিলেনের সাথে। ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমায় ভিলেনের তালিকায় রয়েছেন গোলাম মুস্তাফা, খলিল, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ, সাদেক বাচ্চু, রাজীব, হুমায়ূন ফরীদি, ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরা প্রমুখ। তবে জুটি বললে এটিএম শামসুজ্জামানের সাথে সবচেয়ে বেশী দেখা গেছে এই অভিনেতাকে। গ্রাম্য যুবক থেকে শুরু করে শহুরে আধুনিক যুবক কিংবা রাজপথের ভয়ংকর সন্ত্রাসী – ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে এটিএম শামসুজ্জামানকেই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশী।

৪। সালমান শাহ-রাজিব
খুব অল্প সময়ের ক্যারিয়ারে ঢাকাই সিনেমার দর্শকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি নাম সালমান শাহ। রোম্যান্টিক এবং সামাজিক সিনেমার তুলনায় অ্যাকশন সিনেমায় কম দেখা গেছে এই তারকাকে। তবে রোম্যান্টিক এবং সামাজিক সিনেমায় প্রথাগত ভালো-মন্দের দন্ধে নিয়মিত দেখা গেছে সালমান শাহ এবং রাজীবকে। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় বাবার চরিত্র থেকে শুরু করে ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ এর মত সিনেমায় দেখা গেছে এই নায়ক-ভিলেন জুটিকে। শক্তিশালী এই অভিনেতার সাথে নতুন প্রজন্মের সালমান শাহর সমান্তরাল অভিনয় দিয়েছিলো দর্শকদের বিনোদনের অনন্য অভিজ্ঞতা।

৫। সালমান শাহ-ডন
রাজীবের পাশাপাশি সালমান শাহর সিনেমায় ডনকেও দেখা গেছে নিয়মিত। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মাধ্যমে সালমান শাহ এবং মৌসুমির সাথে অভিষিক্ত হয়েছিলেন এই খল অভিনেতা। সালমান শাহ অভিনীত প্রায় সব সিনেমায় ছিলেন ডন। নিজের বন্ধু ডনকে তার সিনেমায় সবসময় রেখেছেন সালমান শাহ। আর এই নায়ক-ভিলেন জুটির পর্দা রসায়ন মাত করেছে দর্শকদের অসংখ্যবার। সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর ডনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন এই তারকার পরিবার।

৬। রুবেল-হুমায়ূন ফরীদি
শহীদুল ইসলাম খোকনের হাত ধরে ঢালিউডে অভিষিক্ত হয়েছিলেন চিত্রনায়ক রুবেল এবং হুমায়ুন ফরীদি। জসীমের পর ঢাকাই সিনেমায় অ্যাকশনের যে নতুন ধারা রুবেলের হাত ধরে শুরু হয়েছিলো হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন তার সাথে সোনায় সোহাগা। অ্যাকশন নির্ভর সিনেমায় বেশী অভিনয়ের কারনে তার সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ন। রুবেল তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহু ভিলেনদের সঙ্গেই অভিনয় করেছেন। তবে হুমায়ূন ফরীদির সঙ্গে তার জমজমাট একটি জুটি গড়ে ওঠেছিল রুপালি পর্দায়। সেই ‘সন্ত্রাস’ থেকে শুরু ‘বিশ্ব প্রেমিক’ এর মত সিনেমায় নিয়মিত দেখা গেছে এই জুটিকে। পরবর্তীতে রুবেল যখন সিনেমা পরিচালনা শুরু করেন তখন ভিলেন চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদিই ছিলেন রুবেলের প্রথম পছন্দ। ‘বিচ্ছু বাহিনী’, ‘অন্ধকারে চিতা’, ‘বাঘে বাঘে লড়াই’, ‘খুনের পরিমাণ’, ‘বিষাক্ত চোখ’ সহ রুবেল পরিচালিত একাধিক সিনেমায় দেখা গেছে হুমায়ুন ফরীদিকে।

৭। রুবেল-ইলিয়াস কোবরা
রুবেলের সাথে হুমায়ুন ফরীদি ছাড়া ড্যানি সিডাকের জুটি হওয়ার যতেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও ড্যানির ভিলেন থেকে নায়ক হয়ে উঠার কারনে সেটা হয়ে উঠেনি। সে জায়গায় রুবেলের সাথে জুটি বাধেন ইলিয়াস কোবরা। রুবেলের বিপরীতে মার্শাল আর্ট অ্যাকশনকে ফুটিয়ে তুলতে ইলিয়াস কোবরার বিকল্প খুব একটা ছিলো না নির্মাতাদের কাছে। রুবেলের মতো কোবরাও ছিলেন মার্শাল আর্টে পারদর্শি। তাই রুবেলের আঘাতগুলো সঠিকভাবেই তিনিই মোকাবেলা করতে পারতেন। কোবারাই একমাত্র ভিলেন ছিলেন যিনি রুবেলের মার্শালের কৌশলকে পরাস্ত করে তাকে আঘাতও করতে পারতেন। নব্বই দশকের সিনেমাগুলোতে সেই প্রমাণ রয়ে গেছে। বলা অপেক্ষা রাখে না, রুবেল-কোবরার সিনেমাগুলো ছিল সুপারহিট।

৮। মান্না-ডিপজল
অ্যাকশন নির্ভর সিনেমার আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা মান্না তার ক্যারিয়ারে ভিলেন হিসেবে পেয়েছেন একাধিক শক্তিশালী অভিনেতাকে। এরমধ্যে মিজু আহমেদ, রাজীব এবং হুমায়ুন ফরীদি উল্লেখযোগ্য। তবে জুটি বলতে যা বোঝায় সেটা দেখা গেছে ডিপজলের সাথে। ১৯৯৭ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘তেজী’ সিনেমায় প্রথম একসাথে অভিনয় করেন মান্না এবং ডিপজল। ‘তেজী’ সিনেমার বিশাল সাফল্যের পর মান্না-ডিপজল হয়ে উঠেন দর্শকদের কাঙ্ক্ষিত জুটি। এরপর কাজী হায়াৎ এবং মনতাজুর রহমান আকবর এই জুটিকে নিয়ে উপহার দিয়েছেন একের পর এক দর্শকনন্দিত সিনেমা। ‘আম্মাজান’, ‘কুখ্যাত খুনী’, ‘বর্তমান’, ‘ভাইয়ের শত্রু ভাই’, ‘ধর’, ‘ঢাকাইয়া মাস্তান’, ‘মেজর সাহেব’, ‘কঠিন সীমার’, ‘গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান’, ‘ঝড়’ সিনেমাগুলো সেই প্রমাণই বহন করে।

৯। শাকিব খান-মিশা সওদাগর
সিনেমার সংখ্যার দিক থেকে ঢাকাই সিনেমার সব নায়ক-ভিলেন জুটিকে ছাড়িয়ে গেছেন শাকিব খান এবং মিশা সওদাগর। এক দশকের বেশী সময় ধরে শতাধিক সিনেমায় একসাথে অভিনয় করেছেন এই দুই তারকা। শাকিব খানের একক আধিপত্যের সময়টাতে ভলেন চরিত্রের জন্য মিশা সওদাগর ছিলেন এক নির্ভরতার নাম। শাকিব খান অভিনীত প্রায় সব সিনেমায় ভিলেন চরিত্রে দেখা গেছে মিশাকে। এছাড়া শাকিব খান প্রযোজিত সিনেমাগুলোতেও মিশা সওদাগর ছিলেন নিয়মিত। কিন্তু বর্তমানে এই দুই তারকার মধ্যে সম্পর্কটা আগের মত নেই। ব্যক্তি সম্পর্কে এই দূরত্বের প্রভাব পড়েছে তাদের সিনেমায়ও। তবে সর্বাধিক সিনেমায় নায়ক-ভিলেন জুটির রেকর্ডটি হয়তো থাকবে শাকিব খান-মিশা সওদাগরের নামে।

প্রিয় পাঠক, উপরের উল্লেখিত নায়ক-ভিলেন জুটির মধ্যে কোন জুটিটি আপনার বেশী পছন্দ আমাদের জানিয়ে দিন মন্তব্যে। এছাড়া উপরে উল্লেখিত নায়ক-ভিলেন জুটি ছাড়া আর কোন জুটিটি এই তালিকায় থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন জানিয়ে দিন আমাদের।

আরো পড়ুনঃ
বলিউডে বাংলাদেশি তারকা: বলিউডের সিনেমায় বাংলাদেশি যত তারকা
ঢালিউডের গৌরবময় অতীত: আমাদের সোনালি সময়ের সেইসব খলনায়কেরা
জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রূপ – আমাদের সিনেমার প্রথম মারামারির দল

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d