বলিউডে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে রিমেক সিনেমাঃ সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে রিমেক

২০০৮ সালের ক্রিসমাসে মুক্তিপ্রাপ্ত আমির খান অভিনীত ‘গজীনি’ সিনেমাটি ছিলো ১০০ কোটি রুপি আয় কর বলিউডের প্রথম সিনেমা। শুধু বলিউড নয় ভারতীয় সিনেমার বক্স অফিসে হিসেব উল্টাপাল্টা করে দিয়েছিলো এআর মুরুগুদাস পরিচালিত সিনেমাটি। এই সিনেমাটি ছিলো এই নির্মাতার একই নামের তামিল সিনেমার হিন্দি রিমেক। তবে মূলত সিনেমাটি ক্রিটফার নোলানের ‘মেমেন্টো’ সিনেমার রিমেক ছিলো। বলিউড তথা ভারতীয় সিনেমার বক্স অফিসে নতুন এক সময়ের সাক্ষী এই সিনেমাটি ছিলো একটি রিমেক সিনেমা।

শুধু ‘গজীনি’ নয়, এর আগে এবং পরে বলিউডে অন্য ভাষা থেকে রিমেক নির্মিত হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে। আর এই রিমেক সিনেমাগুলো বক্স অফিসে রীতিমত ঝড় তুলেছে। টানা এক দশকের বেশী সময় বক্স অফিসে ব্যর্থতার পর ২০০৯ সালে সালমান খানের ‘ওয়ান্টেড’ সিনেমাটি বক্স অফিসে তার পুনর্জন্মের সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই সিনেমাটিও তেলুগু সিনেমার হিন্দি রিমেক ছিলো। এরপর এক যুগের বেশী সময় ধরে বলিউডে রাজত্ব করা সালমান খানের বেশীরভাগ সিনেমাই ছিলো অন্য ভাষার রিমেক।

সালমান খানের ক্যারিয়ারের সেরা এই সময়ে বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অন্য ভাষা থেকে হিন্দিতে রিমেক হয়েছিলো। সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘রেডি’, ‘বডিগার্ড’ এবং ‘কিক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘জয় হো’ এবং ‘রাধে’ সিনেমাগুলোও রিমেক সিনেমা ছিলো। শুধু সালমান খানই নন, রিমেক সিনেমার মাধ্যমে বক্স অফিসে সাফল্য পাওয়া অন্য তারকার মধ্যে রয়েছেন অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগণ, শাহীদ কাপুর এবং রণবীর সিং। প্রথমসারির তারকাদের মধ্যে শাহরুখ খান ছাড়া সবাইকেই দেখা গেছে অন্য ভাষা থেকে রিমেক সিনেমায়।

এই তারকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী রিমেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন অক্ষয় কুমার। বিগত কয়েক বছর ধরে একের পর এক রিমেক সিনেমায় দেখা গেছে খিলাড়ী কুমারকে। এই রিমেক সিনেমাগুলোর মাধ্যমে বক্স অফিসে সাফল্যও পেয়েছেন এই তারকা। তার বাণিজ্যিক সফল রিমেক সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রাওডি রাঠোর’, ‘ভুল ভুলাইয়া’ এবং ‘হলিডে’ উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে অজয় দেবগণের আইকনিক চরিত্র ‘সিঙ্ঘাম’ একটি তামিল সিনেমা রিমেক থেকে এসেছে। এছাড়া অজয় অভিনীত আলোচিত ‘দৃশ্যাম’ সিনেমাটিও একটি রিমেক সিনেমা ছিলো।

তবে আজকের এই লিখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বলিউডের রিমেক সিনেমা নয়। বরং সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডে রিমেক সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা হারানো নিয়ে। চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের সিনেমাগুলোর বক্স অফিসে ব্যর্থতা সংশ্লিষ্টদের নতুন সমীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে বলিউডের একের পর এক সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরেছে। এই সিনেমাগুলোর মধ্যে রিমেক সিনেমার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। চলতি বছরে বক্স অফিসে ব্যর্থ রিমেক সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বচ্চন পাণ্ডে’, ‘জার্সি’, লাল সিং চাড্ডা’ এবং ‘বিক্রম ভেধা’।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সিনেমাগুলোর ব্যর্থতা কি শুধুমাত্র রিমেকের কারনে? সেটা হয়তো না, কিন্তু এই সিনেমাগুলোর ব্যর্থতা কিছুটা হলেও রিমেক সিনেমার ব্যাপারে ভাবাতে বাধ্য করছে নির্মাতাদের। টিজার এবং ট্রেলার প্রকাশের পর আলোচনার জন্ম দেয়ার পরও সিনেমাগুলো প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে হৃতিক রোশন এবং সাইফ আলী খান অভিনীত সিনেমা ‘বিক্রম ভেধা’। মুক্তির পর দর্শক এবং সমালোচকদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পরও সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে পারেনি।

রিমেক সিনেমা নিয়ে বলিউডের দর্শকদের এই পছন্দ বা স্বাদের পরিবর্তিনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলেছে করোনা মহামারী। করোনা মহামারীর কারনে সিনেমার দর্শকরা ওটিটি প্লাটফর্মের সাথে এখন অনেক বেশী পরিচিত। এছাড়া ভারতের অন্যান্য ভাষায় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর হিন্দি ডাব সংস্করণ কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসে ওটিটি প্লাটফর্মে। ওটিটি’তে হিন্দি ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে এমন সিনেমাটি রিমেক প্রেক্ষাগৃহে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। মহামারীর আগের রিমেক সিনেমাগুলোর বক্স অফিসের সাথে পরের সিনেমাগুলোর তুলনা করলে চিত্রটি আরো অনেক বেশী পরিষ্কার হয়ে যায়।

বলিউড অভিনেতা শাহীদ কাপুরের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশী আয়ের সিনেমা ‘কবির সিং’ তেলুগু ‘অর্জুন রেড্ডি’ সিনেমার হিন্দি রিমেক ছিলো। সিনেমাটি বক্স অফিসে ২৫০ কোটি রুপির বেশী আয় করতে সক্ষম হয়েছিলো। আর মহামারীর পরবর্তী সময়ে শাহীদ কাপুরের তেলুগু সিনেমার রিমেক ‘জার্সি’ বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরেছিলো। এছাড়া মহামারী শুরু আগের বছর রণবীর সিং অভিনীত ব্লকবাস্টার ‘সিম্বা’ সিনেমাটি তেলুগু ‘টেম্পার’ সিনেমার রিমেক ছিলো।

বলিউডে রিমেক সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা হারানোর আরো একটি কারন হচ্ছে ভারতের আঞ্চলিক সিনেমাগুলোর হিন্দিতে মুক্তি। এস এস রাজামৌলী পরিচালিত ‘বাহুবলী’ সিরিজ, ‘পুষ্পা’ এবং ‘কেজিএফ’ সিরিজের পর দক্ষিণের সিনেমাগুলোর প্যান ইন্ডিয়া মুক্তি নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বলিউডের দর্শকদের কাছে সিনেমার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার বিষয়টি অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। দক্ষিণের গল্পের সিনেমার স্বাদের সাথে বলিউডের নির্মাতাদের নির্মান দর্শকদের কাছে খুবই ফেঁকাসে মনে হচ্ছে। রিমেকের পরিবর্তে মূল সিনেমা দেখার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ অনেক বেশী।

চলতি বছরে বলিউডে আরো দুটি রিমেক সিনেমা মুক্তি পেতে যাচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে অজয় দেবগণ অভিনীত ‘দৃশ্যাম ২’ এবং সালমান খান অভিনীত ‘কিসি কা ভাই কিসি কা জান’। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি রিমেক সিনেমা নির্মানাধীন রয়েছে। আর এই রিমেক সিনেমার তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে আছেন অক্ষয় কুমার। সুরিয়ার জাতীয় পুরষ্কার জয়ী ‘সরুরাই পত্রু’ সহ অক্ষয় কুমার অভিনীত ৫/৬ রিমেক সিনেমা নির্মানাধীন অথবা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। মুক্তির পর এই সিনেমাগুলোর ভাগ্য কি হয় সেটা সময়ই বলে দিবে।

রিমেক সিনেমার প্রতি বলিউড দর্শকদের এই অনীহা নির্মাতাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এটি কিছুটা হলেও ভালো হিসেবে দেখাছেন সংশ্লিষ্টরা। রিমেক সিনেমা থেকে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া নতুন কিছু করতে উৎসাহ যোগাবে নির্মাতাদের এমনটাই মনে করছেন অনেকে। সামনের বছরগুলোতে রিমেকের পরিবর্তে নতুন নতুন গল্প এবং চিত্রনাট্যে সিনেমা নির্মানের দিকে নির্মাতা মনযোগী হলে বলিউডও ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুষ। নতুন গল্প এবং চিত্রনাট্যে সিনেমা নির্মানের মাধ্যমে বলিউড আগামী দিনে দর্শকদের স্মরণীয় সিনেমা উপহার দিতে সক্ষম হবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

আরো পড়ুনঃ
শাহরুখ খানের ‘দিল সে’: সময়ের আগে নির্মিত একটি বলিউড মাস্টারপিস
সিনেমার পর্দায় ঝড় তোলা বলিউডের ইতিহাসের ক্লাসিক দশ মহিলা ভিলেন
অয়ন মুখার্জির ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ সিনেমায় অস্ত্রভার্সের শক্তিশালী অস্ত্র উপাখ্যান!

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d