‘রোস্টিং’ বিনোদন এবং অস্কারের মঞ্চে উইল স্মিথের থাপ্পড় উপাখ্যান

অস্কারের মঞ্চে উইল স্মিথের

অস্কারের মঞ্চে উইল স্মিথের

অস্কারের মঞ্চে চড়-থাপ্পড়ের এই ঘটনা প্রমাণ করলো, এই তথাকথিত সভ্য সমাজে ‘বিনোদন’-এর পুরো ধারণাটাই বদলে গেছে! ‘রোস্টিং’ নামের আপত্তিজনক আলোচনা এখন আমাদের জন্য বিনোদনের অন্যতম উৎস! ইউটিউবে ঢুকলেই শত শত দেশি-বিদেশি রোস্টিং ভিডিও সামনে চলে আসে, আর এ সমস্ত রোস্টারদের ফ্যান-ফলোয়ারের অভাব নাই। ভিডিওর নিচে অজস্র কমেন্ট- “এত সুন্দর রোস্টিং কীভাবে করেন?” “আমাকে রোস্টিং শেখাবেন, প্লিজ?” অর্থাৎ, এখন পাবলিকলি কাউকে মানহানি করতে পারাটাও একটা স্কিলের পর্যায়ে পড়ে! অথচ এই পাবলিক হ্যারাসমেন্ট একজন মানুষকে মানসিকভাবে কতটা টর্চার করে তা আমরা ভেবেও দেখি না! মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ জাগে- মানব সভ্যতা কি সামনে আগাচ্ছে না উল্টো পথে হাঁটছে? অস্কারের মঞ্চে উইল স্মিথের থাপ্পড় যেনো সেই প্রশ্নই আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে!

বছর জুড়ে পৃথিবীতে যত বড় ইভেন্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ “অস্কার প্রদানের অনুষ্ঠান”। বিনোদন জগতে অস্কার হচ্ছে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে, সেই সম্মানের মঞ্চে অসম্মান করার রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে! মানুষকে হাসাতে হলে কাউকে “রোস্ট” করতে হবে- এটা কেমন কথা? কারো গায়ের রঙ, কারো চেহারা, কারো শরীর, কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে টিটকারি করে সেটাকে “জোকস” বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টিটকারিটা যাকে নিয়ে করা হয়, সেও হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অপমানটা তাকে ঠিকই পোড়ায়। এভাবে পুড়তে পুড়তে যে আক্রোশ জমে, তারই প্রতিফলন উইল স্মিথের এই থাপ্পড়!

কমেডিয়ান ক্রিস রক মঞ্চে উঠে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রসিকতা করছিলো। এক পর্যায়ে সে অভিনেতা উইল স্মিথের নোমিনেশন পাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে তার স্ত্রী জেডা পিঙ্কেট স্মিথের প্রসঙ্গ টেনে আনে। জেডার কামানো মাথাকে ইঙ্গিত করে ক্রিস রক ফান করে বলে, “জেডা, জিআই জেন টু-তে তোমাকে দেখার জন্য আমার আর তর সইছে না।”

যারা জোকসটা বুঝতে পারেননি, তাদের জন্য বলি- জি আই জেন হচ্ছে ১৯৯৭ সালের একটা মুভি, যেখানে অভিনেত্রী ডেমি মুর মাথা কামিয়ে অভিনয় করেন। ঐ সিনেমায় দেখানো হয় একজন নারীর নেভি সিল হয়ে ওঠার গল্প। কঠিন ট্রেনিং নিতে গিয়ে তাকে মাথার চুল ফেলে দিতে হয়, পুরুষদের মাঝে সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য তাকে নিজের নারীত্বকে সম্পূর্ণ আড়াল করে ফেলতে হয়। এদিকে উইল স্মিথের স্ত্রী জেডা পিঙ্কেট স্মিথ অনেকদিন যাবত অ্যালোপেকিয়া নামে এক ধরনের অসুখে ভুগছেন। যার ফলে মাথার চুল পড়তে থাকে এবং মস্তিস্কের কোষ থেকে রক্তক্ষরণ হয়। তাই বাধ্য হয়েই জেডা তার মাথার চুল ফেলে দিয়েছেন। আর এই কামানো মাথার কারণেই জেডাকে জিআই জেন এর সাথে তুলনা করে ক্রিস রক বলে যে জিআই জেন সিনেমার সেকেন্ড পার্টে জেডাকে দেখতে সে খুব আগ্রহী! কতটা অবিবেচক হলে একজন মানুষের অসুস্থতা নিয়ে এমন জোকস করা যায়! উইল স্মিথ প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু জেডার কালো হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে তার হয়তো আর সহ্য হয়নি। স্ত্রীর অপমানের প্রতিশোধস্বরূপ সে মঞ্চে উঠে যায় এবং ক্রিস রককে কষিয়ে একটা চড় মারে! তার এই চড় যেন “জোকস” এর নাম করে মানুষকে পাবলিক প্লেসে হ্যারাস করার এই অপ-সংস্কৃতির মুখেই চপেটাঘাত!

উইল স্মিথের এই ক্ষোভ কিন্তু একদিনের নয়! এর আগেও ক্রিস রক এমন কাণ্ড করেছে। পরপর দুই বছর অস্কারে কোনো ব্ল্যাক অভিনেতা বা অভিনেত্রী মনোনয়ন পায়নি বলে উইল স্মিথ আর তার স্ত্রী জেডা পিঙ্কেট স্মিথ ২০১৬ সালের অস্কার বয়কট করেছিলো। সেবারও উপস্থাপনা করতে এসে ক্রিস রক জেডাকে নিয়ে নোংরা একটা জোকস বলে- “জেডা পিঙ্কেট স্মিথের অস্কার বর্জন করা আর আমার রিহানার প্যান্টি বয়কট করা একই কথা! কাউকেই আমন্ত্রণ করা হয়নি!” মানুষ তো এই জোকস শুনে খুব মজা পেয়েছে, অথচ উইল স্মিথের অস্কার বয়কটের পেছনে যে যুক্তিযুক্ত কারণ ছিলো তা কেউ ভেবে দেখেনি!

গতরাতে ক্রিস রককে চড় মারার কয়েক মিনিট পরেই সেরা অভিনেতার নাম ঘোষণা করা হয়। “কিং রিচার্ড” সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য উইল স্মিথ সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নিলেন। মঞ্চে উঠে ইমোশনাল হয়ে গেলেন উইল স্মিথ। দুচোখ বেয়ে নামলো অশ্রু। কান্না জড়ানো কণ্ঠে তিনি বললেন- “আমি জানি- কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক অপমান সহ্য করতে হয়, অ্যাবিউসড হতে হয়, অপদস্ত হতে হয়; তারপরও আমাদের হাসিমুখে সব মেনে নিতে হয় যেন কিছুই হয়নি! আমি এই ঘটনার জন্য অ্যাকাডেমি ও সহশিল্পীদের কাছে ক্ষমা চাই!” সবশেষে একটু মজা করে বললেন- “আশাকরি আগামীতে আবারও আমি অস্কারের আয়োজনে আমন্ত্রণ পাবো…” উইল স্মিথের এই মুখে হাসি আর চোখে পানি দেখে খুব খারাপ লাগছিলো! কতটা ক্ষোভ তার হৃদয়ে জমা তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিলো না!

যারা ভাবছেন- অস্কারের মঞ্চে এমন মজা করা যেতেই পারে, তারা একটু ইউটিউবে সার্চ করে পূর্বের অস্কার আয়োজনের ভিডিওগুলো দেখে নিতে পারেন। তখনও মজা হতো, ফান হতো, জোকস বলা হতো। কিন্তু সেই সাথে তুলে আনা হতো বড় ধরনের সামাজিক ইস্যুগুলো। সারা বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে থাকে অস্কার অনুষ্ঠানের দিকে, তাই সমাজ পরিবর্তনের মতো অনুপ্রেরণামূলক মেসেজগুলো সারা বিশ্বের পৌঁছে দেওয়ার এটা দারুণ সুযোগ!

মারলন ব্র্যান্ডো “গডফাদার” চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার প্রত্যাখান করেছিলেন। তিনি হলিউডের চলচ্চিত্রে নেটিভ আমেরিকানদের অবমাননাকর এবং বর্ণবাদী চিত্রায়নের প্রতিবাদে মঞ্চে উঠতে অস্বীকৃতি জানান। নিজের পরিবর্তে তিনি একজন নেটিভ অ্যামেরিকানকে পাঠান একটা চিঠি পড়তে যেখানে তারা যে কতটা নিপীড়নের শিকার তা তুলে ধরা হয়েছিলো। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অস্কারের মঞ্চে এসে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিষয়ে সচেতনতামূলক বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। ভায়োলা ডেভিস এসে ব্ল্যাক নারীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন যে তারাও চাইলে বিশ্বজয় করতে পারে। আরও অজস্র অভিনেতা অসাধারণ সব বক্তব্য রেখেছেন অস্কারের মঞ্চে উঠে যা সারা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, ভাবতে শিখিয়েছে, ভালোবাসতে শিখিয়েছে! কিন্তু এখন সেই মঞ্চ ব্যবহার হচ্ছে মানুষের অসুস্থতা নিয়ে সস্তা জোকস বলার কাজে!

উইল স্মিথ অ্যামেরিকান সংবিধান অনুযায়ী আইন ভঙ্গ করেছেন। এই কারণে হয়তো তার জেল-জরিমানা হবে, ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, তাতে উইল স্মিথের কোনো আফসোস থাকবে না! কাজটা ঠিক হয়েছে নাকি ভুল হয়েছে তা নিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। তবে এটা সত্যি যে হাজারটা ভালো সিনেমা আমাদের যা শেখাতে পারেনি, তা উইল স্মিথ এক থাপ্পড়ে শিখিয়ে দিলেন। শিখিয়ে দিলেন কীভাবে নিজের পরিবারকে প্রোটেক্ট করতে হয় আর অশোভন আচরণ ও অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জানাতে হয় তীব্র প্রতিবাদ!

আরো পড়ুনঃ
হলিউডের যে সিনেমাগুলো বলিউড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছিলো
Resident Evil সিরিজ: Red Queen, Zombie, Alice এবং টিকে থাকার লড়াই

By নাজিম-উদ-দৌলা

এ সম্পর্কিত

%d