চলচ্চিত্রের নামঃ মেকাপ (২০২১)
মুক্তিঃ মার্চ ২১, ২০২১
অভিনয়েঃ তারিক আনাম খান, জিয়াউল রোশান, নিপা আহমেদ রেলী, পায়েল মুখার্জি, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, ট্রামবাক রয় চৌধুরী, কাজী উজ্জ্বল, পূজা, তানিয়া, তুরিন এবং নমনি প্রমুখ।
পরিচালনাঃ অনন্য মামুন
প্রযোজনাঃ সেলিব্রেটি প্রোডাকশন্স
পরিবেশনাঃ আই থিয়েটার (ওটিটি)
কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ অনন্য মামুন
সম্পাদনাঃ অনয় সোহাগ
চিত্রগ্রহনঃ ভেঙ্কট গঙ্গাধারী, রাজু রাজ এবং মিঠু মনির
সংগীতঃ লিংকন এবং স্যাভি
প্রারম্ভিক কথাঃ সাম্প্রতিক সময়ে নিজের সিনেমা নিয়ে বেশ আলোচনায় নির্মাতা অনন্য মামুন। ‘নবাব এল এল বি’ এর পর তার পরিচালিত ‘মেকাপ’ সিনেমাটিও আটকে যায় সেন্সর বোর্ডে। চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ঠদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে পারে অভিযোগ এনে সিনেমাটিকে ছাড়পত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। পরবর্তীতে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না দিয়ে ওটিটি প্লাটফর্ম আই থিয়েটারে মুক্তি দেন অনন্য মামুন। সিনেমাটির ট্রেলার প্রকাশের সাধারন দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয় এই সিনেমা। তাহলে কেমন ছিল অনন্য মামুনের ‘মেকাপ’? কি এমন ছিল সিনেমায় যার কারনে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া হলোনা সিনেমাটিকে? গুনগত মানের দিক থেকে কেমন ছিল আলোচিত এই সিনেমা? এই প্রসঙ্গগুলোর উত্তর থাকছে আজকের ‘মেকাপ’ সিনেমার রিভিউতে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ অজপাড়াগাঁয়ের গরীব ঘরের মেয়ে মুন্নি (রেলী)। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি প্রচন্ড আকর্ষনের কারনে নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে মুন্নি। নায়িকা হওয়ার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি ছিল মুন্নি। কিন্তু মুন্নির গরীব মা মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়। কলেজে একটি অনুষ্ঠানে নাচের জন্য ট্রপি অর্জন করে মুন্নি, কিন্তু ক্ষোভে দুঃখে মুন্নির মা মুন্নির সেই ট্রপিটি ভেঙে ফেলে। এরপর নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মুন্নি রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে পালিয়ে পা রাখে স্বপ্ন এবং স্বপ্নবাজদের শহর ঢাকায়।
ঢাকায় এসে মুন্নি তার বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচিত হওয়া মাইকেল (যে নিজেকে একজন কমেডি অভিনেতা দাবি করে) এর সাথে দেখা করে। মাইকেল তাকে নায়িকা বানানোর কথা বলে একজন প্রযোজকের কাছে পাঠায়। সেখানে এই প্রযোজক তার শ্রীলতাহানির চেষ্ঠা করলে সেই অফিসে কর্মরত পাবেল (জিয়াউল রোশান) কৌশলে মুন্নি’কে সেখান থেকে উদ্ধার করে। পাবেলও ঢাকায় সিনেমার নায়ক হওয়ার আশায় এসেছিলো, কিন্তু ১০ বছরের চেষ্ঠার পরও সে কোন ব্রেক পায়নি। তারপর পাবেল মুন্নি’কে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে বলে, কিন্তু মুন্নি পাবেলের পিছু নেয় এবং বাড়ি যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এর প্রেক্ষিতে পাবেল মুন্নিকে নিজের স্ত্রীর পরিচয়ে তার বাসায় জায়গা দেয় এবং মুন্নিকে নায়িকা হওয়ার জন্য সাহায্য করে। একসাথে থাকার কারনে দুইজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী হয় পাবেল এবং মুন্নির মধ্যে।
এই সময়ে সুপারষ্টার শাহবাজ খান (তারিক আনাম খান) এর একটি সিনেমার জুনিয়র আর্টিস হিসেবে সুযোগ পায় মুন্নি। সিনেমাটির প্রধান নায়িকা অন্তরার স্পটে দেরিতে আসার কারনে মুন্নি অন্তরার ডামি হিসেবে কিছু দৃশ্যে অংশগ্রহন করে। সেখান থেকে মুন্নিকে পছন্দ হয় সিনেমাটির পরিচালকের এবং শাহবাজ খানের সাথে পরামর্শ করে সিনেমাটিতে অন্তরার পরিবর্তে নায়িকা হিসেবে মুন্নিকে সুযোগ দেন পরিচালক। নিজের স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মুন্নি কি করবে? মুন্নির নায়িকা হওয়ার কারনে তার জীবনে যে পরিবর্তন এবং প্রভাব, সেখানে শাহবাজ খানের অবদান, পাবেলের সাথে মুন্নির সম্পর্কের সমীকরন সবকিছু মিলিয়ে উত্তেজনাকর এক ক্লাইমেক্সের দিকে এগিয়ে যায় সিনেমার গল্প।
গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ এফডিসি কেন্দ্রিক সিনেমাগুলোর মত গতানুগতিক গল্পের বাইরের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সিনেমা। নায়ক ভিলেনের প্রতিশোধ আর অযৌক্তিক মারামারি নেই এই সিনেমায়। আছে চলচ্চিত্রের রঙ্গিন দুনিয়ার আড়ালের এক বাস্তবতা। এরকম একটি গল্প নিয়ে সিনেমা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। গল্পের ধারাবাহিকতায় প্রেক্ষাপট নির্মানে সিনেমাটির চিত্রনাট্যে বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরতে সক্ষম ছিলেন অনন্য মামুন। মুন্নি এবং পাবেলের একসাথে কিছু দৃশ্যের উপস্থাপন অসাধারন করে তুলবে দর্শকদের কাছে। তবে চিত্রনাট্য নিয়ে আরো কাজ করার সুযোগ ছিল বলে মনে হয়েছে। সম্ভবত চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনা অনন্য মামুন একা করার কারনে কিছুটা খামতি থেকে গেছে বলে মনে হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনন্য মামুনের সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী উপাদান সংলাপ। এক্ষেত্রে ‘মেকাপ’ সিনেমাটিও ব্যতিক্রম নয়। পাবেল এবং শাহবাজ খানের মুখে বলে বেশ কিছু সংলাপ আপনাকে বারংবার ভাববে। সংলাপের দিক থেকে সিনেমাটি অন্যরকম একটি অবস্থানের দাবি রাখে এতে কোন সন্দেহ নেই।
অভিনয়ঃ তারিক আনাম খান জাত অভিনেতা – তার অভিনয় দক্ষতা নতুন করে প্রমানের কিছু নেই। সুপারষ্টার শাহবাজ খানের চরিত্রে অসাধারন অভিনয় করেছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। যতবার পর্দায় এসেছেন পুরো দৃশ্য নিজের করে নিয়েছেন তিনি। পাবেলের চরিত্রে জিয়াউল রোশন আরো একবার নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। অভিনয় নির্ভর চরিত্রের পাশাপাশি সিনেমাতে তার সংলাপ বলার ধরন অন্যরকম প্রশংসার যোগ্য।
সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেলী মোটামুটি ভালো অভিনয় করছেন। বিশেষ করে নায়িকা হওয়ার আগে গ্রামের মেয়ে হিসেবে রেলী ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু নায়িকা হওয়ার পরের অংশে রেলীকে কিছু কিছু দৃশ্যে একটু অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। তাছাড়া সিনেমার একজন জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে পর্দায় যেরকম প্রভাব থাকা দরকার ছিল সেখানে গ্ল্যামারের দিক থেকে কিছুটা ঘাটতি ছিল।
শাহবাজ খানের স্ত্রী এবং জনপ্রিয় নায়িকা চরিত্রে পায়েল মুখার্জি ভালো অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে ‘মেকাপ’ সিনেমায় একজন প্রযোজকের চরিত্রে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ছিলেন অসাধারন। সিনেমাতে তার কমিক টাইমিং এবং সংলাপ সিনেমাকে একটা আলাদা এঙ্গেল দিয়েছে। অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা যার যার জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ ‘মেকাপ’ সিনেমার চিত্রগ্রহন ঢাকাই অন্যান্য সিনেমাগুলোর চেয়ে ভিন্নতর ছিলো। দৃশ্যধারন এবং চিত্রগ্রহনে মুন্সিয়ানার চাপ ছিলো। কিছু কিছু দৃশ্য এতটা শৈল্পিক ছিল যে ওই দৃশ্যের তারকাদের উপস্থিতি দর্শকদের কাছে নগন্য মনে হবে। এছাড়া সম্পাদনা যথোপযোগী ছিলো।
উপসংহারঃ সিনেমাটিকে প্রদর্শনের অযোগ্য বলার যৌক্তিকতা সম্ভবত সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের কাছেও নেই! সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সুনির্মিত সিনেমা ‘মেকাপ’। বাংলা সিনেমার সময় পরিবর্তনের সংকেত যদি অনুভব করতে চান তাহলে আপনার এই সিনেমাটি দেখা উচিত। বিনোদন এবং ভাবনা – এই দুই উপাদানই আপনি পাবেন এই সিনেমায়।
আরো পড়ুনঃ
আই থিয়েটারে মুক্তি পাচ্ছে অনন্য মামুনের ‘মেকাপ’: প্রকাশ্যে ট্রেলার
অনন্য মামুনের ‘মেকাপ’ সিনেমা নিষিদ্ধ করলো সেন্সর বোর্ড