চলচ্চিত্রের নামঃ মিশন এক্সট্রিম (২০২১)
মুক্তিঃ ডিসেম্বর ০৩, ২০২১
অভিনয়েঃ আরিফিন শুভ, তাসকিন রহমান, জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী, সাদিয়া নাবিলা, সুমিত সেনগুপ্ত, রাইসুল ইসলাম আসাদ, ফজলুর রহমান বাবু, শতাব্দী ওয়াদুদ, মাজনুন মিজান, ইরেশ জাকের, মনোজ প্রামাণিক, আরেফ সৈয়দ, সুদীপ বিশ্বাস দীপ, রাশেদ মামুন অপু, এহসানুল রহমান, দীপু ইমাম এবং সৈয়দ নাজমুস সাকিবসহ অনেকে।
পরিচালনাঃ সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদ
প্রযোজনাঃ কপ ক্রিয়েশন এবং মাইম মাল্টিমিডিয়া
পরিবেশনাঃ কপ ক্রিয়েশন
কাহিনীঃ সানী সানোয়ার
চিত্রনাট্যঃ সানী সানোয়ার
সম্পাদনাঃ এমডি কালাম
চিত্রগ্রহনঃ সুদীপ্ত মজুমদার
প্রারম্ভিক কথাঃ করোনা পরবর্তি সময়ে ঢালিউডের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘মিশন এক্সট্রিম’। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার পর একই টিমের দ্বিতীয় সিনেমা ‘মিশন এক্সট্রিম’ ঘোষনার পর থেকেই আলচিত। আগেই জানা গিয়েছিলো পুলিশ অ্যাকশন থ্রিলার গল্পে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। মোট দুই পর্বে নির্মিত সিনেমাটির প্রথম পর্বের ট্রেলার প্রকাশের পর থেকেই ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এছাড়া সিনেমাটিতে আরিফিন শুভর শারীরিক পরিবর্তন হয়ে থাকছে অন্যতম প্রধান আকর্ষন হিসেবে। ২০২০ সালে ঈদে মুক্তির কথা থাকলেও কয়েকবার পিছিয়ে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত এই সিনেমা। মুক্তির পর সিনেমাটি কি পেরেছে ভক্তদের অপেক্ষার প্রতিদান দিতে? পুলিশ থ্রিলার গল্পের সিনেমাটি দর্শকদের কতটা বিনোদন দিতে সক্ষম হয়েছে? আরিফিন শুভ এবং টিম কি পেরেছে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার মানকে ধরে রাখতে? ‘মিশন এক্সট্রিম’ রিভিউতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো আজকে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিনেমার গল্প শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গঠিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যকলাপের বর্ননা দিয়ে। জিহাদের নামে কিশোর বয়সের ছেলেদের বিভিন্ন জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহারের একটি পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে শুরু সিনেমাটির গল্প। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে বাংলাদেশেও একটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। ‘ফ্রি দ্যা ল্যান্ড ফর পিস’ নামের এই সংঘটন বিদেশী জঙ্গি সংগঠনগুলোর নজরে পরতে বাংলাদেশে কয়েকটি বড় ধরনের জঙ্গি হামলার প্রস্তুতি নেয়। আর এ কাজে ব্যবহার করার জন্য সংগঠনটির সদস্যরা কিশোর এবং তরুন ছেলেদের আত্মঘাতী হতে উদ্ভূত করে।
এদিকে বিছিন্ন কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে তদন্তে নামে বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘সিটিটিসি’। আর এই দলের নেতৃত্বে আছেন নাবিদ আল শাহরিয়ার (আরিফিন শুভ)। একটি ক্লুকে ধরে কয়েকটি সূত্র পায় নাবিদ। কিন্তু জঙ্গিদের নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কোড ব্যবহার করে তথ্য এবং নির্দেশনা আদানপ্রধান হয়ে থাকে। নাবিদের সাথে এই তদন্তে কাজ করছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সুমিত সেনগুপ্ত এবং ইরা (সাদিয়া আন্দালিব নাবিলা)। অন্যদিকে বাংলাদেশে এই জঙ্গি সংগঠনটির নেতৃত্বে আছে খালিদ (তাসকিন রহমান)। এরমধ্যে নাবিদকে একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন বহিষ্কৃত মাহবুব (শতাব্দী ওয়াদুদ)। মাহবুবের দেয়া একটি হুন্ডির তথ্যের সাথে বাংলাদেশে চলমান জঙ্গি হামলার একটি যোগসূত্র খোঁজে পায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
বেশ কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনা এবং কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতার করলেও এই হামলার পুরো পরিকল্পনা আর পিছনের পরিকল্পনাকারীরা অধরাই থেকে যায় পুলিশের কাছে। সিনেমাটির পরের গল্পটা এগিয়েছে এই জঙ্গি সংগঠনটির বিভিন্ন অপারেশনকে প্রতিহত করতে। যে কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘ফ্রি দ্যা ল্যান্ড ফর পিস’ সংগঠনটির নেতাকে খোঁজার নিয়ে ব্যস্ত থাকে পুলিশ তখন দেখা গেছে এই পুরো পরিকল্পনার পিছনে আছে দুবাইয়ে অবস্থানরত খান নামের এক মাষ্টার মাইন্ড। পুলিশ কি পারবে তাদের সব হামলা প্রতিহত করতে? এই ধারাবাহিক হামলার পরিকল্পনাকারীদের খোঁজে বের করতে কি নাবিদ সফল হবে? বিশাল ধামাকার জন্য কি পরিকল্পনা করছে জঙ্গিরা? নাবিদ এবং তার টিম কি পারবে এরকম একটি পরিকল্পিত এবং ভয়ংকর হামলা থেকে দেশকে বাঁচাতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে দেখতে হবে আপনাকে এই সিনেমাটি।
গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ সিনেমাটির গল্প এবং চিত্রনাট্য রচনা করেছেন সানি সানোয়ার। এর আগে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমাটির গল্প লিখেছিলেন সানী সানোয়ার। নিজের নামের প্রতি শতভাগ সুবিচার করেছেন তিনি। দুই পর্বের এই সিনেমাটির প্রথম পর্বের গল্প জুড়ে ছিলো প্রেক্ষাপট নির্মানের। পুলিশ থ্রিলার গল্প আরো একবার সবাইকে মুগ্ধ করেছেন সানী সানোয়ার। গল্পকে সাজাতে কয়েকভাগে ঘটনাগুলোকে সাজিয়েছেন তিনি। দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে একই ধারাবাহিক পথ অনুসরণ করে এগিয়েছে সিনেমাটির গল্প।
গল্পের মত সিনেমাটির চিত্রনাট্যেও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সানী সানোয়ার। প্রথম দৃশ্য থেকে পুলিশের বিভিন্ন অভিযানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে নিজের সেরাটা দিয়েছেন সানী। চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে সিনেমাটির প্রধান আকর্ষন হচ্ছে অ্যাকশন দৃশ্যগুলো। এছাড়া সিনেমাটির গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়েছে চিত্রনাট্য। আর চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে একটি দিক বেশ লক্ষণীয় ছিলো, তা হলো বিভিন্ন দৃশ্যে পণ্যের উপস্থাপনা। বেশ কয়েকটি পণ্যের উপস্থাপনা দেখা গেছে সিনেমাটিতে আর তীক্ষ্ণ চিত্রনাট্যে সেগুলো সুনিপুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই লেখক।
পরিচালনাঃ ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিনেমাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদ। এরকম একটি বিগ বাজেটের এবং স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সিনেমা নির্মানের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি থাকে। কিন্তু সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদের সুনিপুণ নির্দেশনা সিনেমাটিকে দিয়েছে এক অন্য রূপ। সিনেমাটির প্রতিটি চরিত্রকে নির্মাতারা সাজিয়েছেন দক্ষতার সাথে। সাধারণত অনেক অভিনেতা নিয়ে সিনেমা নির্মানের ক্ষেত্রে ক্ষত্র বিশেষে খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে, যা এই সিনেমায় দেখা যায়নি। ভালো নির্মাতার আরো একটি বিশেষ গুন থাকা প্রয়োজন সেটা হলো অতিরিক্ত হিরোইজম দেখাতে গিয়ে গল্পের ফোকাস থেকে সরে না যাওয়া। আরিফিন শুভকে পর্দায় উপস্থিতির পাশাপাশি ফোকাস না হারানোর বিষয়টি বেশ ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছেন এই নির্মাতা যুগল।
অভিনয়ঃ ‘মিশন এক্সট্রিম’ শুরু থেকেই আরিফিন শুভর সিনেমা। আর এরকম একটি বিগ বাজেটের সিনেমায় তার উপর নির্মাতাদের আস্থার প্রতিদান দিতে কোন কার্পোন্য করেননি এই অভিনেতা। পুরো সিনেমা জুড়ে দুর্দান্ত অভিনয় আর শারীরিক ভাষা দিয়ে সিনেমাটিকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছেন আরিফিন শুভ। ব্যাক্তিগতভাবে আমার ভালোলাগার মধ্যে রয়েছে আরিফিন শুভর অভিনয়ের দৃশ্যমান উন্নতি। রোম্যান্টিক দৃশ্যের প্রেমিকার সাথে খুনটুসি কিংবা সহকর্মীদের সাথে আন্তরিকতা সব কিছুতে সাবলীল ছিলেন আরিফিন শুভ। সিনেমাটিতে শুভর বিপরীতে অভিনয় করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী। চরিত্রের ব্যাপ্তি বিবেচনায় শুভর সাথে প্রেম, খুনসুটি এবং গান ছাড়া তার তেমন কিছুই করার ছিলো না।
জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশীর তুলনায় এই সিনেমায় ইরা চরিত্রে সাদিয়া নাবিলার অভিনয় উল্লেখযোগ্য। নাবিদের সার্বক্ষনিক সহকারী হিসেবে সবগুলো অপারেশনে সাথে ছিলো ইরা। এই চরিত্রে নাবিলার অভিনয় প্রশংসার দাবী রাখে। ব্যাক্তিগত জীবনের সাথে পেশাগত জীবনের বিরোধ এবং ভয়ংকর সব অপারেশনে জঙ্গিদের মোকাবেলায় সাবলীল ছিলেন নাবিলা। এছাড়া সিনেমাটিতে সুমিতও ভালো অভিনয় করেছেন। ইরার মত সুমিতের চরিত্রটিও ছিলো নাবিদের বিভিন্ন অপারেশনের সহযোগী। সিনেমাটি নবীন এই অভিনেতার জন্য গেম চেঞ্জার হতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
তাসকিন বরাবরের মতই ছিলেন দুর্দান্ত। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দিয়ে সিনেমার পর্দায় হাজির হওয়া এই অভিনেতা একই ধাঁচের চরিত্রে আবারো দর্শক মাত করেছেন। একটি জঙ্গি সংঘটনের নেতা হিসেবে যে কঠোরতা এবং প্রভাব বিস্তার করার মত অভিব্যাক্তি দরকার ছিলো সেখানে তাসকিন ছিলেন অনন্য। এছাড়া শতাব্দী ওয়াদুদ ছিলেন উল্লেখ করার মত। একজন বহিষ্কৃত পুলিশ কর্মাকর্তা হয়েও তার আগের দলের সাথে কাজ করতে দেখা গেছে তাকে। একজন শক্তিমান অভিনেতার পরিচয় আরো একবার দিলেন তিনি। এছাড়া মিজান, ইরেশ জাকের, ফয়জুর রহমান বাবু সহ একঝাক অভিনেতাকে দেখা গেছে বিভিন্ন চরিত্রে। এই প্রত্যেক অভিনেতাই তাদের নিজেদের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন।
চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনাঃ সিনেমাটিতে সুদীপ্ত মজুমদারের চিত্রগ্রহণ ছিলো চোখ জুড়ানো। এই সিনেমার বেশীরভাগ অংশের দৃশ্যধারন হয়েছে ঢাকাতে। সুদীপ্ত মুজুমদার তার কাজটি করেছেন অসাধারণ দক্ষতার সাথে। জঙ্গিদের পিছনে পুলিশের ধাওয়ার দৃশ্যগুলো উঠে এসেছে সুদীপ্তের ক্যামেরায় সুন্দরভাবে। অন্যদিকে দুই পর্বের এই সিনেমাটির প্রথম পর্বটি কাহিনী এবং প্রেক্ষাপট নির্মানের পিছনে গেছে। এরকম থ্রিলারধর্মী একটি গল্পকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলে পরের পর্বের জন্য দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখার ক্ষেত্রে সম্পাদনায় তীক্ষ্ণতা জরুরী ছিলো। গল্প এবং চিত্রনাট্যের তুলনায় এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আছে সিনেমাটির সম্পাদক কামাল।
উপসংহারঃ ‘মিশন এক্সট্রিম’ ঢালিউডের সিনেমার বাণিজ্যিক নতুন দিনের শুভ যাত্রা। দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমাদের আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা এটি। গল্প, চিত্রনাট্য, পরিচালনা এবং অভিনয়ের একটি পরিপূর্ন প্যাকেজ ‘মিশন এক্সট্রিম’। উপসংহারে একটি কথা বলতে চাই, এই প্রথম বাংলাদেশের কোন সিনেমার একটি দৃশ্যে হলভর্তি মাল্টিপ্লেক্স দর্শকদের করতালির অভিজ্ঞতা পেলাম। ভালো সিনেমার অভাব বলে হা-হুতাশ না করে ভালো সিনেমাকে সমর্থনের জন্য সিনেমাটি দেখা উচিৎ সবার। এছাড়া সিনেমাটির সার্বিক দিক বিবেচনায় সাম্প্রিতক সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত অন্যতম সুনির্মিত সিনেমা ‘মিশন এক্সট্রিম’। A MUST WATCH AND SURESHOT ENTERTAINMENT!
আরো পড়ুনঃ
নো টাইম টু ডাই রিভিউ
সুরিয়াবংশী রিভিউ
রেহানা মরিয়ম নূর রিভিউ