চলচ্চিত্রের নামঃ বাহুবলী – দ্যা কনক্লোশন (২০১৭)
মুক্তিঃ ২৮শে এপ্রিল ২০১৭
অভিনয়েঃ প্রবাশ, রানা দাজ্ঞুবাতি, আনুশকা শেঠী, তামান্না ভাটিয়া, সত্যরাজ, রামিয়া ক্রিশনান, নাসার প্রমুখ।
পরিচালনাঃ এস এস রাজামৌলী
প্রযোজনাঃ অর্ক মিডীয়া ওয়ার্ক্স
পরিবেশনাঃ ইরস অস্ট্রেলিয়া, সাউদার্ন স্টার ইন্টারন্যাশনাল, গ্রেট ইন্ডিয়া ফিল্মস
কাহিনি ও চিত্রনাট্যঃ এস এস রাজামৌলী
সংলাপঃ অমঙ্কুম্বু গোপালাক্রিস্নান (মালায়ান), মাধান কারকি (তামিল), সি এইচ বিজয় কুমার (তেলেগু), মানজ মুন্তাসির (হিন্দি)
সম্পাদনাঃ ভেঙ্কাটেশরা রাও, কোটাগিরি, বিকিন্না, তাম্মিরাজু
চিত্রগ্রহনঃ সেনতিল কোমার
সংগীতঃ এম এম কেরাভানী
প্রারম্ভিক কথাঃ ২০১৫ সালে এস এস রাজামৌলীর পরিচালনায় ভারতজুড়ে আলোড়ন তুলা ছবি ছিলো ‘বাহুবালী – দ্যা বিগিনিং’। সিনেমা কাহিনী, নির্মান শৈলী, স্পেশাল ইফেক্ট সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা হয়ে উঠে ‘বাহুহালী’। দক্ষিণের তারকাদের নিয়ে নির্মিত এই সিনেমা শুধু হিন্দি মার্কেটেই ১০০ কোটির উপরে আয় করে।
প্রথম পর্ব মুক্তির পর থেকেই সিনেমাটির দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আগ্রহের পারদ আকাশচুম্বী। এই আগ্রহের কারন মূলত বাহুহালী এবং কাটাপ্পা নামক দুইটি চরিত্রকে ঘীরে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখানো হয়, নিজের সবচেয়ে আপন মানুষ কাটাপ্পার তলোয়ারের আঘাতে খুন হন বাহুবালী। এর পর থেকেই গত দুই বছর ধরে সিনেমাপ্রেমীদের মনে একটাই প্রস্ন, ‘কাটাপ্পা বাহুবলীকে কেনো খুন করেছিলো?’ এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গত ২৮শে এপ্রিল বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটির দ্বিতীয় পর্ব ‘বাহুবালী – দ্যা কনক্লোশন’।
কাহিনী সংক্ষেপঃ সিনেমার প্রথম পর্ব যেখানে শেষ হয় ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয় ‘বাহুবলী – দ্যা কনক্লোশন’ এর গল্প। অর্থাৎ, নিজের আত্নপরিচয় এবং অমরনাথ বাহুবালীর ব্যাপারে জানতে পারে শিভা। জানতে পারে মহেশপাতি সাম্রাজ্যের অভিপতি অমরনাথ বাহুবালীই তার পিতা। সেখান থেকে গল্প আরো কিছুটা বিস্তারিত হয়ে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং মহেশপাতি সাম্রাজ্য নিয়ে যুদ্ধ এবং খেলার ঘটনা সামনে আসে।
গল্পে দেখা যাবে, মাহেশমাতি সাম্রাজ্যের পরবর্তি রাজা হিসেবে অমরনাথ এর নাম ঘোষণা করেন সিভাগামি। রাজার দায়িত্ব নেওয়ার আগে রাজ্যের মানুষের ব্যাপারে আরো গভীরভাবে জানতে এবং বুঝতে তাকে রাজ্য একটু ঘুরে দেখতে বলা হয়। এই রাজ্য ভ্রমনের সময়ই অমরনাথের সাথে দেঝা হয় দেবসেনার। দেবসেনা (আনুশকা শেঠী) একজন সাহসী এবং তলোয়ার চালাতে পারদর্শি রাজকন্যা। দেবসেনার সৌন্দর্য এবং যুদ্ধের পারদর্শিতা দেখে তার প্রেমে পড়েন অমরনাথ।
এদিকে সিভাগামির পক্ষ্য থেকে দেবসেনার কাছে যখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়, দেবসেনা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং সোনাসহ অন্যান্য উপহার সামগ্রী গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানান। যদিও বাহুবলী মনে করেছিলেন সিভাগামি তার জন্য দেভসেনার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, আসলে তা ছিলো সিভাগামির নিজের ছেলে বল্লালদেভার জন্য।
দেবসেনার এইরূপ ব্যবহার সিভাগামির একদমই পছন্দ হয়নি, তাই তিনি দেবসেনাকে গ্রেফতার করে মাহেশমাতিতে নিয়ে আসার আদেশ দেন। এই সময় বাহুবালী দেবসেনার পক্ষ্য হয়ে কথা বলতে গেলে বাহুবালী-দেবসেনার প্রেমের বিষয় সবার সামনে চলে আসে। বল্লালদেভার জন্য সিভাগামির পাঠানো দেবসেনার সাথে বিয়ের প্রস্তাবের প্রতি সম্মান জানাতে বাহুবালী মাহেশপাতি সাম্রাজ্যের রাজার পদ থেকে সরে দাঁড়ান। বাহুবলীর এই সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে বল্লালদেভা মাহেশমাতি সাম্রাজ্যের রাজা হিসেবে আসন গ্রহন করেন।
এখান থেকেই গল্পের মোড় ঘোরতে শুরু করে এবং সেই ঐতিহাসিক প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগিয়ে যায় গল্প। কেনো কাটাপ্পা বাহুবলীকে হত্যা করেছিলো? কেনো শিবা/মহেন্দ্রকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিয়েছিলো?
চিত্রনাট্য: বাহুবলী সিনেমার প্রথম পর্বের পর থেকেই সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ আকাশচুম্বী। এই প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের চিত্রনাট্য রচনা করেন এস এস রাজমৌলী। এবং সন্দেহাতীত ভাবে সময়ের অন্যতম সেরা চিত্রনাট্যের অন্যতম সফল উদাহরণ বাহুবলী, যেখানে দর্শকদের সগ্রহ ধরে রাখতে সক্ষম চিত্রনাট্যকার।
সিনেমায় চিত্রনাট্যের প্রথম অর্ধেক আসলে গল্পের একটা ভিত্তি তৈরি এবং ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসার জন্য কেটেছে। কাটাপ্পার কঠিন এবং দায়িত্বের প্রতি একনিষ্ঠ চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কৌতুকধর্মী বিষয়গুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা চিত্রনাট্যে বেশ ভালোভাবেই করা হয়েছে।
ছবিতে দেবসেনার চরিত্র তার যৌবন থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সময়ের ব্যবধান চিত্রনাট্যে অন্যন্ত দক্ষতার সাথেই করা হয়েছে। বিশেষ করে দেবসেনাকে মাহেশমাতিতে নিয়ে আসার পর কোর্ট সেশনে চিত্রনাট্যের বেশ শক্ত অবদান পরীক্ষিত করবেন দর্শকরা। একটি দৃশ্যে বাহুবলী যখন বলেন ‘যো আওরতাকি ইজ্জত পে হাত ঢালে, উসকা হাত নেহি সার (মাথা) কাটনা চাহিয়ে’! এই Larger Than Life সংলাপে হল ভর্তি দর্শক তালি দিবেন এটা খুবই স্বাভাবিক।
এছাড়াও রাজমাতা সিভগামির মুখোমুখি হওয়ার সময় দেবসেনার আত্নবিশ্বাস এবং রাজমাতার সাথে যুক্তি তর্কের অংশে চিত্রনাট্যের অবদান চোখে পড়ার মত। এছাড়াও সিনেমার প্রথম অর্ধেক জুড়ে বেশ কিছু টুইস্ট দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলো চিত্রনাট্যে অতন্ত্য দক্ষতার সাথে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন।
কিন্তু সিনেমাটির এই পর্বের সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন “কাটাপ্পা বাহুবলীকে কেনো হত্যা করেছিলো?” – তার উত্তর পাওয়া যাবে সিনেয়ার দ্বিতীয় ভাগে। বিরতির পরেই আসলে দর্শকরা সিনেমার বর্তমানকে দেখতে পাবেন। দেবসেনা নিজের সন্তানকে দেখতে পাবেন। দ্বিতীয় ভাগের মুটোমুটি পুরটা জুড়েই থাকবে একশন এবং আবেগের দাপট।
পুরোপুরি রহস্য বা টুইস্ট নির্ভর একটি সিনেমায় চিত্রনাট্য যেমন শক্তিশালী হওয়া দরকার ‘বাহুবালী – দ্যা কনক্লোশন’ এর চিত্রনাট্য সেরকমই টানটান এবং আকর্ষনীয়।
পরিচালনাঃ সিনেমাটি নিয়ে ভারতজুড়ে তথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয় সিনেমা দর্শকদের উত্তেজনা বিবেচনা করলে এটা সুস্পষ্ট যে এই সিনেমা পরিচলনায় প্রত্যাশার চাপ আগের পর্বের থেকে অনেক বেশী। সিনেমায় প্রবাসের বাহুবলী রুপে হিরোইটিক এন্ট্রি দিয়ে পরিচালক রাজমৌলী বুঝিয়ে দিয়েছেন কেনো তিনি সেরাদের সেরা। মাহেশমাতি সাম্রাজ্যের ঔতিহাসিক এবং রহস্যঘেরা দৃশ্যের উপস্থাপনায় পরিচালক হিসেবে রাজমৌলীর মুন্সিয়ানার ছাপ সুস্পষ্ট। রাজ্য হিসেবে মাহেশমাতিকে যেমন সুন্দর এবং সাজানো দেখিয়েছেন তেমনি দেবসেনার রাজ্য কুন্ঠালকেও উঠিয়ে এনেছেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য হিসেবে।
পরিচালক হিসেবে রাজমৌলীর বুদ্ধিমত্তার অন্যতম প্রধান স্বাক্ষর হয়ে থাকবে প্রবাশ এবং রানার মুখোমুখি লড়াইয়ের দৃশ্যটি। আর নারিকেল গাছ দিয়ে দৃশ্য ধারনের এই কাজ সম্ভবত দক্ষিণের সিনেমায় সম্ভব (বিস্তারিত জানতে ছবিটি দেখতে হবে)।
বিশেষ করে বাহুবলী এবং দেবসেনার তীরের দৃশ্যটি এই ছবিতে পরিচালক রাজমৌলীর অন্যতম সফল একটা স্বাক্ষর। সামগ্রিকভাবে যেকোন বিবেচনায়ই প্রথম পর্বের চেয়ে দ্বিতীয় পর্ব আকর্ষনীয় এবং চমকপ্রদ। পরিচালক হিসেবে রাজমৌলী এই ছবি দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন নিজের এবং ভারতের অন্য যেকোন পরিচালককে।
অভিনয়: বাহুবলী সিনেমার অন্যতম প্রধান উপাধান সিনেমার প্রধান চরিত্র রুপদানকারী কুশীলবরা। পুরো সিনেমাজুড়ে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা তারকারা নিজেদের উজাড় করে অভিনয় করেছেন। প্রবাশ তার স্ক্রিনে উপস্থিতি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাহুবলী চরিত্রে তার কোন বিকল্প কেনো নেই। দুইটি চরিত্রে তার পর্দা উপস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে প্রশংসার দাবী রাখে। আর প্রবাশকে চ্যালেঞ্জ করা চরিত্রে রানার অভিনয়ও নজর কাড়তে বাধ্য।
এই পর্বের প্রধান নারী চরিত্র রুপদানকারী আনুশকা শেঠী তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় উপহার দিয়েছেন এই সিনেমায়। কাহিনীর প্রয়োজনে যেখানে স্বচ্ছতা দরকার, যেখানে শক্তি দরকার – তিনি পর্দায় সেভাবেই উপস্থিত ছিলেন। তামান্না এই সিনেমায় সীমিত স্কিনে ছিলেন তাই তার তেমন অভিনয়ের সুযোগ ছিলোনা। অন্যদিকে মহেশমাতির রাজমাতা হিসেবে রামায়া ক্রিশনান ছিলেন স্বপ্রতিভ এবং উজ্জ্বল। সত্যরাজ এবং নাসের তাদের নিজেদের চরিত্রে যতেষ্ঠ শক্তিশালী অভিনয় করেছেন।
উপসংহারঃ সামগ্রিকভাবে ‘বাহুবলী – দ্যা কনক্লোশন’ পুরোপুরি আলাদা একটি দুনিয়াতে অন্যরকম কিছু চরিত্রের সাথে আপনার সফল এক পরিভ্রমন। দুই বছরের অপেক্ষা এবং অসংখ্য সম্ভাবনার শেষ উত্তর পেতে এই সিনেমাটি যেকোন সিনেমা দর্শকের জন্য একটি MUST WATCH সিনেমা। বক্স অফিসের রেকর্ড ভাঙ্গার পাশাপাশি নির্মল বিনোদনের এক অব্যার্থ আয়োজন রাজমৌলীর এই সিনেমা। গল্পের গাঁথুনি, চিত্রনাট্যের পরিপক্কতা, অসাধারণ সব দৃশ্য এবং দৃশ্যায়ন, একশন, আবেগ – সবমিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা Larger than Life সিনেমা। এই সিনেমা আপনি দেখলে আপনি তুষ্ট হবেন, আপনি সমৃদ্ধ হবেন। সিনেমার মাধ্যমে অন্য এক দুনিয়া ভ্রমনের সুযোগ পাবেন। আর বক্স অফিস রিপর্টের কথা বললে – EPIC BLOCKBUSTER!!!