চলচ্চিত্রের নামঃ বেলবটম (২০২১)
মুক্তিঃ আগস্ট ১৯, ২০২১
অভিনয়েঃ অক্ষয় কুমার, লারা দত্ত, ভানি কাপুর, হুমা কুরেশি, আদিল হোসেন, ডেঞ্জিল স্মিথ, অনিরুদ্ধ দেব প্রমুখ।
পরিচালনাঃ রঞ্জিত এম তিওয়ারি
প্রযোজনাঃ পূজা এন্টারটেইনমেন্ট এবং এমি এন্টারটেইনমেন্ট
পরিবেশনাঃ পেন মারুধার এন্টারটেইনমেন্ট
কাহিনীঃ ভাসু বাগনানি, অসীম আরোরা এবং পারভেজ শেখ
চিত্রনাট্যঃ অসীম আরোরা এবং পারভেজ শেখ
সম্পাদনাঃ চন্দন অরোরা
চিত্রগ্রহনঃ রাজীব রাভি
প্রারম্ভিক কথাঃ গত বছর করোনা মহামারী শুরুর পর বলিউডের অন্যতম আলোচিত সিনেমা অক্ষয় কুমারের ‘বেলবটম’। মহামারী চলাকালীন সময়েই সিনেমাটির দৃশ্যধারন শুরু হয় এবং এর মধ্যেই নির্মাতারা শেষ করেন সিনেমাটির কাজ। একটি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমাটি চলতি বছরের শুরুতে মুক্তির কথা থাকলেও করোনার দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাবের কারনে একাধিকবার পিছিয়ে যায় সিনেমাটির মুক্তি। সর্বশেষ ১৯শে আগস্ট সীমিত পরিসরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় অক্ষয় কুমারের বহুল প্রতীক্ষিত এই সিনেমা। সীমিত পরিসরে কারন মহারাষ্ট্রে এখনো প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি দেয়নি রাজ্যটির সরকার। তবে চলমান পরিস্থিতিতে সিনেমাটির প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সাহসী সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রেক্ষাগৃহ মালিক এবং প্রদর্শকরা। তাহলে কেমন হলো করোনা পরবর্তী নতুন সময়ে মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে বড় বাজেটের এই সিনেমা? দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু সফল হলেন বলিউডের খিলাড়ি? আজকের এই রিভিউতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।
কাহিনী সংক্ষেপঃ আশির দশকের শুরুতে ভারতের একটি উড়োজাহাজ অপহরণের ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। ১৯৮৪ সালে ২৪শে আগস্ট দিল্লি থেকে আইসিসি ৬৯১ ফ্লাইটটি অপহরণ হয়। এই ঘটনাটি সেসময়ে ৭ বছরের মধ্যে পঞ্চম অপহরণের ঘটনা ছিলো। অপহরণের পর উড়োজাহাজটি পাকিস্থানের লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পাকিস্থান কতৃপক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর (লারা দত্ত) কাছে অপহরণকারীদের সাথে সমঝোতার জন্য প্রস্তাব দেয়। এর আগের চারটি অপহরণের ঘটনায়ও একইভাবে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতা করেছিলো পাকিস্থান সরকার। ইন্দিরা গান্ধী সমঝোতার আলোচনার অনুমতি দিতে চাইলে তাকে সেটা না করার অনুরোধ করেন রো এজেন্ট আনশুল মালহোত্রা ওরফে বেলবটম (অক্ষয় কুমার)।
বেলবটম এই অপহরণের পিছনে পাকিস্থানের আইএসআই’র যোগসূত্র রয়েছে বলে উল্লেখ করে। এর আগে এরকম একটি উড়োজাহাজ অপহরণের সাথে বেলবটমের একটি ব্যাক্তিগত সমীকরণ থাকার কারনে অপহরণ সংক্রান্ত বিষদ গবেষণা রয়েছে তার। কিন্তু বেলবটমের এই মতামতকে উড়িয়ে দেন ইন্দিরা গান্ধী এবং তার টিম। কিন্তু পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী বেলবটমের কথামত পাকিস্থানের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকের মধ্যস্থতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এর প্রেক্ষিতে অপহরণকারীরা উড়োজাহাজটি লাহোর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে নিয়ে যায়। আর ভারত তাদের রো’র একটি দল সে দেশে পাঠায় আটকে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য। এরমধ্যে উক্ত উড়োজাহাজে আইএসআই তাদের নিজেদের একজনকে পাঠায় যে কিনা আগের অপহরণের সাথেও জড়িত ছিলো।
এরপরের গল্পটা সেই কোবার্ট অপারেশনের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের। উড়োজাহাজ অপহরণের সাথে বেলবটমের ব্যাক্তিগত সেই সমীকরণটি আসলে কি ছিলো? মধ্যপ্রাচ্যের উক্ত দেশটি কি রো’র সেই দলকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান করবে? বেলবটম কি পারবে এরকম একটি আত্নঘাতি সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমান করতে? এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আপনাকে দেখতে হবে সিনেমাটি।
গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ আগেই বলেছি ‘বেলবটম’ সিনেমাটি একটি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। কিন্তু বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে হলেও সিনেমাটিতে রো’র কোবার্ট অপারেশনকে সিনেমার আদলেই দেখানো হয়েছে। বাস্তবিকভাবে সেই উড়োজাহাজ অপহরণের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন আরব আমিরাতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিজে। কিন্তু ‘বেলবটম’ সিনেমায় নির্মাতারা শেষের দিকে কাহিনীকে অন্যভাবে পর্দায় নিয়ে এসেছেন, যেখানে হিরোইজমকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তবে এই পরিবর্তন স্বত্বেও সিনেমাটি গল্প অনেকটাই সরল সমীকরণ মেনে এগিয়ে গেছে এবং প্রতিটি দৃশ্য যতেষ্ট অনুমেয় ছিলো।
সার্বিক বিবেচনায় গল্পের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকবে অসীম আরোরা এবং পারভেজ শেখের চিত্রনাট্য। প্রসঙ্গত সিনেমাটির গল্পও লিখেছেন অসীম আরোরা এবং পারভেজ শেখ। চিত্রনাট্য গল্পের তুলনায় ভালো হলেও সিনেমাটির সাথে দর্শককে ধরে রাখতে পারার মত শক্তিশালী ছিলো না। সিনেমাটির ধরন বিবেচনায় আনলে চিত্রনাট্য আরো অনেক বেশী ধারালো এবং টুইস্টপূর্ন করা সম্ভব ছিলো। গল্পের মত অনেক ক্ষেত্রেই একদম সরল সমীকরণ মেনে এগিয়ে গেছে চিত্রনাট্য। দর্শকদের চিন্তার বা অবাক হওয়ার কোন উপদান ছিলো না এই চিত্রনাট্যে, যেটা অক্ষয় কুমারের ‘বেবি’ সিনেমাতে পাওয়া গিয়েছিলো।
পরিচালনাঃ বড় পরিসরে এবং বড় তারকাকে নিয়ে পরিচালক রঞ্জিত এম তিওয়ারির এটিই প্রথম সিনেমা। এর আগে এই নির্মাতা ‘লখনউ সেন্ট্রাল’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন। তবে সেই সুযোগটি নষ্ট করলেন এই নির্মাতা। দূর্বল চিত্রনাট্যের সাথে রঞ্জিত তিওয়ারির দুর্বল নির্মান সিনেমাটিতে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। করোনা মহামারীর কারনে সম্পূর্ন সিনেমার দৃশ্যধারন করা হয়েছে লন্ডনে। সেখানে দুবাই এয়ারপোর্ট এবং সে দেশের কর্মকর্তাদের কথায় এবং পোশাকে নির্মাতার যতেষ্ট হোম ওয়ার্কের অভাব দেখা গেছে। এছাড়া অক্ষয় কুমারের হিরোইজমকে প্রাধান্য দিতে দিয়ে সিনেমার গল্পের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ন বেশ কিছু দৃশ্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। সর্বপরি, নির্মাতা হিসেবে রঞ্জিত তিওয়ারির অপরিপক্ষতা ফুটে উঠেছে সিনেমাটিতে।
অভিনয়ঃ সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অক্ষয় কুমার। অক্ষয় কুমারের অভিনয় বরাবরের মতই ভালো ছিলো। বিশেষ করে ‘বেবি’ এবং ‘এয়ারলিফট’ সিনেমার পর এই জেনারে নিজের গ্রহণযোগ্যতা আরো একবার প্রমান করেছেন এই তারকা। তবে সেই সিনেমায় তার অভিনয়কে ভালো অভিনয়ের বেশী কিছু বলা যাচ্ছেনা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো সিনেমায় লম্বা সময় ধরে মনে রাখার মত অভিনয় করতে দেখা গেছে। তবে ‘বেলবটম’ সিনেমার ক্ষেত্রে তার অভিনয় ভালো বলা গেলেও স্মরণীয় বলা যাচ্ছে না।
সিনেমাটির অন্য প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন লারা দত্ত। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমাটির ট্রেলার প্রকাশের পর ইন্দিরা গান্ধী চরিত্রে লারা দত্তের লুক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শোনা গেছে। সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী এই চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন লারা দত্ত। অন্যদিকে সিনেমাটিতে অক্ষয়ের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ভানি কাপুর। পর্দা উপস্থিতি এবং গুরুত্বের দিক থেকে চরিত্রটিতে ভানির তেমন কিছু করার ছিলো না। সিনেমাটির শেষে এসে ভানির চরিত্রটিকে গুরুত্বপূর্ন করার কিছুটা চেষ্টা করেছেন নির্মাতা তিওয়ারি।
সিনেমাটিতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন হুমা কুরেশি। অল্প কয়েকটি দৃশ্যে দেখা গেছে হুমাকে। নিজের জায়গায় মোটামুটি চলনসই ছিলেন এই অভিনেত্রী। এছাড়া সিনেমাটির অন্যতম প্রধান অপহরণকারী চরিত্রে আদিল হোসেন ভালো অভিনয় করেছেন। এছাড়া সিনেমাটির অন্যান্য চরিত্রে অভিনয়কৃত শিল্পীরা নিজেদের জায়গায় মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনা মোটামুটি মানের ছিলো। বিশেষ করে সম্পাদনার ক্ষেত্রে সিনেমাটির প্রথম অর্ধেককে আরো উপভোগ্য করার সুযোগ ছিলো। অক্ষয় কুমারের অতীতকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে লম্বা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। আর সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ নিয়ে আলাদাভাবে বলার কিছু নেই।
উপসংহারঃ সর্বপরি অনুমানযোগ্য গল্প আর চিত্রনাট্যে হিরোইজমের সরল সমীকরনের সিনেমা ‘বেলবটম’। ‘বেবি’, ‘এয়ারলিফট’, ‘হলিডে’, ‘স্পেশাল ২৬’ সিনেমাগুলোর অভিজ্ঞতার প্রত্যাশা নিয়ে আপনি যদি সিনেমাটি দেখেন তাহলে হতাশ হবেন। আর যদি আপনি অক্ষয় কুমার এবং তার হিরোইজমের অন্ধ ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে দেখতে পারেন ‘বেলবটম’।
আরো পড়ুনঃ
মিমি রিভিউ
কোল্ড কেস রিভিউ
ট্যাংরা ব্লুজ রিভিউ