চলচ্চিত্রের নামঃ দৃশ্যাম ২ (২০২১)
মুক্তিঃ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২১ (আমাজন প্রাইম ভিডিও)
অভিনয়েঃ মোহনলাল, মীনা, ইস্টার অনিল, আনসিবা, আশা শরৎ, মোরালি গুপী, অজিত কুট্টাকুতুললাম প্রমুখ।
পরিচালনাঃ জিতু জোসেফ
প্রযোজনাঃ আশীর্বাদ সিনেমাস
পরিবেশনাঃ আমাজন প্রাইম ভিডিও
কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ জিতু জোসেফ
সম্পাদনাঃ ভি এস বিনায়েক
চিত্রগ্রহনঃ সতীশ কুরুপ
সংগীতঃ অনিল জনসন
প্রারম্ভিক কথাঃ ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মালায়লাম মেগাষ্টার মোহনলাল অভিনীত সিনেমা ‘দৃশ্যাম’ বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবসা সফল সিনেমা ছিল। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে সিনেমাটি তামিল, তেলুগু, কন্নড় এবং হিন্দি ভাষায় পুননির্মান করা হয় এবং সিনেমাগুলো সমানভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র জর্জকুট্টি মোহনলাল অভিনীত অন্যতম আইকনিক চরিত্রে পরিণত হয়। এরপর সাত বছর পর নির্মাতা জোসেফ একই শিল্পীদের নিয়ে নির্মান করেন সিনেমাটির সিক্যুয়েল ‘দৃশ্যাম ২’। ওটিটি প্লাটফর্ম আমাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি কি প্রথম পর্বের মোট দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? এই রিভিউতে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্ঠা করব আমরা।
কাহিনী সংক্ষেপঃ আগের সিনেমাটি যেখানে শেষ হয়েছিল ঠিক সেখান থেকে ভিত্তি রচনা হয়েছে এর দ্বিতীয় পর্ব ‘দৃশ্যাম ২’। আমরা জানি যে, একটি নির্মানাধীন দালানের নিচে জর্জকুট্টি বরুনের লাশটি মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছিলো আর তার এই বুদ্ধিদীপ্ত কাজের কারনে পুলিশের হাত থেকে নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় জর্জ। তবে প্রথম পর্বে যা দেখা যায়নি সেটা হচ্ছে বরুনের লাশ মাটিচাপা দেয়ার সময় সেটা দেখে ফেলে জোস নাম একজন। কিন্তু ঘটনার আধা ঘণ্টা পর একটি খুনের মামলায় গ্রেফতার হয় জোস।
এরমধ্যে কেটে গেছে ছয় বছর। জর্জ এখন একটি প্রেক্ষাগৃহের মালিক এবং তার বড় মেয়ে আনু শহরের সেরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী। গত ২/৩ বছর ধরে জর্জ একটি সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করছে এবং এখন সে এই চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে একটি সিনেমা নির্মানের চিন্তা করছে। অন্যদিকে আনু বরুনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে এখনো পুরোপুরি নিজেকে সামলে নিতে পারেনি। এরমধ্যে জর্জের শহরে আগমন ঘটে নতুন একজন আইজির, যিনি এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব নেন। একসময় তিনি বরুনের সাথে ঘটে যাওয়া গোপন সেই ঘটনার সত্যতা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এবার জর্জ কি পারবে তার পরিবারকে রক্ষা করতে? এত বছর পর জেগে উঠা এই ঘটনা জর্জ কিভাবে সামলাবে? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ‘দৃশ্যাম ২’ সিনেমায় জর্জের নতুন অভিযান।
চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ নির্মাতা জোসেফ নিজেই লিখেছেন সিনেমাটির কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ। প্রথম পর্বের মত পরিপূর্ন বা টানটান না হলেও কিছু কিছু জায়গা ছাড়া সামগ্রিকভাবে জোসেফের লিখা গ্রহনযোগ্য ছিল বলা যায়। একটি ক্রাইম থ্রীলারকে কয়েকটি ধাপে ভেঙে ভেঙে পর্দায় হাজির করার চেষ্টা করেছেন জোসেফ। অনেকগুলো ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করে সিনেমাটির পুরো গল্পকে একটা জায়গায় নিয়ে আসার মাধ্যমে ক্লাইমেক্সের দিকে এগিয়েছে ‘দৃশ্যাম ২’ সিনেমার গল্প। জর্জের এই ‘মাষ্টারমাইন্ড’ হয়ে ওঠার গল্পকে প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ঠ সময় নিয়েছেন জোসেফ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের দুর্বলতার কারনে জর্জের পরিকল্পনার কিছু অংশ অযৌক্তিক মনে হতে পারে। সিনেমাটির চিত্রনাট্যকে আরো ভালো করা যেত এইসব ক্ষেত্রে। সিনেমাটির প্রথম ভাগের পুরোটাই আগের ঘটনার কারনে জর্জ এবং তার পরিবারের মনের মধ্যে ভয়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেহেতু আগের পর্বে এই ঘটনার বিস্তারিত ছিলোই সেক্ষেত্রে জোসেফ মনে হয় এই জায়গাতে কিছুটা সংযত হতে পারতেন। দ্বিতীয় ভাগে আবার টানটান উত্তেজনার আচঁ পাওয়া গেছে। অনেকগুলো ছোট ছোট ঘটনাকে একসাথে করে সিনেমার প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরা হয়েছে।
‘দৃশ্যাম’ সিনেমার চিত্রনাট্যের অন্যতম প্রধান দিক ছিল সিনেমার চরিত্রগুলোর উপস্থাপন। প্রত্যেকটি চরিত্রই এখানে একটু গ্রে-ভাবে দেখানো হয়েছিল। নিজের পরিবারকে বাঁচাতে একজন স্বামী/বাবা যেকোন কিছু করতে রাজী। সিনেমা দেখা যার একধনের নেশা সে সিনেমার জ্ঞান ব্যবহার করে খুনের দায় থেকে স্ত্রী-সন্তানকে মুক্ত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যায়। অন্যদিকে একমাত্র ছেলেকে খোঁজে বের করতে নিজেকে ভিলেনের রুপে আবির্ভুত করেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা মা। কিন্তু এর সিক্যুয়েলে চরিত্রগুলোর এই ধরণটার প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারেননি এর লেখক জেসেফ।
পরিচালনাঃ প্রথম পর্বে জোসেফের পরিচালনায় যে তীক্ষ্ণতা ছিলো এর সিক্যুয়েলে এসে দর্শকরা সেটা থেকে কিছুটা বঞ্চিত হয়েছেন। সিনেমাটিতে তার সমস্ত মনোযোগ জর্জ এবং তার পরিবারের প্রতি হওয়ার কারনে সিনেমার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর যথাযত ব্যাপ্তি হয়ে উঠেনি। বরুন হত্যা মামলার প্রতক্ষ্যদর্শী জোসকে সঠিকভাবে দেখানো হয়নি। এছাড়া সিনেমার প্রথম অর্ধেকে তার পরিবারকে দেখানো হলেও পরে এর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একই কথা জর্জের প্রতিবেশী সাবিত্রী এবং সাবুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অভিনয়ঃ সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে মোহনলাল বরাবরের মত অসাধারন। তেমন কোন সংলাপ ছাড়াই নিজের অভিব্যক্তি আর কাজের মাধ্যমেই নিজের পরিকল্পনা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। নিজের মেয়েকে চিন্তিত মায়ের চরিত্রে মিনাও ভালো অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে আনু চরিত্রটি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই চরিত্রের অভিনেত্রী।
অন্যান্য পার্শ্ব অভিনেতা-অভিনেত্রী যেমন নেশাগ্রস্থ এক মানুষ সাবু (সুমেশ চন্দ্রান) এবং তার স্ত্রী সাবিত্রী (অঞ্জলি নায়ার) ভালো অভিনয় করেছেন। এছাড়া খুনের মামলার আসামী জোস (অজিত কথাকুট্টুললাম) এবং তার স্ত্রী রানী নিজেদের চরিত্রে ঠিকঠাক ছিলেন। এছাড়া বরুনের বাবা-মাকেও নিজেদের ছেলের লাশের সন্ধান পাওয়া এবং শেষকৃত্যের আশায় আমেরিকা থেকে ফেরত আসতে দেখা গেছে। যদিও চরিত্রের ব্যাপ্তি সীমিত ছিল তবুও নিজের উপস্থিতিতে ভালো অভিনয় করেছেন মুরালি গোপী।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ সতীশ কুরুপের চিত্রগ্রহন মোটামুটি ছিলো। জর্জের পরিবারের আনন্দঘন একান্ত মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরাবন্ধীতে দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। এছাড়া জর্জের বাইরে যাওয়া আসার সময়ে ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরার ব্যবহার শহরকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনে সাহায্য করেছেন। অন্যদিএক ভি এস বিনায়েকের সম্পাদনাতে কিছুটা দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে সিনেমাটির প্রথম ভাগের সম্পাদনা আরো টাইট করা সম্ভব ছিল বলে মনে হয়েছে।
উপসংহারঃ প্রথম পর্বে জর্জ এবং পুলিশের মধ্যকার যে দন্ধ সিনেমাটিকে উত্তেজনাকর করেছিলো দ্বিতীয়পর্বে এসে মুরালি গোপীর সাথে সেটা অনুপস্থিত। সে হিসেবে ‘দৃশ্যাম’ সিনেমার সিক্যুয়েল হিসেবে ‘দৃশ্যাম ২’ অবশ্যই কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলার মত ছিল। তবে আগেরটার মোত দ্বিতীয় পর্বেও মোড় ঘুরিয়ে দেয়া টুইস্টের জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে শেষ পর্যন্ত। সর্বপরি দর্শকদের প্রত্যাশার কিছুটা প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যাবে এই সিনেমায়। আর মোহনলাল বরাবরের মতই আপনার ভালোলাগাতে একটা অনবদ্য আলোড়ন তুলবেন।
আরো পড়ুনঃ
দক্ষিনের দখলে ভারতীয় সিনেমার বাজার: নিয়মিত নতুন নতুন ঘোষনা
কবে মুক্তি পাচ্ছে মোহনলাল অভিনীত ‘আরাত্তু’? জেনে নিন বিস্তারিত