চলচ্চিত্রের নামঃ ট্যাংরা ব্লুজ (২০২১)
মুক্তিঃ এপ্রিল ১৫, ২০২১
অভিনয়েঃ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, মধুমিতা সরকার, সামিউল আলম, ঐশিনী দে, ঋষভ বসু এবং আত্মদীপ ঘোষ প্রমুখ।
পরিচালনাঃ সুপ্রিয় সেন
প্রযোজনাঃ শ্রীকান্ত মহতা এবং মহেন্দ্র সোনি
পরিবেশনাঃ শ্রী ভেংকেটাস ফিল্মস
কাহিনীঃ সুপ্রিয় সেন
চিত্রনাট্যঃ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং সুপ্রিয় সেন
সম্পাদনাঃ সুমিত চৌধুরী
চিত্রগ্রহনঃ রঞ্জন পালিত
সংগীতঃ নবারুণ বোস
প্রারম্ভিক কথাঃ কিছুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে সংগীতের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমা ‘ট্যাংরা ব্লুজ’। কলকাতার একটি বস্তি এবং সেখানে বসবাসকারী একদল গানের সদস্যদের জীবন যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সিনেমাটি। ট্যাংরার বস্তি অঞ্চল কলকাতার অন্যান্য বস্তির থেকে অনেকটাই চেহারা চরিত্রে অন্যরকম। সুপ্রিয় সেন পরিচালিত এই সিনেমার মুখ্য ভূমিকায় আছেন মধুমিতা সরকার ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবি মুক্তির আগেই ছবির গান, ট্রেলার বেশ সাড়া ফেলেছিল দর্শক মহলে। কিন্তু মুক্তির পর দর্শকদের প্রত্যাশার প্রতি কতটা ন্যায়বিচার করতে পেরেছে সিনেমাটি এই রিভিউতে সেটা নিয়েই থাকছে বিস্তারিত আলোচনা।
কাহিনী সংক্ষেপঃ কলকাতা শহরের চকচকে অ্যাপার্টমেন্ট, শপিংমল, ফ্ল্যাট নির্ভর আধুনিক জীবনের সমান্তরালে আছে আরও একটা জীবন। সেই জীবনের প্রতি মানুষ পুরোপুরি উদাসীন। শহরের সব জঞ্জাল ফেলা হয়ে থাকে এই অঞ্চলে যাকে বলা হয়ে থাকে ট্যাংরার বস্তি অঞ্চল। জীবন বলতে যেখানে আসলে বেঁচে থাকার লড়াই ছাড়া আর কিছু না। নোংরা আর আবর্জনার সাথে সাথে সেই অঞ্চলে জমা হয় নানান ক্ষোভ, না পাওয়ার চিৎকারও। এই অসম্ভব রকমের জঞ্জালে সঞ্জয় মণ্ডল (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) নামের এক তরুণ বছর ১০ আগে কচিকাঁচাদের নিয়ে একটা গানের দল (ব্যান্ড) বানিয়েছিলেন। গানের যন্ত্রপাতি বলতে ভাঙা ড্রাম, টিন, কৌটো, ঘণ্টা, কঞ্চি, কাঠি, বাটি, ঘটি। কোনও গিটার, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, তবলা, ব্যাঞ্জো, এককথায় প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সংগীত যন্ত্র ছিল না। সে দলের নাম ছিল ‘সঞ্জয় মণ্ডলের গানের দল’। সঞ্জয় মণ্ডলের ছায়ায় ট্যাংরা ব্লুজের সেই বাচ্চারা লিপ্ত জীবন যুদ্ধের অবিরাম লড়াইয়ে। তবে এই লড়াইটা কখনোই সহজ ছিলো না, কারন সেখানে অবস্থিত ফ্যাক্টরিকে উচ্ছেদ করতে ফণা তুলে বসে আসছে কয়েকটি বিষধর সাপ।
এই পরিস্থিতে ট্যাংরা ব্লুজে আসে এক বিত্তবান বাবার মেয়ে জয়ী (মধুমিতা সরকার)। ট্যাংরা ব্লুজে তার প্রথম দিনই সে দেখতে পায় একদল কচিকাঁচার রাস্তায় গানের উল্লাস। পেশায় জয়ী একজন সংগীত পরিচালক কিন্তু তার ক্যারিয়ার আবর্তিত হচ্ছে ব্যার্থতার বৃত্তে। জয়ী নিজে করার পাশাপাশি গানকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে। এছাড়া তার কাজটা অনেকটা ট্যালেন্ট হান্টারের মতো। ট্যাংরা ব্লুজে সেই বাচ্চাদের গান শুনে নতুন করে সবকিছু সাজানোর পরিকল্পনা করে। প্রায় একই ধরনের একটি কাজ জয়ী করেছিলো ব্রাজিলের একটি বস্তিতে। আগের দিন সন্ধ্যায় গানের তালে মাতোয়ারা চালুকে (সামিউল আলম) আবিষ্কার করে তার ভাড়া করা ফ্ল্যাটবাড়ির ময়লা কুড়াতে। পরে চালুর মাধ্যমে জয়ী খোঁজ পায় সঞ্জীব মণ্ডলের। এদিকে চালুর বাবা দশ বছর আগে ফ্যাক্টরি সংক্রান্ত কারনে আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছিলেন যে রহস্যের খোলাসা এখনো হয়নি। জয়ী সঞ্জীবের সাথে এই দলকে নিয়ে বিশেষ কিছু করার পরিকল্পনা করে। জয়ী কি পারবে সেই ইচ্ছে পূরণ করতে? সঞ্জীব কি সহয়তা করবে জয়ীকে ট্যাংরা ব্লুজের বাচ্চাদের জন্য নতুন গল্প লিখতে? চালুর বাবার হত্যার রহস্য কি শেষ পর্যন্ত উম্মচিত হবে? ফ্যাক্টরি দখলের জন্য মুখিয়ে থাকাদের কি সঞ্জীব পারবে প্রতিহত করতে? জয়ীর পথচলা কি সহজ হবে না লড়াই করতে হবে পদে পদে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য?
গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও এটা সুস্পষ্ট যে এই সিনেমার গল্পের উৎস অবশ্যই সঞ্জয় মণ্ডল। সিনেমাটির মুখ্য চরিত্রের নামও সঞ্জয় মণ্ডল। বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে গানের দল বানানো টুকুই শুধু বাস্তব, গল্পের বাকিটা ফিকশন অর্থাৎ বানানো, সাজানো, কল্পিত। তবে শুধুমাত্র গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলোনা ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ সিনেমার গল্পে। সেখানে ট্যাংরা এলাকার সমাজবিরোধীদের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি উঠে এসেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিবেশটি। একটি তথ্যচিত্রের ধারনাকে পরিপূর্ন কাহিনি চিত্রের মোড়কে তুলে আনা হয়েছে এই সিনেমায়। বাস্তব প্রেক্ষাপটের সাথে কাহিনীর নতুন কিছু দিক জুড়ে দিয়ে তুলে আঁকা হয়েছে সঞ্জয় মণ্ডলের মতো এক তরুণের অভিনব কাজকে স্বীকৃতি। সেইসাথে সঞ্জয় ও তাঁর এলাকার একটি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ছবির তথ্যও উঠে এসেছে কাহিনীর মোড়ক দিয়ে।
একটি সম্ভাবনাময়ী গল্পকে সম্পূর্ন রুপ দিতে উপযোগী একটি চিত্রনাট্যের দেখা পাই আমরা এই সিনেমায়। পরিচালক সুপ্রিয় সেনের সাথে চিত্রনাট্যটি যৌথভাবে রচনা করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছোটবেলার পড়া “বাবুরাম সাপুড়ে…” বা ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে…” ছড়াকে উপলক্ষ্য করে দুর্দান্ত একটি চিত্রনাট্যে উঠে এসেছে ট্যাংরা ব্লুজের বাচ্চাদের জীবনের চেনাজানা ঘটনা। অনুভূতির রঙে এক নতুন চেহারা দিয়ে প্রতিবাদের গানটাই প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে সিনেমাটির চিত্রনাট্যে। একটি জীবনী ভিত্তিক কাহিনীকে সুলিখিত চিত্রনাট্যের মাধ্যমে উপভোগ্য সিনেমা হিসেবে উপস্থাপন করতে এই যুগল লেখকের প্রচেষ্টা সফলই বলতে হবে। আর এই অসাধারণ চিত্রনাট্যই ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ সিনেমাকে আলাদা করে অঞ্জন দত্তের নির্মিত মিউজিক্যাল সিনেমা থেকে।
গল্প এবং চিত্রনাট্য ছাড়াও সিনেমাটির অন্যতম শক্তিশালী দিক সিনেমাটির সংলাপ। ট্যাংরার চিত্র তুলে ধরতে সঞ্জীব মণ্ডল এক জায়গায় বলেন, “কলকাতা শহরের যত জঞ্জাল এখানেই ফেলা হয়, তাই এখনকার মানুষগুলোর মধ্যে নোংরামি, শয়তানি, জীবনের কালো দিকগুলোর সমাবেশ বেশি ঘটে।” পুরো প্রেক্ষাপটকে তুলে আনতে এরকম শক্তিশালী সংলাপ খুব কম সিনেমায়ই দেখা যায়। এছাড়া জয়ী এবং সঞ্জয়ের মধ্যকার সংলাপেও পাওয়া গেছে জীবন দর্শনের বেশ কিছু সিনেমাটিক অনুভব।
পরিচালনাঃ আগেই বলেছি জীবনী নির্ভর একটি গল্পের সাথে ফিকশনকে জড়িয়ে সিনেমা নির্মানের প্রচেষ্টায় বেশ সফল ছিলেন পরিচালক সুপ্রিয় সেন। আর নির্মাতা হিসেবে নিজের আলাদা কিছু ব্যাকরণ দিয়ে পুরো কাজটা বেশ পরিপক্কতার সাথেই করেছেন তিনি। ফিচার সিনেমা হিসেবে সুপ্রিয় সেনের এটিই প্রথম কাজ। আর প্রথম কাজে তার ভাবনা এবং পর্দায় সেটার উপস্থাপনার প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে।
অভিনয়ঃ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং মধুমিতা সরকার। পরমব্রত নিজের চরিত্রে বরাবরের মতই অতুলনীয়। সত্যিকার অর্থে পরমব্রত অভিনয়ের দিক থেকে হতাশ করেন না, এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। অন্যদিকে চিনি সিনেমার পর নিজের প্রতি যে প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিলেন মধুমিতা তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে সক্ষম ছিলেন।
পরমব্রত এবং মধুমিতার সাথে সমানতালে অভিনয় করেছে সামিউল, ঐশানী সহ একঝাঁক নতুন মুখ। তবে সামিউলের অভিনয় আলাদা করে আলোচনার দাবী রাখে। ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ থেকে সামিউলকে এই সিনেমায় অনেকটাই পরিণত মনে হয়েছে। তার সংলাপ বলার ধরন, তাকানো সবই নজর কেড়েছে সকলের। এছাড়া সিনেমার অন্যান্য চরিত্রে অভিনয়কৃত শিল্পীরা নিজেদের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন। সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে সিনেমাটি অতি নাটকীয় অভিনয় থেকে মুক্ত। সেই জন্যই বোধয় আরও নজর কেড়েছে দর্শকের।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ অনেক ভালোর অন্যতম প্রধান ভালো ছিলো রঞ্জন পালিতের ক্যামেরার কাজ। পরিপ্রেক্ষিতের সাথে মিল রেখে আলো-আঁধার, কালো, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার রঞ্জনের মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর বহন করে। ক্ষেত্র বিশেষে ফ্রেমিংয়ের কোরিওগ্রাফি একেবারে বাস্তবের হুবহু প্রতিবিম্ব মনে হতে পারে। এছাড়া ক্লোজআপে ক্যামেরা ব্যবহার করে চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন রঞ্জন পালিত। সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বলার নেই, কারন সম্পাদনাটা শাব্দিক আবহের সাথে মাননসই ছিলো।
উপসংহারঃ যদিও গান নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি, সিনেমাটির গানগুলো অসাধারণ ছিলো। ভালো বিষয়বস্তু সাথে ভালো অভিনয় এবং গান – একটি সিনেমাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যতেষ্ট। আর আলোর নীচেই যে থাকে অন্ধকারের কায়া, যেদিকে কেউ তাকাতে চায়না সেটা আরো একবার উঠে এসেছে ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ সিনেমার একঝাক মানুষের হাত ধরে। সেই অন্ধকার সরু গলিতে যে উপেক্ষিত জীবনের স্রোত প্রবাহমান তা সামনে নিয়ে আসার জন্য পরিচালক সুপ্রিয় সেন এবং তার দলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অন্তত সেই গল্পকে তুলে ধরার প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলেও সিনেমাটি সবার দেখা উচিত।
আরো পড়ুনঃ
কসাই রিভিউ: নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নতুন প্রচেষ্ঠায় অনিরুদ্ধ অনন্য মামুন
রাধে রিভিউ: সালমান খানের আরো একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু
আর্মি অফ দ্যা ডেড রিভিউ: জ্যাক স্নাইডারের হাত ধরে জম্বি সিনেমায় ভিন্নতার স্বাদ