চলচ্চিত্রের নামঃ ব্ল্যাক উইডো (২০২১)
মুক্তিঃ জুলাই ০৯, ২০২১
অভিনয়েঃ স্কারলেট জোহানসন, ডেভিড হারবোর, ফ্লরেন্স পাঘ, ও-টি ফেগবেনলি, রিচেল উইয়েজ এবং রে উইনস্টন প্রমুখ।
পরিচালনাঃ কেইট শর্টল্যান্ড
প্রযোজনাঃ কেভিন ফেইজ
পরিবেশনাঃ ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিওস এবং মোশন পিকচার্স
কাহিনীঃ জ্যাক সেফার এবং নেড বেনসন
চিত্রনাট্যঃ এরিক পিয়ার্সন
সম্পাদনাঃ লেইস ফলসন বয়েড এবং ম্যাথিউ স্কেমিডট
চিত্রগ্রহনঃ গ্রেবিয়েল বেরিস্টেন
সংগীতঃ লর্ন বার্ফে
প্রারম্ভিক কথাঃ এভেঞ্জার্স দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সদস্য এবং মার্ভেলের প্রথম লেডি সুপারহিরোকে এই সিরিজের সিনেমাগুলোতে নিয়মিত দেখা গেছে। প্রায় দশ বছর আগে ‘আয়রন ম্যান ২’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথমবারের মত পর্দায় দেখা গেছে ব্ল্যাক উইডোকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এই চরিত্রের প্রতি দর্শকদের ভালোবাসার কথা বিবেচনা করে সিনেমাটির একটি স্পিন-অফ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় মার্ভেল। জনপ্রিয় এই সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের জনপ্রিয় এই চরিত্রকে নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছে সম্প্রতি। এভেঞ্জার্স দলের অন্যতম শক্তিশালী এই চরিত্রকে নিয়ে নির্মিত সিনেমায় বরাবরের মতই অভিনয় করেছেন স্কারলেট জোহানসন। জানা গেছে এই চরিত্রে আর অভিনয় করছেন না এই অভিনেত্রী। তাহলে কেমন হলো স্কারলেট জোহানসন অভিনীত সর্বশেষ ‘ব্ল্যাক উইডো’ – রিভিউতে সেটাই দেখার চেষ্টা করবো।
কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমার শুরু নব্বয়ের দশকে ওহিও শহর থেকে। নাতাশা (স্কারলেট জোহানসন) একটি সাহসী মেয়ে যে তার ছোট বোন ইয়েলেনা (ফ্লরেন্স পাঘ) এর নিয়মিত দেখা শোনা করে থাকে। তারা দুইজন তাদের পিতা-মাতা মেলিনা (রিচেল উইয়েজ) এবং এলেক্সি (ডেভিড হারবোর) এর সাথে বসবাস করে। আসলে মেলিনা এবং এলেক্সি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে। এদিকে নাতাশা ইতিমধ্যে রেড রুমের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেছে। রেড রুম রাশিয়া ভিত্তিক একটি বুট ক্যাম্প যেখানে ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে তাদের একেক জন ডেডলি এজেন্ট হিসেবে তৈরি করে। রেড রুমে নেয়ার কারনে এক পর্যায়ে নাতাশা এবং ইয়েলেনা একজন আরেকজন থেকে আলাদা হয়ে যায়।
এরপর সিনেমাটির প্রেক্ষাপট শুরু হয় ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকাঃ সিভিল ওয়ার’ (২০১৬) পরবর্তি সময়ে যখন নাতাশা অন্য এভেঞ্জার্স থেকে আলাদা হয়ে যায়। আর রেড রুমে মেয়েদের মধ্যে রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দিয়ে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে আসছে ড্রেকভ (রে উইনস্টন)। এরমধ্যে নাতাশা ড্রেকভকে হত্যার করে এবং পুরো রেড রুম ব্লাস্ট করে উড়িয়ে দেয়। এদিকে ইয়েলেনা একটি অপারেশন করতে গিয়ে রেড রুমের রাসায়নিক ক্রিয়া থেকে এজেন্টদের মুক্ত করার এন্টি-ডোট পেয়ে যায়। উক্ত এন্টি-ডোটটি ইয়েলেনা নাতাশা পর্যন্ত পৌছে দেয় কিন্তু সেই মুহুর্তে একজন এজেন্টের আক্রমণের শিকার হয় নাতাশা। এরপর নাতাশা আরো জানতে পারে যে, রেড রুম এখনো কার্যকর আছে এবং ড্রেকভ এখনো বেঁচে আছে।
এন্টি-ডোটের সুত্র ধরে নাতাশা এবং ইয়েলেনা মুখোমুখি হয়। রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে এজেন্টদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে ড্রেকভের এই প্রকল্প বন্ধ করার জন্য ড্রেকভকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় নাতাশা। সেই উদ্দেশ্যে নাতাশা তার আগের ভূয়া পরিবার অর্থাৎ মেলিনা এবং এলেক্সির সাথে দেখা করে। সিনেমার গল্পের পরের অংশ জুড়ে রয়েছে সেই পারিবারিক রিইউনিয়ন এবং প্রতিশোধের তারনা। নাতাশা কি পারবে তার সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে? ইয়েলেনা কি নাতাশাকে সাহায্য করবে? ড্রেকভের গুপ্তচর মেলিনা এবং এলেক্সি কি নাতাশাকে সাহায্য করবে? নাকি আবারো এই গুপ্তচরদের জালে পা দিবে নাতাশা? সিনেমার বাকি অংশের উত্তেজনা এবং ক্লাইম্যাক্সের আগের সেই টুইস্টের মজা পেতে আপনাকে দেখতে হবে সিনেমাটি।
গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ মার্ভেল প্রেমীদের কাছে নাতাশা বা ব্ল্যাক উইডো চরিত্রটি পরিচিত হলেও এই চরিত্রের আগের গল্প দর্শকদের কাছে অজানা ছিলো। ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমার গল্পে নাতাশার ব্ল্যাক উইডো হওয়ার আগের গল্পটি বেশ ভালোভাবে ফুতে উঠেছে। তবে সিনেমাটির শুরুতে গল্পে যে আবেদন ছিলো মাঝের কিছুটা সময় সেখানে কিছুটা বিচ্ছিন্নতা দেখা গেছে। বিশেষ করে সিনেমাটির শুরু অংশটুকু দর্শকদের প্রত্যাশা অনেকগুন বাড়িয়ে দেয় কিন্তু পরবর্তিতে নাতাশার আত্নগোপন এবং সাধারন জীবনযাপনের চেষ্টার সময়টুকুতে গল্পের ধারাবাহিকতায় একটু ছন্নছাড়া ভাব দেখা গেছে। তবে পারিবারিক রিইউনিয়নের পর থেকে সিনেমাটি আবার শুরুর উত্তেজনায় ফিরে গেছে। তবে ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমার গল্প মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের অন্যান্য সুপারহিরো গল্প থেকে অনেকটাই আলাদা। রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ছোট ছোট মেয়েদের এজেন্ট বানানো, সাধারন বেসামরিক নাগরিকদের মাঝে বিভিন্ন মিশন পরিচালনা করা অনেকটাই বন্ড বা ব্রুস সিনেমাগুলোর প্লটকে মনে করিয়ে দিবে আপনাকে।
গল্পের পাশাপাশি ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমার চিত্রনাট্যও বেশ আকর্ষনীয় ছিলো। তবে চিত্রনাট্যের কিছু অংশে গল্পের ধারাবাহিকতার সাথে খাপ ছাড়া মনে হতে পারে। এছাড়া গল্পের মত ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমাটির চিত্রনাট্যেও মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের অন্য সিনেমাগুলো থেকে আলাদা একটা ভাব রয়েছে। সাধারণত সুপারহিরো সিনেমাতে যেখানে একশনই বেশী প্রাধান্য পেয়ে থাকে কিন্তু ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমাতে একশনের পাশাপাশি আবেগ এবং সম্পর্ককেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। চিত্রনাট্যে ইয়েলেনাকে আরো বেশী ব্যক্তিত্বপূর্ন এবং দায়বদ্ধতার দিক থেকে অন্য চরিত্রগুলো থেকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যা ইয়েলেনা চরিত্রকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে।
পরিচালনাঃ কিছু কিছু জায়গা ছাড়া ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমাটির গল্পকে দর্শকদের জন্য আকর্ষনীয় করে তোলার কাজে পরিচালক কেইট শর্টল্যান্ড অনেকটাই সফল ছিলেন। নাতাশা এবং ইয়েলেনার রসায়নকে পর্দায় বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন এই নির্মাতা। তবে চরিত্রগুলোর ধারাবাহিকতায় কিছুটা খাপছাড়া ভাব দেখা গেছে। বিশেষ করে এই দুই চরিত্রের গভীরতাকে আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ ছিলো যা কেইট শর্টল্যান্ড কিছুটা মিস করে গেছেন। সর্বপরি এরকম একটি প্রত্যাশিত সিনেমাকে দর্শকদের জন্য বেশ আকর্ষনীয় করে তোলার চেষ্টায় উতরে গেছে এই নির্মাতা।
অভিনয়ঃ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্কারলেট জোহানসন। এর আগেও এভেঞ্জার্স সিরিজের সিনেমাগুলোতে ব্ল্যাক উইডো চরিত্রে দেখা গেছে এই অভিনেত্রীকে। আর বরাবরের মতই নিজের সেরাটা দিয়ে দর্শককে ধরে রেখেছেন স্কারলেট। বিশেষ সিনেমাটির একশন দৃশ্যে দুর্দান্ত ভাবে দেখা গেছে তাকে। তবে সিনেমাটিতে তাকে অন্যান্য প্রধান চরিত্রগুলো বেশ শক্তিশালী প্রতিযোগিতা দিয়েছে।
অন্যদিকে ইয়েলেনা চরিত্রে ফ্লরেন্স পাঘ নিজেকে আবিষ্কার করেছেন নতুন ভাবে। অল্প বয়সে নিজের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তার মানসিক যে প্রভাব পড়েছে সেটা দক্ষতার সাথে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন এই অভিনেত্রী। এছাড়া তার চরিত্রের মধ্যে একধরনের উপহাসের বিষয়টিও উঠে এসেছে তার চরিত্রে।
সিনেমাটির অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করা তারকারাও নিজেদের জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন। তবে এলেক্সি চরিত্রে ডেভিড হারবোরের রাশিয়ান ভাষার উচ্চারণে কিছুটা অস্মাঞ্জস্য দেখা গেছে। অন্যদিকে মেলিনা চরিত্রে রিচেল উইয়েজও ভালো অভিনয় করেছেন। ড্রেকেভ চরিত্রে রে উইনস্টনের পর্দা উপস্থিতি কম হলেও নিজের চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ মার্ভেলের অন্যান্য সিনেমাগুলোর মতই ভালো লাগবে দর্শকদের। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে রেড রুম ধ্বংসের দৃশ্যটিতে চিরচেনা সুপারহিরো গল্পের ভাব ফুতে উঠেছে যা দর্শকদের ভালো লাগবে। অন্যদিকে সিনেমাটির সম্পাদনাও যথোপযোগী ছিলো। সিনেমাটির স্থায়িত্বকে ঠিক রাখতে এবং দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে কিছুটা ছোট করতে হয়েছে বলে মনে হয়েছে। সিনেমাটির কয়েকটি চরিত্র সম্ভবত সম্পাদনার কারনে কিছুটা বিছিন্ন হয়ে গেছে।
উপসংহারঃ সর্বপরি ‘ব্ল্যাক উইডো’ সিনেমাটি সুপারহিরো প্রেমীদের ভালোলাগার সব উপাদান নিয়েই নির্মিত। মার্ভেলের অন্যান্য সিনেমাগুলো থেকে এই সিনেমার প্রেক্ষাপট কিছুটা আলাদা হলেও নিজেদের ধারাকে অব্যাহত রেখেই তৈরি করা হয়েছে এই সিনেমা। মার্ভেল প্রেমীদের পাশাপাশি একশন সিনেমার প্রেমীদের জন্য ভালোলাগার মত সিনেমা ‘ব্ল্যাক উইডো’।
আরো পড়ুনঃ
আর্মি অফ দ্যা ডেড রিভিউ
টেনেট রিভিউ
ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪ রিভিউ