চলচ্চিত্রের নামঃ নো টাইম টু ডাই (২০২১)
মুক্তিঃ অক্টোবর ০৮, ২০২১ (বাংলাদেশ)
অভিনয়েঃ ড্যানিয়েল ক্রেইগ, রামি মালেক, লিয়া সেডক্স, লশানা লিঞ্চ, বেন হুইশ, নাওমি হ্যারিস, জেফরি রাইট, ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ, রালফ ফিয়েন্স, আনা ডি আরমাস প্রমুখ।
পরিচালনাঃ ক্যারি জোজি ফুকুনাগা
প্রযোজনাঃ মাইকেল জি উইলসন, বারবারা ব্রোকলি এবং ড্যানিয়েল ক্রেইগ
পরিবেশনাঃ ইউনিভার্সেল পিকচার্স
কাহিনীঃ নিল পুরভিস, রবার্ট ওয়েড এবং ক্যারি জোজি ফুকুনাগা
চিত্রনাট্যঃ নিল পুরভিস, রবার্ট ওয়েড, ক্যারি জোজি ফুকুনাগা এবং ফোবি ওয়ালার-ব্রিজ
সম্পাদনাঃ এলিয়ট গ্রাহাম এবং টম ক্রস
চিত্রগ্রহনঃ লিনাস স্যান্ডগ্রেন
সংগীতঃ হ্যান্স জিমার
প্রারম্ভিক কথাঃ কোরি জোজি ফুকুনাগা পরিচালিত প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘নো টাইম টু ডাই’ এর মাধ্যমে শেষ হচ্ছে জেমস বন্ড হিসেবে ড্যানিয়েল ক্রেইগের যাত্রা। এই সিনেমাটির অন্য একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর মাধ্যমে ০০৭ এজেন্টের একটি সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি হচ্ছে যা এই সিরিজে আগে দেখা যায়নি। করোনা মহামারীর আগে ২০২০ সালে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েকবার পিছিয়ে যায় সিনেমাটির মুক্তি। ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ থেকে ‘নো টাইম টু ডাই’ – এই সময়ে ড্যানিয়েল ক্রেইগের সিনেমাটিক অ্যাডভেঞ্চার পেয়েছে এক অন্য পরিসমাপ্তি। তাহলে কেমন হলো জেমস বন্ড চরিত্রে ড্যানিয়েল ক্রেইগ অভিনীত সর্বশেষ সিনেমাটি? দর্শকদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারলেন ফুকুনাগা? ‘নো টাইম টু ডাই’ সিনেমাটির রিভিউতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবো আমরা।
কাহিনী সংক্ষেপঃ সাধারণত ‘০০৭’ সিরিজের সিনেমাগুলোতে জেমস বন্ডকে একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে প্রতিটি সিনেমা একটি স্বতন্ত্র অ্যাকশন সিনেমা হিসাবে পুনরায় শুরু হয়। কিন্তু ড্যানিয়েল ক্রেইগ অভিনীত ‘০০৭’ সিরিজের সিনেমাগুলো অনেকটা মার্বেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে মত করে নির্মিত হয়েছে। এই সিরিজে একটির গল্পের সাথে অন্যটির গল্পের কিছুটা সংযোগ রাখা হয়েছে এবং আগের সিনেমার চরিত্রগুলো ফিরে ফিরে এসেছে। ‘নো টাইম টু ডাই’ উপভোগ করার জন্য আপনাকে আগের পর্বগুলো দেখতেই হবে ব্যাপারটা এমন নয় কিন্তু সিনেমাটির প্রেক্ষাপটের সাথে পরিপূর্ন সংযোগ স্থাপনের জন্য আগের পর্বগুলো বিশেষ করে ‘স্পেকট্রা’ দেখাটা জরুরী।
ম্যাডেলিন সোয়ানের (লিয়া সেডক্স) ছোটবেলার ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে শুরু হওয়ার পর গল্পে ফিরে আসে জেমস বন্ডের মৃত প্রেমিকা ভেসপার (‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ সিনেমায় মারা যাওয়া)। গল্পে দেখা যায় ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস ছেড়ে দেয়ার পর জেমস এবং ম্যাডেলিন ইতালিতে বসবাস করছে। সেখানে জেমস ভেসপারের কবর দেখতে গেলে সেটি বন্ডের সামনেই বিস্ফোরিত হয়। ইতালিতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার জন্য বন্ড ম্যাডেলিনকে দায়ী করে এবং তার থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে এই ঘটনার পর বন্ড এমআই৬-এ ফিরে আসে। কিন্তু বন্ড সেটা করেনা। ভেসপারের করবে বিস্ফোরনের পর জেমস বন্ড কিউবাতে বসবাস শুরু করে। এরপর সিনেমাটির প্রেক্ষাপট এগিয়ে যায় পাঁচ বছর। এ সময়ে একটি লন্ডনের একটি ল্যাব থেকে ভাইরাসের ভয়ংকর এক চুরির ঘোটনা ঘটে। এই ভাইরাসটি নির্দিষ্ট মানুষের ডিএনএ’র উপর ভিত্তি করে কার্যকর হয়ে থাকে। ভাইরাস চুরির এই ঘোটনাটি বন্ডকে আবারো কাজে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, কারন এর সাথে স্পেকট্রার একটি যোগসূত্র রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে জেমস বন্ড এই ভাইরাস চুরির ঘটনায় ফেলিক্স লেইটার (জেফরি রাইট) এবং নতুন মুখ লোগান অ্যাশ (বিলি ম্যাগনুসেন) মারফতে সিআইএ’র সাথে কাজ শুরু করে। এদিকে ‘০০৭’ এজেন্ট হিসেবে জেমস বন্ডের স্থালাভিশিক্ত হন নোমি (লাশানা লিঞ্চ)। অন্যদিকে জেমস এম (রালফ ফিয়েনস)-কে বিশ্বাস করতে পারেনা। জেমস মনে করে যে এম ভাইরাসটির ব্যাপারে বিস্তারিত জানে। অবশ্য এই ঘোটনায় তদন্তের জন্য বন্ডকে আড়ালে থেকে সাহায্য ককে কিউ (বেন হিশাও) এবং মানিপেনি (নওমি হ্যারিস)। ভয়ংকর সেই ভাইরাস চুরির মুল উদ্দেশ্য কি? স্পেকট্রার সাথে এই ঘটনার সংযোগ কি? ম্যাডেলিন সোয়ানের কি এর সাথে কোন সম্পৃক্ততা রয়েছে? জেমস বন্ড কি ‘০০৭’ এজেন্ট হিসেবে ফিরে আসবে এমআই৬-এ? জেমস বন্ড কি পারবে সেই ভাইরাসের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে? সিনেমার বাকি অংশে আপনি এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই খুঁজে পাবেন।
গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ ‘নো টাইম টু ডাই’ সিনেমার গল্প ‘স্পেকট্রা’ সিনেমার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই প্রস্তুত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ঘটনাকে এক সুতোয় গেঁথে সিনেমাটির গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নির্মাতারা। তবে সিনেমাটি দেখে মনে হয়েছে ড্যানিয়েল ক্রেইগের শেষ সিনেমা হিসেবে এই চরিত্রের ইতি টানতে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়েছেন নির্মাতারা। চিত্রনাট্য বিবেচনায় সিনেমাটির প্রথম ভাগের চেয়ে দ্বিতীয় ভাগের চিত্রনাট্য কিছুটা দূর্বল ছিলো। কিউবাতে ঘটে যাওয়া জেমস বন্ডের সাথে ভিলেনদের যে বাইক এবং কার চেজিং এর দৃশ্য রয়েছে তা সিনেমাটির প্রতি দর্শকদের প্রত্যাশা প্রথমেই বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরপর সিনেমার গল্পের সাথে সাথে চিত্রনাট্যেও কিছুটা দুর্বলতা পরিলক্ষিত হবে দর্শকদের কাছে। সিনেমার একটি পর্যায়ে ব্লোফেল্ডকে পর্দায় ফিরিয়ে আনা হলেও তা খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ‘স্পেকট্রা’ সিনেমার ধারাবাহিকতায় ব্লোফেল্ডের উপস্থিতি যতটা শক্তিশালী হওয়া উচিৎ ছিলো চিত্রনাট্যে সেটা দেখা যায়নি।
পরিচালনাঃ ক্যারি জোজি ফুকুনাগার নির্দেশনা মোটামুটি ভালো ছিলো। জেমস বন্ডের সিনেমার স্বাভাবিক মারমার কাটকাট ধারা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে গল্পকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন এই নির্মাতা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জেমস বন্ডের সিনেমার ক্ষেত্রে দর্শকদের প্রত্যাশার একটি মাপকাঠি রয়েছে যার বড় অংশ জুড়ে আছে দুর্দান্ত সব অ্যাকশন দৃশ্য। ‘নো টাইম টু ডাই’ সিনেমার শুরুতে তার কিছুটা ইঙ্গিত দিলেও অনেকটা নিরাপদ পথেই হেঁটেছেন ক্যারি জোজি ফুকুনাগা। আগের পর্বগুলোর ধারাবাহিকতায় ড্যানিয়েল ক্রেইগের শেষ সিনেমা ভিলেনের চরিত্রায়ন আরো শক্তিশালী করার সুযোগ ছিলো পরিচালকের হাতে। এছাড়া সিনেমাটির অন্যান্য চরিত্রগুলোকে সিনেমার প্লটকে সমাপ্তির দিকে এদিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর বেশী কিছু করার জন্য দিয়ে পারনেনি ফুকুনাগা।
অভিনয়ঃ জেমস বন্ড চরিত্রে ড্যানিয়েল ক্রেইগ বরাবরের মতই নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। কঠোরতা, আপনজনের স্মৃতিকে বয়ে বেড়ানো এবং ক্ষেত্র বিশেষে হাস্যরস – সবকিছু মিলিয়ে ড্যানিয়েল ক্রেইগই ছিলেন সিনেমার প্রান। তবে লিয়া সেডক্সের সাথে তার পর্দা রসায়ন তেমন আকর্ষনীয় ছিলো না। আর এই সমস্যা ‘স্পেকট্রা’তেও দেখা গেছে। এছাড়া বন্ড গার্ল হিসেবে লিয়া সেডক্স নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে পারেননি। অন্যদিকে প্রধান ভিলেন চরিত্রে রামি মালেক ভালো অভিনয় করেছেন। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সিনেমাটির অন্যতম বড় আকর্ষন হিসেবে হাজির হয়েছেন আনা ডি আরমাস। কিউবাতে বন্ডের সাথে তার সেই ছন্দময় অ্যাকশন দৃশ্যটি অসাধারণ লেগেছে। আরমাস এবং বন্ডের সেই অ্যাকশন দৃশ্যকে অনেকটা নাচের মতই মনে হবে আপনার। এখানে আরমাসের দশ মিনিটের উপস্থিতি আমাকে মার্বেলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ধারনা করছি জেমস বন্ডের ২৬ অথবা ২৭তম সিনেমায় পূর্ণ চরিত্রে দেখা যাবে আরমাসকে। নতুন ‘০০৭’ এজেন্ট চরিত্রে লশানা লিঞ্চ মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। এছাড়া সিনেমাটির অন্য শিল্পীরা নিজেদের চরিত্রে মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ ‘নো টাইম টু ডাই‘ সিনেমার সাথে দর্শককে ধরে রাখবে সিনেমাটির অসাধারণ চিত্রগ্রহণ এবং ভিস্যুয়াল সেন্স। সিনেমার প্রথম দৃশ্যটি খুব শক্তভাবে ফ্রেম করা এবং অনেকটা কাব্যিক ছিলো। একটি তুষারময় পাহাড়ের উপর দিয়ে হুডযুক্ত একজন মানুষের হেঁটে আসার এইরকম চিত্র বন্ডের সিনেমায় সচরাচর দেখা যায়না। কিউবায় শুরুর সেই চেজিং কিংবা শ্যুট-আউটে ক্রেইগ এবং আরমাস একে অপরের সাথে ছন্দ খোঁজার তালে অ্যাকশন – সব মিলিয়ে সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ এটিকে করেছে আনন্দময়। তবে সম্পাদনার ক্ষেত্রে সিনেমাটির কিছুটা দূর্বলতা পরিলক্ষিত হতে পারে আপনার কাছে। কিন্তু যেহেতু একটি ধারাবাহিক গল্পের পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে এই সিনেমার মাধ্যমে, সম্পদনার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
উপসংহারঃ ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ সিনেমার সেই বিস্ফোরণের দৃশ্য সত্যিকার অর্থে জেমস বন্ড সিনেমায় অ্যাকশনের ধারাকে বদলে দিয়েছে। ‘নো টাইম টু ডাই’ সিনেমার সমস্যা হচ্ছে এই সিনেমায় এমন কিছু আপনি পাবেন না, যা এরচেয়ে ভালো ভাবে ড্যানিয়েল ক্রেইগ তার আগের কোন সিনেমায় করেননি! এই তারকা অভিনীত ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এবং ‘স্কাইফল’ যে নতুন যুগের সংজ্ঞা নির্ধারন করেছে ‘নো টাইম টু ডাই’ সেটাকে স্পর্শ করতে ব্যার্থ হয়েছে। আপনি যদি জেমস বন্ড সিনেমার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে উপভোগ করতে পারেন সিনেমাটি। আর যদি নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে থাকেন তাহলে প্রত্যাশা কিছুটা কম রেখে দেখতে পারেন সিনেমাটি।
আরো পড়ুনঃ
‘নো টাইম টু ডাই’ দেখার আগে জেমস বন্ড সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার!