চলচ্চিত্রের নামঃ নবাব এলএলবি (২০২০)
মুক্তিঃ ডিসেম্বর ১৬, ২০২০ (আই থিয়েটার)
অভিনয়েঃ শাকিব খান, মাহিয়া মাহি, স্পর্শিয়া, শহীদুজ্জামান সেলিম, সুমন আনোয়ার, শাহেদ আলী, রাশেদ মামুন অপু, শেখ রুনা রবং শবনম পারভীন প্রমুখ।
পরিচালনাঃ অনন্য মামুন
প্রযোজনাঃ সেলিব্রেটি প্রোডাকশন
পরিবেশনাঃ আই থিয়েটার
কাহিনীঃ রাপপু রাজ এবং অনন্য মামুন
চিত্রনাট্যঃ অনন্য মামুন এবং দীপঙ্কর দীপন
সংলাপঃ শাহজাহান সৌরভ
সম্পাদনাঃ একরামুল হক
চিত্রগ্রহনঃ মেহেদী রনি
সংগীতঃ দোলন মাইন্নাক
প্রারম্ভিক কথাঃ ঘোষনার পর থেকেই আলোচনায় অনন্য মামুন পরিচালিত সিনেমা ‘নবাব এলএলবি’। করোনা মহামারীর মধ্যেই সিনেমার শুটিং শেষ করেন দেশ সেরা সুপারষ্টার শাকিব খান। তবে সিনেমাটির চিত্রায়ন শেষ হওয়ার আগেই সিনেমাটির পরিচালকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তোলেন সিনেয়ামটির প্রধান দুই তারকা শাকিব খান এবং মাহিয়া মাহি। তবে সবচেয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে সিনেমাটি মুক্তির পরে। আই থিয়েটার ওটিটি প্লাটফর্মে দুই ভাগে সিনেমাটি মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে দর্শকদের সমালোচনার মুখে পড়েন পরিচালক মামুন। সর্বশেষ সিনেমার একটি দৃশ্যে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার দায়ে পর্নগ্রাফি আইনে গ্রেফতার হন পরিচালক মামুন এবং একজন অভিনেতা। চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক পর্দার বাইরে আলোচনার জন্ম দেয়া এই সিনেমা সিনেম্যাটিক দিক থেকে কেমন চলো! এই পর্যালোচনায় বিস্তারিত থাকছে ‘নবাব এলএলবি’র বর্ননা।
কাহিনী সংক্ষেপঃ সিনেমার গল্প বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় সামাজিক ব্যাধি ধর্ষন নিয়ে আবর্তিত। একজন কর্মজীবী মেয়ের জীবন নিয়ে সমাজের মানুষের অন্ধকার চিন্তার অধ্যায় উঠে এসেছে সিনেমাটিতে। একটি রেডিও স্টেশনে আর.জে হিসেবে কর্মরত শুভ্রা যার আয়ের উপর নির্ভরশীল তার পরিবার। একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় নিজের অফিসের বস নেওয়াজ বাশার (রাশেদ মামুন অপু) এবং তার বন্ধুরা জোর পূর্বক ধর্ষন করে শুভ্রাকে। নেওয়াজ বাশার স্থানীয় সংসদ সদস্য আজিমুল বাশার (সুমন আনোয়ার) এর ছোট ভাই। সমাজ এবং সামাজিকতার কথা চিন্তা করে তার পরিবার এবং প্রেমিক তাকে থানায় অভিযোগ করতে নিষেধ করে। এই ঘটনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে শুভ্রা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ধর্ষকদের সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে সময়ের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ শুভ্রা শেষ পর্যন্ত পুলিশের কাছে অভিযোগ করার স্বিদ্ধান্ত নেয়। শুভ্রার জেদের কাছে হার মেনে তার পরিবার এবং প্রেমিক শুভ্রার এই লড়াইয়ে তাকে সমর্থনের স্বিধান্ত নেয়। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের ক্ষমতার ভয়ে এই মামলা না নিতে বিভিন্ন টাল-বাহানা করে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত মামলাটি থানায় লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হয় পুলিশ।
থানায় মামলা দায়ের পর তার মামলাটি লড়ার জন্য শুভ্রা মামলার ফাইল নিয়ে পৌঁছে শহরের সবচেয়ে বড় উকিল আজহার চৌধুরী (শহীদুজ্জামান সেলিম) এর চেম্বারে। সেখানে শুভ্রার দেখা হয় নবীন আইনজীবীর (মাহিয়া মাহি) সাথে যে কিনা আজহার চৌধুরীর মেয়ে। তার সাহায্যে শুভ্রা আজহার চৌধুরীর সাথে দেখা করে এবং আদালতে তার মামলাটি লড়ার জন্য অনুরোধ করে। এদিকে আজহার চৌধুরী টাকার লোভে শুভ্রার হয়ে মামলা না লড়ে ধর্ষককারীদের পক্ষে মামলা লড়ার স্বিদ্ধান্ত নেয়। আজহার চৌধুরীর এই স্বিদ্ধান্তে হতাশ শুভ্রাকে নামকরা একজন উকিলের কথা বলে একজন উকিলের সহকারী। এই সহকারী আসলে নবাব চৌধুরীর হয়ে কাজ করে।
এদিকে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নবাব চৌধুরী (শাকিব খান) একজন ছন্নছাড়া এবং খেয়ালি উকিল। যে কোর্টে মামলা লড়াই না করে মানুষকে জিম্মি করে এবং মিথ্যা বলে টাকা আয় করে। শুভ্রার দুর্বলতার সুযোগে সে নিজের ব্যাপারে মিথ্যাচার করে শুভ্রার মামলা আগে লড়ার এবং জেতার প্রতিশ্রুতি দেয়। তার কথার উপর বিশ্বাস করে শুভ্রা তাকে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক দেয়। এদিকে মামলার এজহারের আগের দিন রাতে সহকারীদের নিয়ে মদ্যপান করে নবাব আদালতে উপস্থিত হয়না। নবাবের অনুপস্থিতিতে শুরু হওয়া এই মামলা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেন আজহার চৌধুরী।
নবাবের অনুপস্থিতির কারনে সবাই শুভ্রার দিকে আঙ্গুল তোলে। শুভ্রাকে চরিত্রহীন আখ্যা দেয়া হয় এবং সে টাকার জন্য এই মিথ্যা মামলা করেছেন বলে প্রচার হয়। এই ঘটনায় প্রতিবেশীদের কটাক্ষ সহ্য করতে না পেরে হার্ট এটাকের শিকার হন শুভ্রার মা। হাসপাতালে নেয়ার সময়ই এম্বুলেন্সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শুভ্রার মা। নিজের মায়ের মৃত্যুতে বিদ্ধস্থ শুভ্রা এবং তার ছোট বোন মায়ের লাশ নিয়ে সরাসরি যায় নবাবের বাড়িতে। নেশায় বুদ নবাব চৌধুরীকে ঢেকে এনে শুভ্রার ছোট বোন নবাবকে একটি মামলা লড়ার কথা বলে। নিজের মায়ের হত্যার জন্য নবাবকে দায়ী করে নিজের বিরুদ্ধে মামলা লড়ার কথা বলে।
এরপর? সিনেমার গল্পে এরপর শুরু হয় নবাব চৌধুরী এবং আজহার চৌধুরীর লড়াই। সামাজিক অপবাদে পিষ্ঠ সদ্য মা হারানো শুভ্রার আর্তনাদ কি পারবে নবাবের মধ্যে অপরাধবোধ জাগ্রত করতে? নবাব কি পারবে শুভ্রাকে ন্যায় বিচার দিতে? নাকি আজহার চৌধুরী এই মামলাকে শুভ্রার বিরুদ্ধে নিয়ে যাবে? কোর্ট রুমে কেমন হবে নবাব এবং আজহারের কথোপকথন? শুভ্রা কি আবারো নিজের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? নবাব কি তার দেয়া ওয়াদা রক্ষা করতে পারবে? পারলেও কিভাবে সে এই মামলা কোর্টে লড়বে? শেষ পর্যন্ত কি ক্ষমতা আর টাকার কাছে আরো একবার ন্যায় বিচার বিপর্যস্ত হবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আপনাকে দেখতে হবে পুরো সিনেমা।
চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ এই সিনেমার চিত্রনাট্য ডক্টর হিসেবে কাজ করেছেন ‘ঢাকা এট্যাক’ খ্যাত দীপঙ্কর দীপন। সে হিসেবে চিত্রনাট্যের ক্রেডিটে যৌথভাবে অনন্য মামুন এবং দীপন আছেন। সিনেমার চিত্রনাট্য সিনেমাকে গতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে শেষ পর্যন্ত। বিরতির পর কিছু কিছু দৃশ্যে চিত্রনাট্য কিছুটা দুর্বল মনে হলেও সামগ্রিকভাবে চিত্রনাট্যের কাজটাতে নিজেদের মেধা আর শ্রমের সাক্ষর রাখতে সক্ষম ছিলেন এই দুইজন।
অন্যদিকে এই সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী উপাদান সিনেমার সংলাপ। সিনেমাতে অনেকগুলো সংলাপ আছে যা আপনার মনে ধরতে বাধ্য। যেমন, ‘ওদের ক্ষমতার উৎস কি? আমাদের নীরবতা’ কিংবা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক একটা মেয়েকে ধর্ষনের অধিকার দেয় পুরুষকে!’ কিংবা আপনি ঠিক বলেছেন কেস লড়া ছোটলোকদের কাজ না তাই আপনার মত বড়লোকদের দোয়া নিয়েই শুরু করতে চাই’ ইত্যাদি। সময়পোযোগী সংলাপ এবং তার যথাযত প্রয়োগ সিনেমাকে করেছে উপভোগ্য।
পরিচালনাঃ বেশ কয়েক বছর ধরেই সিনেমা পরিচালনা করছেন অনন্য মামুন। তবে এটা মানতে হবে যে এখন পর্যন্ত অনন্য মামুনের সেরা কাজ ‘নবাব এলএলবি’। নিজের গল্প বলার ধরনের সাথে আপেক্ষিক বিষয়গুলোর সংযোগ নিশ্চিত করতে পারাটা একজন পরিচালকের স্বার্থকতা। অনন্য মামুন ‘নবাব এলএলবি’ তে সেটা খুব ভালো ভাবেই করতে পেরেছেন। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সিনেমায় গান এবং মারামারির যে একটা অলিখিত ত্বথ্য আছে এই সিনেমায় অনন্য মামুন সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়েছেন। আর নিঃসন্দেহে পরিচালক সেটাতে সফল ছিলেন। তবে মামলার এজহারে আদালতে দুই উকিলের যুক্তি তর্কের জায়গাটা আরো শক্তিশালী করা যেতে পারতো। আর প্রথম অর্ধেকের তুলনায় বিরতির পরের অংশটুকু কিছুটা দুর্বল মনে হয়েছে।
অভিনয়ঃ শাকিব খান এই সিনেমার প্রাণ ভোমরা, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিরতির আগে এবং পরে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুইটি চরিত্রে নিজের অভিনয় দক্ষতা আর মেধার পরিচয় দিয়েছেন নতুন করে। ‘শিকারী’ সিনেমা দিয়ে বদলে যাওয়া ইমেজের যে যাত্রা শুরু করেছিলেন এই দেশ সেরা সুপারষ্টার সেটা আরো একবার প্রতিষ্টিত হলো এই ছবি দিয়ে।
শাকিব খানের পাশাপাশি স্পর্শিয়া তার চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তার চেহারার অভিব্যক্তি থেকে শুরু করে সংলাপ বলা সবকিছুতে একটা পরিপূর্নতা ছিলো। শাকিব অব স্পর্শিয়ার তুলনায় মাহির চরিত্রের গভীরতা কম ছিলো। তার চরিত্রে সে ভালো করেছে। শাকিব এবং স্পর্শিয়া ছাড়া আরো একজনের কথা আলাদাভাবে বলতে হচ্ছে – রাশেদ মামুন অপু। একজন নেশাখোর, নারীভোগী এবং বদমেজাজীর চরিত্রে নিখুঁত অভিনয় ছিলো অপুর।
তবে সিনেমার প্রেক্ষাপট (আদালত ভিত্তিক) বিবেচনায় অন্য দুইটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের পাত্রপাত্রীদের অভিনয় সিনেমার জন্য কিছুটা মাইনাস হবে। আজহার চৌধুরী চরিত্রে শাহিদুজ্জামান সেলিম এবং বিচারকের চরিত্রে শবনম পারভীন। মামলার এজহারে যুক্তি-তর্কে যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উপস্থাপন দরকার ছিলো সেলিম সেখানে ব্যর্থ। আর বিচারক হিসেবে শবনম পারভীনের কিছু কিছু সংলাপ রীতিমত হাস্যকর মনে হয়েছে। বাকি চরিত্র রূপদানকারী পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের চরিত্র মোটামুটি সামলে নিয়েছেন।
উপসংহারঃ সময় এবং প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সময়োপযোগী একটি বিষয়ের সুন্দর উপস্থাপনার নাম ‘নবাব এলএলবি’। একটি শাকিবময় সিনেমা হলেও শাকিব খানের অন্য সিনেমাগুলো থেকে ভিন্নভাবে দেখতে পাবেন এই তারকাকে। বলিউডের জলি এলএলবি সিনেমার আদলে বা ওই সিনেমা থেকে কিছুটা উৎসাহিত হলেও গল্পে যেমন ভিন্নতা আছে তেমনি আছে মনকে স্পর্শ করে যাওয়া কিছু দৃশ্য আর সংলাপ। একটি সামগ্রিক ভালো প্রয়াস এই সিনেমা। সিনেমাতে যেমন একটা সংলাপ ছিলো – আমি হেরে গেলে হেরে যাবে এ দেশের সকল ধর্ষনের শিকার মেয়ে আর ধর্ষকরা পেয়ে যাবে ধর্ষনের লাইসেন্স! একইভাবে আমিও বলতে চাই ‘নবাব এলএলবি’ নামক এই চেষ্টা যদি হেরে যায় তাহলে যাবে আরো ভালো কিছুর আশা।
আরো পড়ুনঃ
‘নবাব এল এল বি’র ১১ দৃশ্যে সেন্সর বোর্ডের আপত্তি: পুনর্বার জমা দেয়ার প্রস্তুতি
নবাব এলএলবি: কতটা মনোযোগ দিয়ে আপনি দেখলেন সিনেমাটি?
শাকিব খান ভক্তদের অগ্নি পরীক্ষা: দেখুন আপনি কেমন শাকিব ভক্ত!