চলচ্চিত্রের নামঃ মিশন ইম্পসিবলঃ ডেড রেকনিং – পার্ট ওয়ান (২০২৩)
মুক্তিঃ জুলাই ১২, ২০২৩
অভিনয়েঃ টম ক্রুজ, হেইলি অ্যাটওয়েল, ভিং রমেস, সাইমন পেগ, রেবেকা ফার্গুসন, ভেনেসা কিরবি, এসাই মোরালেস, পম ক্লেমেন্টিফ, মারিলা গ্যারিগা, হেনরি চের্নি প্রমুখ
পরিচালনাঃ ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি
প্রযোজনাঃ টম ক্রুজ এবং ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি
পরিবেশনাঃ প্যারামাউন্ট পিকচার্স
কাহিনী এবং চিত্রনাট্যঃ ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি এবং এরিক জেন্দ্রেসেন (ব্রুস গেলার মিশন ইম্পসিবল অবলম্বনে)
সম্পাদনাঃ এডি হ্যামিলটন
সিনেমাটোগ্রাফিঃ ফ্রেজার ট্যাগগার্ট
সংগীতঃ লরনে বাল্ফ
প্রারম্ভিক কথাঃ হলিউডের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাণিজ্যিক সফল ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘মিশন ইম্পসিবল’। এই ফ্র্যাঞ্চাইজির মুক্তিপ্রাপ্ত আগের ছয়টি সিনেমাই বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো। এই ফ্র্যাঞ্চাইজির ইথান হান্ট হলিউড সুপারস্টার টম ক্রুজের ক্যারিয়ারের অন্যতম আইকনিক একটি চরিত্র। আগেই জানা গিয়েছিলো সপ্তম পর্বের মাধ্যমে শেষ হতে যাচ্ছে ‘মিশন ইম্পসিবল’ ফ্র্যাঞ্চাইজির যাত্রা। আর এই সপ্তম সংস্করণটি নির্মিত হতে যাচ্ছে মোট দুই পর্বে। সন্দেহাতীতভাবে ঘোষণার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী দর্শদকের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে ‘ডেড রেকনিং’। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার প্রথম পর্ব দর্শকদের প্রত্যশার কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে সেটি নিয়ে আলোচনা থাকছে আজকের রিভিউতে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ বরাবরের মতই একজন সিক্রেট এজেন্টের প্রাণঘাতী মিশনের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘মিশন ইম্পসিবলঃ ডেড রেকনিং – পার্ট ওয়ান’। গল্পের শুরুতে দেখা যায় আমস্টারডামে অবস্থানকালে নতুন একটি মিশন পায় ইথান হান্ট (টম ক্রুজ)। স্বয়ংক্রিয় ভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া এক বার্তার মাধ্যমে তাকে একটি বিশেষ ‘সত্তা’ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। এটি এমন একটি জিনিষ যা খোলার জন্য একটি চাবির দুটি অংশকে একসাথে জোড়া লাগাতে হবে। এই বিশেষ সত্তাটি আসলে কি সে ব্যাপারে তাকে বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, এটি খুবই শক্তিশালী একটি জিনিস এবং এর জন্য পৃথিবীর যেকোন সরকার যেকোন মূল্য দিতে প্রস্তুত।
ইথান হান্টের কাজ হচ্ছে কোন ভুল মানুষের হাতে যাওয়ার আগেই এই চাবির দুটি অংশ উদ্ধার করা। স্বাভাবিকভাবেই, ইথান হান্ট এটি উদ্ধার করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর সব বড় দেশের কর্তারা তাকে ধাওয়া করবে। ইথান তাই চাবি উদ্ধারের পাশাপাশি সেই ‘সত্তা’কে ধ্বংস করার মিশন হাতে নেয়। প্রতিবারের মত বেনজি (সাইমন পেগ) এবং লুথার (ভিং রেমেস) এই মিশনে যোগ দেয়। ইথান যখন তার মিশন শুরু করে, তখন সে রহস্যময় গ্রেস (হেলি অ্যাটওয়েল), প্রাক্তন সহকর্মী ইলসা (রেবেকা ফার্গুসন) এবং ইথানের পুরানো শত্রু গ্যাব্রিয়েলের (এসাই মোরালেস) মুখোমুখি হয়। মিশনে এরপর কি কি ঘটে সেটি নিয়েই তৈরি হয়েছে সিনেমার বাকী অংশ।
গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি এবং এরিক জেন্দ্রেসনের গল্পটি দুর্দান্ত। সম্ভবত এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেক্ষাপটে সাজানো হয়েছে গল্পটি। ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি এবং এরিক জেন্দ্রেসনের চিত্রনাট্য প্লটটির প্রতি সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করেছে। গল্প এবং চিত্রনাট্য দিয়ে লেখকদ্বয় এবারের ‘অসম্ভব মিশন’কে আসলেই খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। শুধু শত্রুদের কারণেই নয়, সেই ‘সত্তা’র সাথে জড়িত জটিলতার কারণেও সিনেমাটির প্লটটি দারুণ আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। দর্শকরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তেজনা অনুভব করবেন। পাশাপাশি সিনেমাটির সংলাপগুলো খুব ভালভাবে গল্প এবং চরিত্রের সাথে মানিয়ে গেছে।
পরিচালনাঃ ক্রিস্টোফার ম্যাককোয়ারির পরিচালনা ছিলো অসাধারণ। একটি অসাধারণ সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এছাড়া সিনেমাটির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো খুব চিত্তাকর্ষক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে হলিউডে এমন অ্যাকশন আগে দেখা যায়নই। সিনেমাটিতে দেখা কিছু প্রযুক্তিগত বিস্ময় এবং চ্যালেঞ্জও দর্শকদের অবাক করে দেবে। ১৬৩ মিনিট ব্যাপ্তির সিনেমাটির কিছু কিছু জায়গা ধীর মনে হলেও, এটি কখনই বিরক্তিকর হয়ে উঠেনি। তবে কিছু কিছু জায়গায় কিছুটা বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। চাবিগুলো এতবার হাত বদল হয় যে কিছু জায়গায় ট্র্যাক রাখা কঠিন হতে পারে। এছাড়াও, দ্বিতীয়ার্ধের মাঝখানে কয়েকটি দৃশ্যের তেমন কোন কাঙ্ক্ষিত প্রভাব দেখা যায়নি।
‘মিশন ইম্পসিবলঃ ডেড রেকনিং – প্রথম পর্ব’ দুর্দান্তভাবে শুরু হয়েছিলো। আরবের মরুভূমির দৃশ্য বেশ দর্শনীয় যদিও অসাধারণ বলা যাবে না। এর পরের কিছু দৃশ্য ধীর গতির হলেও সেগুলো অপ্রত্যাশিত উপায়ে শেষ হয়। বিমানবন্দরের দৃশ্যটি অসামান্য। সেখানে উন্মাদনা যোগ করতে, ইথান এবং তার দলকে দুটি সম্মুখ বিপদ মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। ভেনিসের চেজ সিকোয়েন্সে শুধু চমত্কার অ্যাকশনের সাথে প্রচুর হাস্যরসও রয়েছে। মধ্যের অ্যাকশন দৃশ্যটি ভালো ছিলো, তবে সিনেমাটির সেরাটি শেষের জন্য রেখে দিয়েছিলেন নির্মাতার। দ্বিতীয় পর্বে আরো বড় এবং বিস্ময়কর কিছুর আশ্বাস দিয়ে শেষ হয় ‘ডেড রেকনিং – প্রথম পর্ব’।
অভিনয়ঃ প্রত্যাশিতভাবেই টম ক্রুজ সিনেমাটিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। এই বয়সে তাকে নিখুঁতভাবে অ্যাকশন স্টান্ট করতে দেখা সত্যি আশ্চর্যজনক এক অভিজ্ঞতা। একটি পাহাড় থেকে বাইক নিয়ে লাফ দেওয়ার দৃশ্যটি দর্শকদের হাততালির উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছিলো। অভিনয়ের পাশাপাশি একজন প্রযোজক হিসাবে সিনেমাটি সম্ভাব্য সর্বোত্তম স্কেলে নির্মান নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছেন। সাইমন পেগ নির্ভরযোগ্য এবং বিমানবন্দরের দৃশ্যে তার সেরা অভিনয়ের অংশ হয়ে থাকবে। পর্দায় সময় সীমিত থাকলেও লুথার চরিত্রে ভিং রেমেস সুন্দর অভিনয় করেছেন।
হেইলি অ্যাটওয়েল এই সিনেমায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং এটিকে তিনি সাবলীলভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন। রেবেকা ফার্গুসন একটি সহায়ক একটি চরিত্রে ভালো অভিনয় করছেন। তার সাথে ইথানের সম্পর্কের মাধ্যমে সিনেমাটিতে একটি আবেগের এঙ্গেল এনেছেন পরিচালক এবং এই অংশে তিনি প্রভাব ফেলেছেন। খলনায়কের চরিত্রে এসাই মোরালেস মোটামুটি মাননসই ছিলেন। ভ্যানেসা কিরবি (শ্বেত বিধবা), হেনরি চের্নি (ইউজিন কিট্রিজ), পম ক্লেমেন্টেফ (গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকারী প্যারিস) এবং শিয়া হুইঘাম (জ্যাসপার ব্রিগস) নিজেদের চরিত্রে সুন্দর অভিনয়ের মাধ্যমে সিনেমাটিতে উপভোগ্য করতে সক্ষম ছিলেন।
সঙ্গীত চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ লরনে বাল্ফ-এর সঙ্গীত সিনেমাটিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এই সিনেমায় আমরা মূল সঙ্গীতটি শুনতে পাই যা দর্শকদের উত্তেজিত করবে নিশ্চিতভাবে। ফ্রেজার ট্যাগার্টের সিনেমাটোগ্রাফি কিছুটা নড়বড়ে, তবে অ্যাকশন দৃশ্যের মাধ্যমে সেটি কিছুটা কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। বিশেষকরে ট্রেনের সিকোয়েন্সে এটি বেশ নৈসর্গিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্যারি ফ্রিম্যানের প্রোডাকশন ডিজাইন সমৃদ্ধ ছিলো। অ্যাকশন এই সিনেমার অন্যতম প্রধান আকর্ষন। মজার বিষয় হল, সিনেমাটিতে অপেক্ষাকৃত কম রক্তপাত দেখানো হয়েছে। ভিএফএক্স নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের ছিলো। এডি হ্যামিল্টনের সম্পাদনা ঝরঝরে কিন্তু আরো তীক্ষ্ণ হতে পারত।
উপসংহারঃ সামগ্রিকভাবে, ‘মিশন ইম্পসিবলঃ ডেড রেকনিং – প্রথম পর্ব’ আপনার টাকার মূল্য আপনাকে ফিরিয়ে দিবে। ফ্র্যাঞ্চাইজির জনপ্রিয়তা, অসাধারণ প্রচার, বিরতিহীন বিনোদন এবং ৬০ বছর বয়সী টম ক্রুজের অভিনয় দেখার উত্তেজনা এবং কৌতূহল দর্শকদের অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে আসবে। এছাড়া প্রথম পর্বে গল্পের মূল ভীত তৈরি করেছেন নির্মাতারা। চাবি দুটি দিয়ে কি খোলা যাবে এবং সেখানে কি আছে – এটিই এই সিনেমার আগামী পর্বের মূল আকর্ষন। নিঃসন্দেহে ‘ডেড রেকনিং’ দ্বিতীয় পর্ব আরো বেশী উত্তেজনাকর হতে যাচ্ছে।
আরো পড়ুনঃ
ফাস্ট টেন রিভিউ
নো টাইম টু ডাই রিভিউ
প্রিয়তমা রিভিউ