চলচ্চিত্রের নামঃ কসাই (২০২১)
মুক্তিঃ মে ১৪, ২০২১
অভিনয়েঃ নিরব হোসেন, রাসেদ মামুন অপু, প্রিয়মনি, নওশাবা, ক্রিস্টিয়ানো তম্ময়, ফারহানা খান রিও, এলিনা শাম্মি, তানজীলা হক, শাহীন মৃধা প্রমুখ।
পরিচালনাঃ অনন্য মামুন
প্রযোজনাঃ সেলিব্রেটি প্রডাকশন্স
পরিবেশনাঃ আই থিয়েটার (ওটিটি)
কাহিনী এবং চিত্রনাট্যঃ অনন্য মামুন
সংলাপঃ পাপ্পু রাজ এবং সোহাগ বিশ্বাস
সম্পাদনাঃ হালিম আহমেদ অতিশ
চিত্রগ্রহনঃ বিএম নাজমুল
সংগীতঃ লিংকন এবং অধ্যায়ন ধর
প্রারম্ভিক কথাঃ ‘নবাব এলএলবি’ মুক্তির পর সিনেমাটির কিছু সংলাপ নিয়ে বিতর্কের মুখে পরেছিলেন আলোচিত নির্মাতা অনন্য মামুন। এরই প্রেক্ষিতে পরিচালক সমিতি থেকেও আজীবনের জন্য বহিষ্কার হন এই পরিচালক। এরপর একসাথে ৫টি সিনেমার ঘোষনা দিয়েছিলেন তিনি। সেই ৫ সিনেমার একটি ‘কসাই’ মুক্তি পেয়েছে এই ঈদে। করোনা পরিস্থিতির কারনে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না দিয়ে সিনেমাটি সরাসরি মুক্তি দেয়া হয়েছে ওটিটি প্লাটফর্ম আই থিয়েটারে। ফার্স্ট লুক থেকে শুরু করে ট্রেলার সবকিছুতেই প্রশংসিত হয়েছেন পরিচালক অনন্য মামুন। এছাড়া ‘নবাব এলএলবি’ এবং ‘মেকাপ’ সিনেমা দুটির কারনে স্বভাবতই ‘কসাই’ সিনেমার প্রতি সবার আগ্রহ এবং প্রত্যাশা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশী ছিলো। তাহলে কেমন হলো অনন্য মামুনের নতুন উপহার ‘কসাই’? অনন্য মামুন কি পেরেছিলেন তার প্রতি সবার সেই প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে? কসাই রিভিউ বিস্তারিততে সেই বিষয়গুলো নিয়েই থাকছে আলোচনা।
কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘কসাই’ সিনেমার কাহিনী গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত বিদেশ যাত্রীদের সাথে প্রতারণার গল্প নিয়ে। বিদেশে পাঠানোর নাম করে “Human Trafficing” এর ঘটনা ঘটে থাকে, সেটাকে প্রতিপাদ্য অনন্য মামুন সাজিয়েছেন এই সিনেমার গল্প। সিনেমার গল্পে দেখা যায়, নিজের এবং নিজের পরিবারের একটি ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে পাঁচ তরুন পাড়ি জমাতে চান বিদেশে। কিন্তু একটি প্রতারক ট্র্যাভেল এজেন্সির খপ্পরে পরে বিদেশ পাঠানোর নাম করে তাদেরকে অপহরণ করে সেই প্রতারক চক্র। উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করে মেরে ফেলা। অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তেজনাবশত এই পাঁচ জনের একজনকে মেরে ফেলে প্রতারক চক্রের একজন নুরু, যে নিজেকে নুরু কসাই বলে সম্বোধন করে। অপহরণ করে বাকি চার জনকে ভাঙ্গা উপজেলার একটি চরে বন্দী করে রাখে নুরু কসাই।
এই চারজকে আটকে রেখে তাদের পরিবারকে ফোন করে একটি ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিয়ে টাকা পাঠাতে বলা হয়। আটক চারজনকে ইতালি যাচ্ছে বলে টাকা পাঠানোর কথা বলতে বাধ্য করে নুরু কসাই। এদিকে বন্দী চারজনের একজন, আবীরের সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর এতে সন্দেহ হলে যে বিষয়টি ডিবি পুলিশকে জানায়। বিষয়টি নিয়ে অবগত হওয়ার পর ডিবি পুলিশ বাকী তিনজনের পরিবারের সাথে কথা বলে এবং তা নিয়ে নিজেদের মত করে তদন্তে নামে। প্রথম ক্লু হিসেবে পাঁচজনের মধ্যে প্রথমে খুন হওয়া সেই তরুণের পরিবারকে জানায়। অন্যদিকে সেই প্রতারক ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক নুরু কসাইকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে এবং বিষয়টি যে ডিবি পুলিশের কাছে কাছে গেছে সেটা নুরুকে জানায়। এরপর নুরু কসাইয়ের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া এবং আটক সবাইকে উদ্ধারে ডিবির প্রচেষ্ঠা নিয়ে এগিয়ে যায় সিনেমা গল্প। ডিবি কি পারবে সবাইকে জীবিত উদ্ধার করতে? নুরু কসাই কি শেষ পর্যন্ত ডিবির হাতে ধরা দিবে? কি হবে সেই প্রতারক ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিকের? আবীর সহ বাকিরা কি পারবে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে? উদ্বিগ্ন পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়া ওয়াদা কি রক্ষা করবে পারবেন ডিবি এডিসি নাজনিন? এসব প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে এগিয়ে গেছে সিনেমার গল্প।
গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ সিনেমার গল্প এবং প্লট নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ‘কসাই’ সিনেমার গল্প খুবই ভালোভাবে দাড় করিয়েছেন অনন্য মামুন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে, গল্পটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়া অনন্য মামুনের এই গল্পের অন্যতম ভালো দিক ছিলো ধারাবাহিকতা। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি এগিয়ে গেছে একটা নির্দিষ্ট পথে। নুরু কসাইয়ের স্ত্রীর চরিত্রে একটু টুইস্ট রেখেছেন গল্পটির লেখক অনন্য মামুন, যা দর্শক সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে এসে বুঝতে পারবেন।
গল্পের মত পরিচালনার পাশাপাশি সিনেমাটির চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন নির্মাতা অনন্য মামুন। আগের সিনেমাগুলোর মত এই সিনেমায়ও চিত্রনাট্যের ব্যাপারে যতেষ্ঠ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। ভালো একটি গল্পকে পর্দায় আরো দৃষ্টিনন্দন করার জন্য চিত্রনাট্য যেরকম হওয়া উচিৎ অনন্য মামুন সে দিকটাতে বেশ মনযোগী ছিলেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য আরেকটু ভালো হতে পারতো। তাছাড়া কয়েকটি চরিত্রকে চিত্রনাট্যে আরো গুরুত্ব দিলে সেটা দর্শককে অতিরিক্ত কিছু তৃপ্তি দিতো। সম্ভবত চিত্রনাট্যের সবচেয়ে দূর্বল অংশ ছিলো ডিবি অফিস এবং ডিবি’র তদন্তের অংশটুকু। যে ধারাবাহিকতায় সিনেমার গল্প এগিয়ে গেছে সে তুলনায় ডিবি’র তদন্তের অংশের চিত্রনাট্যে যততুকু উত্তেজনা দরকার ছিলো সেখানে কিছুটা কমতি দেখা গেছে। এই অংশটুকু বাদ দিলে অনন্য মামুনের চিত্রনাট্য তার গল্পের প্রতি যতেষ্ঠ ন্যায়বিচার করেছে বলবো। আর যেটুকু কমতি দৃশ্যমান ছিলো সেটা সম্ভবত গল্প এবং চিত্রনাট্য একই লেখকের হওয়ার কারনে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনন্য মামুনের সিনেমার অন্যতম আলোচ্য দিক হচ্ছে সিনেমার সংলাপ। ‘কসাই’ সিনেমার সংলাপও বেশ ভালো ছিলো। সম্ভবত চারিত্রিক গঠন ফুটিয়ে তুলতে নুরু কসাইয়ের সংলাপে কিছু গালির ব্যবহার আছে যা সিনেমায় মিউট করে দেয়া হয়েছে। আর সিনেমার ‘কসাই’ নামকে যৌক্তিক করতে আবীরের সেই স্বপ্ন এবং হিংস্রতার সংলাপটি পুরো সিনেমাকে একটা ব্যাকরণগত ব্যাখ্যা দিয়েছে।
পরিচালনাঃ পরিচালক হিসেবে অনন্য মামুনের পরিপক্ষতার আরো একটি স্বাক্ষর তার নতুন নির্মান ‘কসাই’। একজন পরিচালক তার নিজের মধ্যে যে স্বপ্নদর্শন লালন করেন তার পূর্নতা পর্দায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য মামুন আবারো সফলতা দেখিয়েছেন। কিছু কিছু দৃশ্যে কিছুটা ছন্দপতন ছাড়া ‘কসাই’ সিনেমাতে যতেষ্ঠ পরিপক্ষতা দেখিয়েছেন অনন্য মামুন। একজন পরিচালক হিসেবে পুরো সিনেমায় তার দূর্বলতা বলতে ডিবি পুলিশের তদন্তের দৃশ্যগুলো ঘুরেফিরে আসবে বারবার। এই দৃশ্যগুলোকে আরো বেশী প্রাণবন্ত এবং উপভোগ্য কতে তোলার সুযোগ হাতছাড়া করেছেন অনন্য মামুন। এছাড়া ডিবি অফিসারদের অভিনয় এবং সংলাপ বলার ধরন অনেকটা রবোটিক মনে হতে পারে, যা একজন পরিচালক হিসবে অনন্য মামুনের আরো মনযোগের দাবী রাখে। আটক সেই চার তরুনের পরিবারের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাকে আরো জোরালো ভাবে উপস্থাপনের পাশাপাশি কয়েকটি চরিত্রকে নিয়ে কাজ শুরু সুযোগ ছিলো বলে মনে হচ্ছে। তবে এই ছোট কয়েকটি বিষয় বাদে সিনেমাটিতে অনন্য মামুনের পরিচালনা এবং নির্মানশৈলী অসাধারণ না বললে সেটা কার্পন্য হবে।
অভিনয়ঃ ‘কসাই’ সিনেমার প্রানভোমরা সিনেমাটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা রাশেদ মামুন অপু (নুরু কসাই)। পুরো সিনেমাকে অনেকটাই নিজের একক প্রদর্শনী করে নিয়েছেন অপু। নৃশংস এবং পাশবিক এই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে নিজের সেরা কাজটাই উপহার দিয়েছেন তিনি। খলচরিত্রে এর আগে অপুকে দেখা গিয়েছিলো ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমায়, যেখানে তার অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সবাই। ‘কসাই’ সিনেমা দিয়ে তার সেই অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছেন অপু। চোখে মুখে সেই নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি একজন সাইকপ্যাথ কিলার হিসেবে তার অঙ্গভঙ্গি এবং অভিব্যাক্তি সিনেমাকে দিয়েছে অন্যরকম এক আমেজ।
অপু ছাড়া সিনেমার অন্য দুইটি প্রধান চরিত্রের একটি আবীর। আটক সেই চার জনের একজন চরিত্রে যতেষ্ট ভালো অভিনয় করেছেন নিরব। যদিও সিনেমাতে তার বিশেষ কোন জায়গা ছিলো না কিন্তু ক্লাইম্যাক্সে এসে তিনিই হয়ে উঠেন নায়ক। আর আবীরের অন্তঃসত্বা স্ত্রীর চরিত্রে প্রিয়মনির অভিনয়ও প্রশংসার দাবী রাখে। ছোট চরিত্র হলেও প্রিয়মনি পর্দা উপস্থিতি ভালো প্রভাব বিস্তার করেছে।
মূলত ‘কসাই’ সিনেমার গল্পে এই তিনটি চরিত্রই আলাদাভাবে উঠে এসেছে। তবে এর বাইরে নুরুর স্ত্রী চরিত্রে নওশাবা উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এই চরিত্রটিকে পরিপূর্নভাবে উপলব্ধি করতে আপনাকে ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাকী অন্যান্য চরিত্রে অভিনয়কৃত সবাই যার যার জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন। শুধুমাত্র দূর্বলতা বলতে ডিবি টিমের সদস্য হিসেবে অভিনয়কৃত অভিনেতা অভিনেত্রীরা। ডিবি টিমের সদস্যদের অভিনয় এবং সংলাপ বলার ধরন কিছুটা যান্ত্রিক মনে হয়েছে।
চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ গল্প এবং পরিচালনার পর ‘কসাই’ সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিলো সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ। বিএম নাজমুলের চিত্রগ্রহণ আপনাকে একটা আবেশের মধ্যে ঘোরপাক খাওয়াবে। প্রতিটা দৃশ্যের চিত্রগ্রহণ এবং পর্দায় সেটার যথোপযুক্ত উপস্থাপনের চেষ্টা নাজমুলের চিত্রগ্রহণে দৃশ্যমান ছিলো। বিশেষ করে গ্রামের মেঠোপথে নুরু কসাইয়ের সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আপনাকে অন্যরকম একধরনের ভালোলাগা দিবে। অন্যদিকে সিনেমাটির সম্পাদনাও ভালো ছিলো। হয়তো আরো কিছুটা ভালো করা যেতে পারতো।
উপসংহারঃ ‘সিনেমায় নায়ক থাক বা না থাক, গল্পই সিনেমার নায়ক হওয়া উচিৎ’ – এ তথ্যের বাস্তব রুপ ঢালিউডে এর আগে দেখা যায়নি সেটা বলবো না। তবে সেই ছোট লিস্টের অন্যতম স্থানে থাকবে ‘কসাই’। গতানুগতিক স্টার নির্ভর এবং প্রচলিত ফর্মুলা ভিত্তিক সিনেমার বাইরের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি পূর্নতা পেয়েছে অনন্য মামুনের অসাধারণ নির্মানশৈলীর মাধ্যমে। সবকিছুকে ছাপিয়ে গল্প, চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত এই সিনেমার নায়ক অনন্য মামুন। এই সিনেমার ক্ষেত্রে আপনার খরচ ২০ টাকা আর ২ ঘন্টা কিন্তু সিনেমা থেকে পাওয়া আপনার প্রশান্তির মূল্য আরো অনেক বেশী হবে। সময়ক্ষেপণ না করে আজই দেখে নিতে পারেন অনিরুদ্ধ অনন্য মামুনের নতুন উপহার ‘কসাই’।
আরো পড়ুনঃ
নবাব এলএলবি রিভিউঃ সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী সিনেমা
মেকাপ রিভিউ: অনন্য মামুনের হাত ধরে আরো একটি সুনির্মিত সিনেমার অভিজ্ঞতা