‘ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪’ রিভিউ: একটি সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা

ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪

চলচ্চিত্রের নামঃ ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪ (২০২০)
মুক্তিঃ ডিসেম্বর ১৬, ২০২০ ( ইউকে) এবং ডিসেম্বর ২৫, ২০২০ (ইউএসএ)
অভিনয়েঃ গাল গ্যারোট, ক্রিস পাইন, ক্রিস্টেন উইং, পেড্র পাসকেল, রবিন রাইট, কোনই নিলসেন, লিলি আসপেল এবং নাতাশা রোটওয়েল প্রমুখ।
পরিচালনাঃ পেটি জেনকিন্স
প্রযোজনাঃ চার্লস রোবেন, দেবরাহ সিনডার, হ্যাক স্নাইডার, পেটি জেনকিন্স, গাল গ্যারোট এবং স্টিফেন জোন্স
পরিবেশনাঃ ওয়ার্নার ব্রাদার্স পিকচার্স
কাহিনি ও সংলাপঃ পেটি জেনকিন্স এবং জেফ জোন্স
চিত্রনাট্যঃ পেটি জেনকিন্স, ডেভিড কোলহাম এবং জেফ জোন্স
সম্পাদনাঃ রিচার্ড পারসন
চিত্রগ্রহনঃ ম্যাথিউ জেনসেন
সংগীতঃ হান্স জিমার>

প্রারম্ভিক কথাঃ ২০১৭ সালে মুক্তির পর বিশ্বজুড়ে দর্শক এবং সমালোচকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলো পেটি জেনকিন্স পরিচালিত গাল গ্যারোট অভিনীত ‘ওয়ান্ডার ওমেন’ সিনেমাটি। এর পরপরই ঘোষনা এসেছিলো একই পরিচালক-অভিনেত্রী জুটিকে নিয়েই নির্মিত হবে ‘ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪’। প্রথম পর্বের সফলতার কারনে সংগত কারনেই সবার নতুন এই সিনেমার প্রতি আকর্ষন ছিল। করোনার কারণে যথা সময়ে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি, অবশেষে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুক্তি পেয়েছে  ‘ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪’। কেমন হলো এমাজনের প্রিন্সেস ডায়ানার নতুন এই অভিযাত্রা? চলুন শুরু কর পর্যালোচনা।

কাহিনী সংক্ষেপঃ ওয়ান্ডার ওম্যান ১৯৮৪ একজন নারী সুপারহিরোর গল্প যে ক্ষমতালোভী একজন মানুষের কাছ থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর লড়াই করে। সিনেমার প্রেক্ষাপট ১৯৮৪ সালের যেখানে দেখা যায় ডায়ানা প্রিন্স (গাল গ্যারোট) ওয়াশিংটন ভিত্তিক স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে একজন নৃবিজ্ঞানী হিসাবে কর্মরত। ডায়ানা প্রিন্স এখনও স্টিভ ট্রেভর (ক্রিস পাইন) এর স্মৃতি ভুলতে পারেনি। এই প্রতিষ্ঠানে বারবারা মিনার্ভা (ক্রিস্টেন উইং) নাম নতুন একটি মেয়ে চাকরিতে আসে। বারবারা মিনার্ভা নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে এবং ডায়ানা প্রিন্সকে দেখে নিজেকে আরো অসুন্দর মনে করতে থাকে। এইদিকে ডায়ানা প্রিন্স ওয়ান্ডার ওমেন হিসেবে নিজের কাজ চালিয়ে যায়, যার ধারাবাহিকতায় সে একটি জুয়েলারী দোকানকে ডাকাতি হওয়া থেকে রক্ষা করে। কিন্তু পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে দেখা যায় যে, ওই জুয়েলারী ঢোকানের পিছনে এর মালিক প্রত্নতাত্বিক পুরাকীর্তি কালো বাজারে বিক্রি করে থাকে। ইনভেস্টিগেশনের অংশ হিসেবে এফবিআই উদ্ধারকৃত পুরাকীর্তিগুলো স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে পাঠায়। আর এই পুরাকীর্তিগুলো পর্যালোচনার দায়িত্ব দেয়া হয় বারবারা মিনার্ভাকে।

নিজের আগ্রহ থেকে ডায়ানা প্রিন্সও এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করে। ডায়ানা এবং বারবারা আবিষ্কার করে এই পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে যে ড্রিমষ্টোন পাওয়া গেছে তাতে এমন কিছু উপাদানের উপস্তিতি আছে যা স্পর্শ করে কোন কিছুর ইচ্ছা পোষণ করলে সে ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়। কৌতুহলবশত বারবারা এই স্টোন স্পর্শ করে ডায়ানার মত আকর্ষণীয় হতে চায় এবং ডায়ানা স্টিভকে চায়। পরের দিন ডায়ানা বুঝতে পারে যে তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। সেই দিনই একজন উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়ী এবং টিভি ব্যক্তিত্ব মেক্সওয়েল লর্ড (পেড্রো পাসকেল) স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে আসে। সে এই ইনস্টিটিউটের একজন অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। এই ইন্সটিটিউটে আসার মাধ্যমে মেক্সওয়েল বারবারার কাছাকাছি আসে। বারবারাও তার প্রতি এরকম একজন ব্যক্তিত্বের আগ্রহের কারনে মেক্সওয়েলের দিকে ঝুকে পরে। কিন্তু পরবর্তীতে সে জানতে পারে যে, মেক্সওয়েল বড় ধরনের দেনার মধ্যে আছে এবং একটি ভুয়া স্কিম দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। আর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তার এই ড্রিমস্টোন খুবই প্রয়োজন এবং এর জন্যই বারবারার সাথে তার বন্ধুত্ব।

নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য মেক্সওয়েল বারবারার কাছ থেকে সেই ড্রিমস্টোনগুলো চুরি করে। ড্রিমস্টোন চুরি করে স্বাভাবিক কোন ইচ্ছা পোষণ না করে মেক্সওয়েল নিজেই ড্রিমস্টোন হয়ে অন্যদের ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে হতে চায়। অন্যদিকে ডায়ানা স্টিভকে ফিরে পেয়ে নিজের সময়কে উপভোগ করতে থাকে। ম্যাক্সওয়েল ড্রিমস্টোন হয়ে যাওয়ার পর কি হয়? ডায়ানা কি পারে এই অশুভ শক্তির কাছ থেকে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করতে?

চিত্রনাট্য এবং সংলাপঃ পেটি জেঙ্কিন্স, জেফ জোন্স এবং ডেভিড ক্যালহাম জৌথভাবে এই সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। এই সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে ডিসি ইউনিভার্সের অন্য কোন সিনেমার সাথে এর কোন সংযোগ নেই। ওয়ান্ডার ওমেন দেখে থাকলে দর্শকরা খুব সহজেই সিনেমাটিকে বুঝতে পারবেন। সিনেমার চিত্রনাট্য সিনেমাটির গল্পকে দর্শকদের কাছে করেছে আরো আন্দনদায়ক। ডিসির সিনেমাগুলো সাধারণত একটু ডার্ক ধরনের জয়ে থাকে কিন্তু এই সিনেমার চিত্রনাট্য পুরোপুরি দর্শকদের বিনোদনের কথা মাথায় রেখেই লিখা হয়েছে বলে মনে হয়। সিনেমার সংলাপ কাহিনী এবং চিত্রনাট্যকে সমর্থনের জন্য যথেষ্ট তীক্ষ্ণ ছিলো। সুপারহিরো ভিত্তিক সিনেমাগুলোর বিচ্ছিন্ন অংশ সংযোগ করাতে সম্পাদনা অনেক গুরুত্ব বহন করে। রিচার্ড পারসন তার দক্ষতা দিয়ে এই সিনেমায় সেটা সফলভাবেই করতে পেরেছেন।

পরিচালনাঃ পেটি জেনকিন্সের পরিচালনা আরো একবার সবাইকে পুলকিত করবে। এর আগে ওয়ান্ডার ওমেন সিনেমাটি ১৪১ মিনিটের হলেও দর্শকদের স্ক্রিনের সাথে ধরে রাখতে পেরেছিলেন জেনকিন্স। এই সিনেমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি, ২ ঘন্টা ৩১ মিনিটের এই সিনেমাতে আপনাকে ধরে রাখার যথেষ্ট উপাদান রেখেছেন পেটি। সিনেমাটির একশন দৃশ্যগুলো খুবই দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন পেটি, বিরতির আগের একশন দৃশ্যগুলো বিরতির পরের দুর্দান্ত একশনের মহড়া হিসেবে দেখতে পারেন। শুধু মারপিটের দৃশ্য নয়, ডায়ান এবং স্টিভের রোমান্সের দৃশ্যগুলোও ভালোভাবে চিত্রায়ন করেছেন পেটি। বিশেষ করে সিনেমার ক্লাইমেক্সে পরিচালক তার রুচি এনং মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। শুধুমাত্র ম্যাক্সওয়েলের স্মৃতিচারণের অংশটুকু খুব গিতিশীল একটা গল্পের মধ্যে কিছু স্তবিরতার কারণে হতে পারে।

অভিনয়ঃ প্রথম পর্বের মত এই সিনেমায়ও ওয়ান্ডার ওমেন হিসেবে গাল গ্যারোট ছিলেন অনন্য। সিনেমা তার অভিনয় দিয়ে এই চরিত্রকে এমনভাবে রূপদান করেছেন যে, ওয়ান্ডর ওমেন হিসেবে দর্শক অন্য কাউকে চিন্তা করতে পারেনা। ডিসি সিনেমা কিছুটা ডার্ক ধরনের হলেও গাল গ্যারোট পর্দার সেই অন্ধকার দূর করে আলোকিত উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে প্রথম পর্বের তুলনায় এই সিনেমায় নিজের চরিত্রের ব্যাপ্তি বেশী পেয়েছেন ক্রিস প্রিন্স। এবং এই সুযোগকে কাজে লাগাতে সফল ছিলেন তিনি। ক্রিস্টেন উইং তার চরিত্রের প্রতি ভালোই সুবিচার করেছেন। আর একজন খারাপ মানুষের চরিত্রে পেড্রো পাসকেল ছিলেন অতুলনীয়।

উপসংহারঃ পরিশেষে, ‘ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪’ সম্পূর্ণ বিনোদনধর্মী একটি সিনেমা যা আপনার অর্থের মূল্য দিতে সক্ষম। সিনেমার ক্লাইমেক্স দৃশ্য দর্শকদের হল থেকে বের হওয়ার সময়ও পুলোকিত করবে। ক্লাইমেক্স দৃশ্যে গাল গ্যারোটের ভাষণ থেকে আমরা ওই মুহূর্তে যা বুঝতে পারি, তার চেয়েও বেশি অর্থবহ ছিলো। খারাপকে জয় করতে আমাদের ভালোত্ব দরকার আর ‘ওয়ান্ডার ওমেন ১৯৮৪’ সিনেমার ক্লাইমেক্স আমাদের সেই শিক্ষ্যাই দেয়।

By হোসেন মৌলুদ তেজো

এ সম্পর্কিত