লিখাটা শুরু করতে চাই বলিউড অভিনেতা অনুপম খেরের সঞ্চালনায় একটি টিভি অনুষ্ঠানের শাহরুখ খানের একটি মন্তব্য দিয়ে। সেই অনুষ্ঠানে অনুপম খের শাহরুখ খানকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মনে করুন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি দেখলেন আপনার এই সাফল্য, এই প্রতিপত্তি, এই জনপ্রিয়তা আরেকজনের দখলে চলে গেছে, তাহলে আপনি কির করবেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে শাহরুখ খান বলেছিলেন, ‘এরকম কখনো হবে না, আমি স্টারদের শেষ স্টার।’ যতার্থ বলেছিলেন বাদশা – হারিয়ে যাচ্ছে স্টারডাম সংস্কৃতি যেখানে শাহরুখ খানই বলিউডের শেষ সুপারস্টার!
সম্প্রতি বলিউড ক্যারিয়ারের ৩০ বছর পূর্ণ হল শাহরুখ খানের। ১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এই তারকা। পরের বছর ‘বাজিগর’ এবং ‘ডর’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি বক্স অফিস সাফল্যের স্বাদ পান। কয়েক বছরের মধ্যে, তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পের অবিসংবাদিত অভিনেতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। পরের দেড় দশক ধরে, শাহরুখ খান প্রায় প্রতি বছর একাধিক ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দেয়ার মাধ্যমে বক্স অফিস সাফল্যের জন্য ধারাবাহিকভাবে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছেন।
তবে গত দশকে শাহরুখ খানের সিনেমাগুলোর বক্স অফিস ফলাফল সুখকর ছিলো না। এই সময়ে শাহরুখের মুক্তিপ্রাপ্ত বেশীরভাগ সিনেমাই বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বলিউড ইন্ডাস্ট্রি শাহরুখ খানের সুপার স্টারডামের শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরও বলিউডের তারকাখ্যাতির শীর্ষে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন বলিউড বাদশা। এমনটি ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জিরো’ সিনেমার পর প্রায় তিন বছর নতুন কোন সিনেমার ঘোষণা না থাকলেও দর্শক এবং মিডিয়ার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শাহরুখ খান।
১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত ‘বলিউডের রাজা’ হিসেবে শাহরুখের শীর্ষস্থান স্থায়ী ছিল। রাজেশ খান্নার পর সুপারস্টার খেতাব অমিতাভ বচ্চনের রাজত্বের কয়েক বছর পরে শাহরুখ খানের সুপারস্টারডম শুরু হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে দিলীপ কুমার থেকে শাহরুখ খান পর্যন্ত বলিউডের এক নম্বর নায়কদের প্রায় অবিচ্ছিন্ন শৃঙ্খল খুঁজে পাওয়া যায়। তারপর থেকে গত দশ বছর সবচেয়ে দীর্ঘ সময়, যখন হিন্দি সিনেমায় কোনও স্পষ্ট ‘সুপারস্টার’ নেই।
অক্ষয় কুমার, রনভির সিং থেকে সালমান খান এবং আমির খান, সকলেই বিভিন্ন মাত্রায় সাফল্যের স্বাদ পেয়েছেন। কিন্তু ভিন্ন কারণে তাদের কেউই সেই সুপারস্টারডাম উপভোগ করতে পারেননি। আমির খান যথেষ্ট ফলপ্রসূ ছিলেন না, অন্যদিকে অক্ষয় এবং সালমানেরও তাদের ন্যায্য অংশীদারিত্ব ছিল। রনভির সিং এখন পর্যন্ত সিনেমার সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারেননি যা একজন ‘সুপারস্টার’ হওয়ার অন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর কখনও সুপারস্টার তৈরি হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
গত দশ বছরের শাহরুখ খানের ব্যর্থতার পরও বলিউডের কোন তারকা তার মত স্টারডাম উপভোগ করতে পারননি। এই সময়ে এককভাবে বলিউডকে রাজত্ব করার মত কোন তারকা আমরা দেখতে পাইনা। এই স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে, দর্শকরা ‘তারকাদের’ একটি মিউজিক্যাল চেয়ার দেখতে থাকবে। কিন্তু তাদের কেউই সত্যিকারের ‘সুপারস্টারডম’ অর্জন করতে পারবে না। একেক সময়ে একেক তারকা হয়তো সেই মিউজিক্যাল চেয়ার দখল করবে কিন্তু সেটা কোনভাবেই শাহরুখ খানের স্টারডামের সাথে তুলনাযোগ্য হবে না।
সামাজিক মাধ্যমে ‘স্টার সম্পৃক্তি’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তার তারকাদের ভক্তদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তারা মন্তব্যে সাড়া দেয়, লাইভ চ্যাটে অনুরাগীদের সাথে আলাপচারিতা করে এবং মাঝে মাঝে ইনস্টাগ্রাম স্টোরিজের পুনঃপোস্ট করে যা দর্শকদের আগের চেয়ে তারকাদের সাথে আরও বেশি সংযুক্ত বোধ করে। যাইহোক, এটি তারকাদের পেশাদার ব্যক্তিত্বও তৈরি করেছে যা তারা তাদের সেরা মার্কেটিং উপায় হিসাবে উপস্থাপন করছে। এর মাধ্যমে তারকারা খুব সহজেই ভক্ত অনুরাগীদের সাথে নিজেদের সংযোগ স্থাপন করতে পারছেন।
এখানেই অন্যদের সাথে শাহরুখ খানের পার্থক্য কারন মার্কেটিংয়ের কারণে সুপারস্টার হয়ে ওঠেননি শাহরুখ খান। তার বক্স অফিস সাফল্যের বাইরে, যা তাকে জনসাধারণের প্রিয় করে তুলেছিল তা হল তাকে সত্যিকারের বলে মনে হয়েছিল। শাহরুখ খান নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে সবার কাছে তাকে খুবই পরিচিত কেউ মনে হত, যিনি এখন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় অভিনেতা ছিলেন। এছাড়া শাহরুখ খান সবসময়ই নম্র, সৎ এবং হাসিখুশি একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি তখনও পারিবারিক মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হন এবং এর পেছনে কোনো প্রচার প্রচারণা ছিল না।
তারপরে সামাজিক মাধ্যম নিয়ে আসে ক্লান্তি এবং স্যাচুরেশন। আজকের তারকাদের সাথে সর্বদা সক্রিয় এবং তারা সবসময়ই জনসাধারণের চোখে থাকে। ভক্তরা তাদের প্রিয় চকোলেট থেকে শুরু করে গতকাল থেকে তাদের ঘরে বিছানার চাদরের রঙ পর্যন্ত সবকিছু সম্পর্কে জানেন। আর এর জন্য তাদের ফিল্মফেয়ার বা স্টারডাস্টের পরবর্তী সংস্করণের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। তারকাদের জীবনে এখন আর অজানা কোন রহস্য অবশিষ্ট নেই। আগে যাদের মানুষ আকাশের তারার মত অধরা মনে হত তারা এখন খুবই সহজগম্য।
সুপারস্টারের অস্তিত্ব এখন শুধু দক্ষিণের সিনেমাতেই
এই সোশ্যাল মিডিয়া স্যাচুরেশন থেকে একটি জায়গা যেটি এড়িয়ে গেছে তা হল দক্ষিণ ভারত। দক্ষিণের চারটি প্রধান সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি – তামিল, তেলেগু, কন্নড় এবং মালায়ালম, এখনও সুপারস্টারদের ঐতিয্য ধরে রেখেচেহ৷ রজনীকান্ত, কমল হাসান, মোহনলাল এবং মামুত্তি এখনও রাজত্ব করছেন। তারপরে প্রভাস, রাম চরণ, আল্লু অর্জুন এবং যশের মতো নতুন সুপারস্টারদের উত্থান দেখেছে এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো। তাদের সুপারস্টারডম ফ্যান ক্রেজ থেকে উদ্ভূত, যা আজকাল বলিউডে অনুপস্থিত। ‘আরআরআর’ সিনেমার প্রি-রিলিজ ইভেন্টের জন্য রামোজি ফিল্ম সিটিতে যে এক লক্ষ লোক নেমেছিল তা সেই উন্মাদনার প্রমাণ। খানরা ছাড়া বলিউডের আর কোন তারকাকি আজ বলিউডে সেই ধরনের ফ্যান ক্রেজ করতে পারেন?
বলিউডের স্টুডিওগুলো অভিনেতাদের থেকে ‘তারকাদের’ ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে যা তারা তাদের সিনেমার বাজারজাতকরনে ব্যবহার করে। এগুলো করে পণ্য এবং ব্র্যান্ড হয়ত বিক্রি করা যেতে পারে, প্রকৃত মানুষ নয়। আর এ কারণেই, প্রতিভা এবং এমনকি সাফল্য সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে অনেকেই সুপারস্টারডমের সেই কাঁচের সিলিং ভাঙতে ব্যর্থ হন। এর একটি কারণ হল যে আজকের বলিউড তারকারা মনে করেন যে তারা একটি সমাবেশ লাইন থেকে এসেছেন, বিশেষভাবে প্রতিস্থাপনযোগ্য এবং সাধারণ মানুষ থেকে তাদের আলাদা করা যায় না।
২০২৩ সালে শাহরুখ খানের তিনটি সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। যশ রাজ ফিল্মসের ‘পাঠান’ সিনেমা দিয়ে বছর শুরু করবেন, এরপর আসবে ম্যাস অ্যাকশন বিনোদনকারী ‘জওয়ান’ এবং বছর শেষ করবেন ‘ডানকি’ দিয়ে, রাজকুমার হিরানির সাথে তার প্রথম সিনেমা। মুক্তি প্রতীক্ষিত এই তিনটি সিনেমা আগামী বছরের আলোচিত সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সিনেমাগুলোর মধ্যমে শাহরুখ খান আবারো বক্স অফিসে নিজের রাজত্ব কায়েক করবেন বলে মনে করছেন সবাই। ঘোষণার পরই সিনেমাগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলতে দেখা গেছে।
এই তিনটি সিনেমার মাধ্যমে চার বছর পর বড় পর্দায় ফিরছেন বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। তার ক্যারিয়ার এখনও অব্যাহত থাকবে। তিনি হয়তো আর কখনো বলিউডে রাজত্ব করতে পারবেন না কিন্তু তার রাজত্বের মাধ্যমে বলিউডের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। এখন এটি কয়েকটি স্টুডিও এবং তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত একটি দুনিয়া। বলিউড, এখন রাজাহীন একটি রাজ্য এবং হয়তো আর কোনদিন অন্য কোন রাজাও আসবে না। সঙ্গত কারনেই হারিয়ে যাওয়া স্টারডাম সংস্কৃতির সময়ে শাহরুখ খানই বলিউডের শেষ সুপারস্টার!
আরো পড়ুনঃ
টম ক্রুজ এবং কমল হাসানের পর ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় শাহরুখ খান
শুরু থেকে শেষঃ ২০২৩ সালটা বলিউড বাদশা শাহরুখ খানের!
যে দশটি সিনেমা শাহরুখ খানকে বলিউড বাদশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে