সিনেমার পর্দায় খলনায়কের চরিত্রায়ন এবং একজন শহিদুল ইসলাম খোকন!

সিনেমার পর্দায় খলনায়কের

সিনেমার পর্দায় একটি গল্পকে ফুটিয়ে তোলার জন্য নায়ক-নায়িকা যতটা গুরুত্বপূর্ন একজন খলনায়কও সমান গুরুত্বপূর্ন। গল্পের ভালো এবং খারাপের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত নায়কের হাতে পরাজিত হতে দেখা যায় খালনায়ককে। কিন্তু সেই লড়াইকে উপভোগ্য করতে দুই পক্ষ্যকেই শক্তিশালী ভাবে উপস্থাপন করতে হয় নির্মাতাকে। ঢাকাই সিনেমায় বিগত কয়েক বছর ধরে শাকিব খানের মত মিশা সওদাগর খলনায়ক চরিত্রে আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। কিন্তু মিশা সওদাগর একজন খলনায়কের সেই জায়গাটুকু কতটুকু পুরন করতে পারছেন। প্রতিটি সিনেমায়ই তাকে দেখা যায় একই ধরনের অঙ্গভঙ্গি এবং সংলাপের সাথে অভিনয় করছেন। কিন্তু বাংলা সিনেমার অতীতটা মোটেও এরকম ছিলো না। সিনেমার পর্দায় খলনায়কের চরিত্রায়ন নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত তুলে ধরতে চাই আজকে।

বাংলা সিনেমার পর্দায় খলনায়কের চরিত্রায়ন নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে যে নির্মাতার নাম আমার মাথায় আসে তিনি হচ্ছেন শহিদুল ইসলাম খোকন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সফল এই নির্মাতা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও খলনায়কের চরিত্রায়নে তার ভিন্নতা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। আলোচিত এই নির্মাতার এই বিশেষ গুনটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এই লিখায়।

আমার আজকের এই আলোচনার শুরুটা করতে চাই প্রয়াত খল অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদির একটি উক্তি দিয়ে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাথে আলাপকালে শহিদুল ইসলাম খোকন সম্পর্কে ফরিদি বলেছিলেন, ‘নির্মাতা হিসেবে আমার প্রথম পছন্দ শহিদুল ইসলাম খোকন। বাংলাদেশে শহিদুল ইসলাম খোকনই সম্ভবত একমাত্র পরিচালক যিনি সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য লিখার সময় খলনায়কদের নিয়ে ভাবেন।‘ হুমায়ূন ফরিদির এই মন্তব্য শতভাগ সত্য। শহিদুল ইসলাম খোকনের সিনেমার এবং সেখানে খলনায়কের চরিত্রগুলো পর্যালচনা করলে এই সত্যটি আরো সুস্পষ্ট হবে।

শহিদুল ইসলাম সিনেমায় দুইজন খল অভিনেতাকে নিয়মিতভাবে দেখা যেত। এই দুই অভিনেতা হলেন হুমায়ূন ফরিদি এবং ইলিয়াস কোবরা। এই নির্মাতার শুরু দিকে কিছু সিনেমায় ড্যানি সিডাককে দেখা গেলেও নায়কের অভিনয় শুরুর পর ড্যানিকে আর তার সিনেমায় দেখা যায়নি। এছাড়া তার সিনেমায় আরো যেসব খল অভিনেতাদের দেখা গেছে তাদের মধ্যে রাজীব, এটিএম শামসুজ্জামান, খলিল এবং মিজু আহমেদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার বেশ কিছু সিনেমায় একসাথে একাধিক খল অভিনেতাকে দেখা গেছে।

শহিদুল ইসলাম খোকন তার সিনেমায় খলনায়কের চরিত্রায়নের বিপ্লব শুরু করেছিলেন ‘সন্ত্রাস’ সিনেমায় হুমায়ূন ফরিদিকে দিয়ে। ছোট পর্দার অভিনেতা (যাকে সবাই সেসময় কান কাটা রমজান হিসেবে চিনত) হুমায়ূন ফরিদিকে খলনায়ক করে নির্মান করেন এই সিনেমাটি। দুর্দান্ত গল্প এবং চিত্রনাট্যের সাথে সিনেমাটিতে হুমায়ূন ফরিদির অভিনয় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। পর্দায় দর্শকরা এমন একজন খলনায়ককে আবিষ্কার করলো যা এর আগে কেউ দেখেনি। ‘সন্ত্রাস’ সিনেমাটি মুক্তির পর হুমায়ূন ফরিদিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অন্যদিকে শহিদুল ইসলাম খোকনও পেয়ে গেলেন তার সিনেমার জমজমাট লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার।

এরপর শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘লম্পট’, ‘বিশ্ব প্রেমিক’, ‘ভণ্ড’, ‘চারিদিক শত্রু’, ‘সতর্ক শয়তান’, ‘শত্রু ভয়ঙ্কর’, ‘যোদ্ধা’ এরমত সিনেমায় হুমায়ূন ফরিদিকে দেখা গেছে ভিন্নতার উদাহরণ হিসেবে। এই প্রতিটি সিনেমায় রুবেলের পাশাপাশি সিনেমার প্রানভোমরা ছিলো হুমায়ূন ফরিদির অভিনয় এবং চরিত্রে ভিন্নতা। তার সমসাময়িক নির্মাতারা যখন গতানুগতিকভাবে খলনায়কের চরিত্র নিয়ে হাজির হচ্ছিলেন, সেখানে শহিদুল ইসলাম খোকন সেই ধারাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং জিতেছেন। তার পরিচালিত প্রতিটি সিনেমার খলনায়কের চরিত্র নিয়ে বিস্তর আলোচনা সম্ভব।

যেমন ‘লম্পট’ সিনেমায় আমরা দেখতে পাই একজন চরিত্রহীন এবং ভণ্ড বাবাকে। মানুষকে ধোঁকা দেয়াই তার একমাত্র পেশা। এর পিছনে আমার কোন সম্পত্তির লোভ দেখতে পাই না। এছাড়া সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সঙ্গম দেখতে পছন্দ করে। অন্যদিকে ‘বিশ্ব প্রেমিক’ সিনেমায় আমরা প্রধান খলনায়ককে দেখতে পাই একজন উম্মাদ প্রেমিকের চরিত্রে। ‘শতর্ক শয়তান’ সিনেমার নাম ভূমিকাটাই ছিলো খল নায়ক কেন্দ্রিক। হুমায়ূন ফরিদির বড় ভাই সম্পত্তির লোভে তাকে হিরোইনের নেশায় মাতাল করে রাখে। কিন্তু আসলে দেখা যায় হুমায়ূন ফরিদি তার বড় ভাইয়ের দেয়া নেশাদ্রব্য সেবন না করে জমিয়ে রাখে। বড় ভাইয়ের এই উদ্দ্যেশ্য বুঝতে পেরে নিজের কৌশল সাজানো সতর্ক শয়তানই সিনেমাটির খলনায়ক।

‘ভণ্ড’ সিনেমায় শহিদুল ইসলাম খোকন রাজীব, হুমায়ূন ফরিদি, এটিএম শামসুজ্জামান, নাসির খান এবং ইলিয়াস কোবরাকে একসাথে পর্দায় নিয়ে আসেন। সিনেমাটিতে রুবেলের ড্যান্সিং কুংফু দর্শকদের যতটা চমকে দিয়েছিলো তার বেশী চমক ছিলো হুমায়ূন ফরিদি এবং এটিএম শামসুজ্জামানের চরিত্রায়নে। পর্দায় ভয়ঙ্কর দুই অভিনেতা এবার হাজির হলেন কমেডি চরিত্রে। তারা নায়ককে সাহায্যের পাশাপাশি নাচগান করেন। এই দুই অভিনেতা যতবারই পর্দায় হাজির হয়েছেন দর্শক পেয়েছেন ভিন্ন আমেজ। গুণ্ডাদের আঘাতে রুবেল যখন হাসপাতালে ভর্তি তখন এই দুই জনের অভিনয় আপনাকে ভাবাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

হুমায়ূন ফরিদি এবং এটিএম শামসুজ্জামানকে নিয়ে কমেডি নির্ভর আরো একটি সিনেমা আছে শহিদুল ইসলাম খোকনের। ‘পাগলা ঘণ্টা’ নামের এই সিনেমায় ছিলো না ঢালিউডের গতানুগতিক মারামারি। এই দুই অভিনেতার অভিনয়ই ছিলো সিনেমার মূল আকর্ষন। ‘তোতলা খোন্দকার’ এবং ‘বয়ড়া সৈয়দের’ লড়াই সিনেমাটিকে করেছে উপভোগ্য। সিনেমাটির শেষ দৃশ্যে হুমায়ূন ফরিদি যখন তার অচল বন্ধু এটিএম সামসুজ্জামানকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে বলে সে দৃশ্য ভালো লাগবে না এমন দর্শক খোঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘পাগলা ঘণ্টা’ সিনেমার এই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি আমার দেখা বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা দৃশ্য হয়ে থাকবে।

খলনায়কের চরিত্রায়নে আরো একটি সিনেমায় শহিদুল ইসলাম খোকন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন। ‘যোদ্ধা’ নামের এই সিনেমাটিতেও দেখা গেছে একঝাক অভিনেতার মিলনমেলা। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন রাজীব, হুমায়ূন ফরিদি, মিজু আহমেদ, এটিএম শাসুজ্জামান এবং খলিল। সিনেমাটির প্রধান খলনায়ক রাজীব একজন চরিত্রহীন কালোবাজারি যেকিনা সমাজের ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আর হুমায়ূন ফরিদি হচ্ছে তার ভাড়াটে খুনি। কিন্তু সিনেমাটিতে রাজীব এবং হুমায়ূন ফরিদির আরো একটি সম্পর্ক আছে যা দুইজনের কেউই জানত না। আসলে হুমায়ূন ফরিদি ছিলো এই সিনেমায় রাজীবের ছেলে। এই দুই অভিনেতা যতবারই পর্দায় এসেছেন দর্শক পেয়েছে অনন্য অভিনয়ের কিছু অভিজ্ঞতা।

লিখাটি শেষ করছি শহিদুল ইসলাম খোকনের আরো একটি সিনেমার কথা বলে। সেসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় খল অভিনেতা ডিপজলকে নিয়ে শহিদুল ইসলাম খোকন একটিই সিনেমা নির্মান করেছিলেন। ‘চাই ক্ষমতা’ নামের এই সিনেমাটিতে ডিপজল একজন জনপ্রতিনিধির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর আগে ডিপজলকে নির্মাতারা একজন ভয়ঙ্কর জংলী রুপে হাজির করতেন। যে তার চেহারা, কাজে থাকতো হিংস্র। শুধু তাই নয় তার সংলাপ ছিলো অশ্রীল শব্দ এবং গালাগালিতে ভরপুর। কিন্তু ‘চাই ক্ষমতা’ সিনেমায় সবসময় শ্রোতের বিপরীতে হাঁটা নির্মাতা শহিদুল ইসলাম খোকন ডিপজলকে উপস্থাপন করেছেন পুরোপুরি ভিন্ন রুপে। এই সিনেমায় তার গেটাপ থেকে শুরু করে সংলাপ সবকিছুতে ছিলো শুদ্ধতা। কাজে বা কর্মে নয় সিনেমাটিতে তার হিংস্রতা উঠে এসেছিলো চিন্তায়। ডিপজলকে এভাবে পর্দায় উপস্থাপন করার চিন্তা এবং সাহস মনে হয় একমাত্র খোকনই দেখাতে পেরেছিলেন।

বাংলা সিনেমায় শহিদুল ইসলাম খোকন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তার প্রতিটি সিনেমাই ছিলো ভিন্নতার উদাহরণ। তার গল্পে এবং চিত্রনাট্যে কেন্দ্রিয় চরিত্রের নায়ক নায়িকা যেমন গুরুত্ব পেত তেমনি গুরুত্ব পেত খলনায়কের চরিত্রায়ন। ঢালিউডের আজকের এই দুর্দশার পিছনে যে কয়েকটি সঙ্কটের কথা বলা হয় তার মধ্যে শহিদুল ইসলাম খোকনের মত নির্মাতার অভাব অন্যতম। তার সিনেমায় খলনায়করাও হয়ে উঠতেন তারকা। তাইতো সিনেমার প্রচারে খোকন প্রায়ই অভিনয় শক্তির লড়াইয়ের কথা বলেতেন।

আরো পড়ুনঃ
নারীদের জীবন এবং লড়াই নিয়ে কথা বলে ঢালিউডের যে ১৫ সিনেমা
ঢালিউডের সিনেমার পর্দায় পুলিশ এবং পুলিশের ভাবমুর্তি নিয়ে কিছু কথা
তারকা তৈরিতে একজন পরিচালকের অবদানঃ প্রেক্ষিত ঢালিউড

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত

%d bloggers like this: