গত ঈদে মুক্তি পেয়েছিলো সালমান খানের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘রাধেঃ ইউর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই’। করোনা মহামারির কারনে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পাশাপাশি ওটিটি প্লাটফর্মে সিনেমাটি মুক্তির ঘোষনা দিয়েছিলেন সালমান খান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাত্র তিনটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি সে হিসেবে সরাসরি ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পেয়েছিলো সিনেমাটি। জি৫ প্লাটফর্মে মুক্তির পর দর্শকদের চাপে প্লাটফর্মটির সার্ভার ক্রাশের খবরও পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের মাঝে দেখা গেছে চরম হতাশা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিনেমাটি নিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা। দর্শকদের পাশাপাশি সমালোচনদেরও অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়েছে সিনেমাটি নিয়ে।
এদিকে ওটিটি প্লাটফর্মে সর্বোচ্চ ভিউয়ের রেকর্ড গড়লেও বক্স অফিস ইন্ডিয়া বলছে সিনেমাটি ব্যবাসায়িকভাবে পুরোপুরি ব্যার্থ। আর সিনেমাটি নিয়ে সমালোচনা করেছেন সালমান খানের বাবা সেলিম খান নিজেই। ‘রাধে’ সিনেমাটির ব্যার্থতা সাম্প্রতিক সময়ে সালমান খানের সিনেমার ব্যার্থতার তালিকাটা আরেকটু লম্বা করেছে বলা যায়। মাঝে ‘টাইগার জিন্দা হ্যাঁ’ সিনেমাটিকে বাদ দিলে সালমান খানের মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ ছয়টি সিনেমার পাঁচটি সিনেমাই ছিলো ব্যার্থ। ‘রাধে’ সিনেমার আগে সালমান খান অভিনীত ‘দাবাং ৩’ এবং ‘রেস ৩’ সিনেমা দুটিও বক্স অফিসে ব্যার্থ হয়েছে। অন্যদিকে ‘ভারত’ সিনেমাটির ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারনে সিনেমাটিও বক্স অফিসে প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।
তবে সালমান খানের সিনেমার ব্যার্থতার ক্ষেত্রে একটি কথা প্রযোজ্য যে, সালমান খানের ফ্লপ সিনেমার বক্স অফিস আয়ও অন্য তারকার ব্লকবাস্টার সিনেমার আয়ের চেয়ে বেশী ছিলো। বক্স অফিস আয় হিসাব করলে সালমান খানের ফ্যানবেজ এবং স্টারডাম নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর এই বিশাল ফ্যানবেজের কারনে মুক্তির পর প্রাথমিকভাবে বক্স অফিসে ভালো আয় করছে কিন্তু পরবর্তিতে মুখ থুবড়ে পরছে তার সিনেমাগুলো। সালমান খানের সাম্প্রতিক সময়ের সিনেমাগুলোর কথা বিবেচনায় এই লিখাটি দুই ভাগে বিভক্ত করা হচ্ছে। লিখাটির প্রথম পর্বে থাকছে সিনেমার কনটেন্ট এবং সালমান খানের ফ্যানবেজের প্রেক্ষিতে বিস্তারিত আলোচনা।
প্রথমে আসি বলিউডের ভাইজানের মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ সিনেমা ‘রাধে’ প্রসঙ্গে। দুই বছর আগে যখন ‘রাধে’ সিনেমাটি নিয়ে সালমান খানের কোন প্রস্তুতি ছিলো না তখন সালমান খানকে নিয়ে সঞ্জয়লীলা বানসালি ‘ইনশাল্লাহ’ নামে একটি সিনেমা নির্মানের কথা হচ্ছিল। কিন্তু শুটিং শুরুর কিছুদিন আগের সঞ্জয়লীলা বানসালির সাথে মতপার্থক্যের কারনে সিনেমাটি থেকে সরে দাঁড়ান এই তারকা। সেই সময়ে ২০২০ সালের ঈদে (যখন ‘ইনশাল্লাহ’ মুক্তির কথা ছিলো) মুক্তির জন্য সালমান ‘রাধে’ সিনেমার ঘোষনা দেন। অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই সিনেমাটির প্রস্তুতি শুরু করেন সালমান খান আর সিনেমাটি পরিচালনার দায়িত্ব পান প্রভু দেবা। তখন সালমান খান প্রভু দেবা পরিচালিত ‘দাবাং ৩’ সিনেমার কাজ করছিলেন।
কোরিয়ান সুপারহিট সিনেমা ‘দ্যা আউটলো’ এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমাটির চিত্রনাট্যে রয়েছে অসম্পূর্নতার ছাপ। বলিউডের সিনেমা বিশেষজ্ঞদের মতে অল্প সময়ে প্রস্তুতির কারনেই দূর্বল চিত্রনাট্য একটি সম্ভাবনাময়ী সিনেমার ভরাডুবি করেছে। এছাড়া ঈদের মত একটা সময়কে টার্গেট করে সিনেমা নির্মান করতে হলে অবশ্যই সিনেমার বিষয়বস্তু এবং চিত্রনাট্যের ব্যাপারে আরো মনযোগী হতে হবে। সালমান খানের সিনেমার ক্ষেত্রে কনটেন্ট বনাম স্টারডামের বিষয়টি উঠে আসে অবধারিতভাবে। সাম্প্রতিক ব্যর্থতা এখন পর্যন্ত সালমান খানের জনপ্রিয়তায় কোন আঘাত করতে পারেনি তার প্রমান একদিনে ৪২ লক্ষ্য মানুষের ‘রাধে’ সিনেমাটি দেখা। কিন্তু স্বভাবত, সিনেমাটির কনটেন্ট ভালো না হওয়ার কারনে পরবর্তি সময়ে আশানুরূপ দর্শক টানতে পারেনি তার সর্বশেষ সিনেমা ‘রাধে’।
এর আগে তার মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাবাং ৩’ এবং ‘রেস ৩’ সিনেমাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিলে সালমান খানের সিনেমা নির্বাচনে অসেচতনতার ধারনাটা আরো পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা যায়। এছাড়া আরো একটি বিষয় এখানে আলোচনার দাবী রাখে। ‘ভারত’ সিনেমার প্রচারণার সময় বলিউডের ট্রেড বিশেষজ্ঞ তারান আদর্শের সাথে আলাপকালে সালমান খান বলেছিলেন তার সিনেমার চিত্রনাট্য, পরিচালনা, গান সবকিছুতে নিজের মতামত দিয়ে থাকেন তিনি। কারন হিসেবে বলেছিলেন যদি কোন কারনে সিনেমাটি ব্যার্থ হয় তাহলে তার দায়ভার যেন তিনি নিতে পারেন। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, একটি সিনেমা নির্মানাধীন থাকা অবস্থায় সেটার ব্যর্থতার সমীকরণ সালমান খান কেন বিবেচনা করছেন? আর যদি তাই হয় তাহলে এটা খুব সহজেই অনুমেয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে তার মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো নির্মাতার তাদের মত করে করতে পারেননি।
এদিকে গুঞ্জন আছে, ‘ইনশাল্লাহ’ সিনেমাটি নিয়েও পরিচালক সঞ্জয়লীলা বানসালির সাথে ক্রিয়েটিভ ব্যবধান ছিলো সালমান খানের। নিজের অবস্থান থেকে সরে না এসে বরং সিনেমাটি বাতিল করে দেন আলোচিত এই নির্মাতা। সঙ্গত কারনেই, রেমো ডি’সুজা বা প্রভু দেবার মত পরিচালকরা সালমান খানের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হননি। আর তার পরিণাম সিনেমাগুলোর বক্স অফিস হিসাব। নিঃসন্দেহে সালমান খানের জন্য এটি একটি ভুল পদক্ষেপ আর ভবিষ্যৎ বিবেচনায় এই ভুল শুধরে নেয়াই হবে সালমান খানের প্রথম কাজ। ভালো বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত হলে সালমান খানের সিনেমা বক্স অফিসে ঝড় তুলবে সেটার প্রমান ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ এবং ‘সুলতান’। কনটেন্ট এবং সালমান খানের স্টারডামের সমন্বয় মানেই বক্স অফিস আয়ের নতুন রেকর্ড – অন্তত ইতিহাস সেটাই বলে।
অন্যদিকে আরো একটি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো থেকে তারকাদের আয়। বক্স অফিসে ব্যবসা যেমনই হোন বর্তমান সময়ের তারকারা তাদের সিনেমা থেকে নিজেরদের আয় নিশ্চিত করতে পারছেন। কিন্তু বক্স অফিসে ধারাবাহিক ব্যার্থতা বা সিনেমা থেকে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া তারকা হিসেবে যেকারো অবস্থানকে অনিশ্চিত করে দিতে পারে। বাজে বিষয়বস্তু হওয়ার কারনে দর্শকপ্রিয়তা না পাওয়ার ঘটনা ধারাবাহিক হলে যেকোন তারকার স্টারডাম প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আর তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ শাহরুখ খান। ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারনে ২০১৮ সালে ‘জিরো’ মুক্তির পর বড় পর্দায় অনুপস্থিত বলিউড বাদশা। নতুন সিনেমা নির্বাচনে সাবধানী পদক্ষেপ নিচ্ছেন শাহরুখ খান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শাহরুখ খানের পথেই হাঁটছেন সালমান খান। দর্শকদের ভারসা ধরে রাখাতে না পারলে একসময় নিজস্ব ফ্যানবেজও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে তারকাদের সিনেমা থেকে।
উপসংহারে বলা যায় যে, সালমান খানের স্টারডাম এখনো আগের মতই আছে। সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোর ব্যর্থতার মুল কারন বিষয়বস্তু নির্বাচনে ভুল পদক্ষেপ। সেই ক্ষেত্রে বক্স অফিসে সালমান খানের স্বমহিমায় ফিরতে হলে সিনেমায় হিরোইজমের বদলে গুরুত্ব দিতে হবে বিষয়বস্তুর প্রতি। কনটেন্ট আর স্টারডামের এই সমীকরণের আলোচনা এখানে শেষ করছি। সামনের দিনগুলোতে সালমান খানের করনীয় কি এবং কিভাবে সিনেমা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন জানিয়ে দিন আমাদের ঝটপট।
আরো পড়ুনঃ
সালমান খানের এক দশক: সুপারষ্টার থেকে বক্স অফিসের দাবাং
শাহরুখ খানের এক দশক: ‘সুপার হিরো’ থেকে ‘জিরো’