জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর (সবার কাছে থালাপাতি বিজয় নামেই বেশী পরিচিত) তামিল সিনেমার অভিনেতা হলেও ভারতসহ বিশ্বব্যাপী অসংখ্য ভক্ত আছে এই সুপারস্টারের। কিন্তু শিশু শিল্পী থেকে থালাপাতি বিজয়ের এই অর্জন একদিনে আসেনি। ১৯৯২ সালে নিজের পরিচালক বাবা পরিচালিত ‘নালাইয়া থেরপু’ সিনেমার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা বিজয়ের এক দশকের বেশী সময় লেগেছে তারকাখ্যাতি অর্জন করতে। দীর্ঘ সিনেমার যাত্রা শেষে রজনীকান্তের পর তামিলের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার বিজয় ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত। সিনেমার দর্শকরা তাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘থালাপাতি’ যার অর্থ হচ্ছে কমান্ডার বা নেতৃত্বদানকারী। তার সমসাময়িক সুরিয়া, অজিত এবং বিক্রমকে পিছনে ফেলে রজনীকান্ত পরবর্তি তামিল সিনেমার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন থালাপাতি বিজয়।
১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাবা এস এ চন্দ্রশেখর পরিচালিত সিনেমায় একজন শিশু শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন এই তারকা। ১৯৯২ সালের অভিষিক্ত সিনেমার পর বিজয় একে একে সেন্তুরাপান্দি (১৯৯৩), রাশিজ্ঞান (১৯৯৪), বিষ্ণু (১৯৯৫) সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন। কিন্তু এই সিনেমাগুলোর কোনটিই বিজয়কে তেমন কোন পরিচিত দিতে পারেনি, থেকে গেছেন এস এ চন্দ্রশেখরের ছেলে হিসেবেই। এরপর বিজয় নিজের সীমানা ভেঙে দেবা (১৯৯৫), চন্দ্রলেখা (১৯৯৫) এবং কোইম্বতরে মাপ্পিল্লাই (১৯৯৬) সিনেমাগুলোর মাধ্যমে নিজস্ব একটা ভক্তশ্রেণী তৈরি করতে সক্ষম হন। তবে বিজয়ের প্রথম বড় হিট সিনেমা ছিলো ১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিক্রমের ‘পুভে উনাক্কাগা’। প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি টানা ২০০ দিন প্রদর্শিত হয়েছিলো। সিনেমাতে বিজয় একজন তরুনের চরিত্রে অভিনয় করেন যে হিন্দু এবং ক্রিস্টিয়ান পরিবারকে এক করার চেষ্টা করে। পরবর্তিতে সিনেমাটি ভারতে আরো কয়েকটি ভাষায় পুনঃনির্মিত হয়েছিলো।
পরবর্তিতে বিজয় একইসাথে রোম্যান্টিক এবং একশন সিনেমায় চেষ্টা করেন। ১৯৯৭ সালের ‘লাভ টুডে’ থেকে ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কান্নুক্কুল নিলাভু’ সিনেমাগুলোতে দুই ইমেজেই দেখা গেছে বিজয়কে। তবে অভিনেতা হিসেবে বিজয়কে স্বকৃতি দিয়েছিলো ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাদালুক্কু মারিয়াধি’ সিনেমাটি। ফাজিল পরিচালিত এই সিনেমার মাধ্যমে বিজয় প্রথমবারের মত তামিল নাড়ু রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার অর্জন করেন। টলিউডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা রোম্যান্টিক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরমধ্যে বিজয় নিজের অভিনয় নিয়েও বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয় প্রিয়ামুদান (১৯৯৮) এবং প্রিয়ামানাভেলে (২০০০) সিনেমা দুটিতে এন্টি-হিরোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন থালাপাতি বিজয়।
এরপর বিজয় তারকাবহুল সিনেমায় তার উপস্থিতি কমিয়ে দেন। সুরিয়ার সাথে ফ্রেন্ডস (২০০১) সিনেমাটি টানা ১৭৫ দিন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছিলো। এরপর বিজয়কে আর সুরিয়ার সাথে কোন সিনেমায় দেখা যায়নি। একই সময়ে সিমিরনের বিপরীতে থুল্লারা মানামুম থুল্লাম (১৯৯৯) এবং জয়তিকার বিপরীতে খুশি (২০০০) সিনেমাগুলো বিজয়কে একজন রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। দুটি সিনেমাই ভক্তদের মনে আলাদা জায়গা দখল করে আছে। এছাড়া বক্স অফিসেও সফল ছিলো সিনেমাগুলো।
তবে ধীরে ধীরে হলেও বিজয় তার সিনেমার ধারা পরিবর্তন করতে শুরু করেন। আর এবার তিনি শুরু করেন একশন সিনেমায় অভিনয়। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভাগবাতি, থামিজান এবং ইয়থ সিনেমাগুলো ম্যাস দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এই সিনেমাগুলোর সফলতার পর বিজয় তার নতুন একশন হিরোর ইমেজকে আরো পাকাপুক্ত করার চেষ্টা করেন। থিরুমালাই (২০০৩), ঘিল্লি (২০০৪), মাধুরী (২০০৪), থিরুপাছি (২০০৫) এবং সিভাকশি (২০০৫) সিনেমাগুলো তারই প্রতিফলন। তামিল সিনেমার প্রচলিত ‘হিরোইজম’ ভিত্তিক গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলো দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
এরমধ্যে বিজয় অভিনীত সাচেইন (২০০৫) এবং আধি (২০০৬) সিনেমা দুটি আগের সিনেমাগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন ধারার ছিলো। কিন্তু ২০০৭ সালে প্রভু দেবা পরিচালিত ‘পক্কিরি’ সিনেমাটি বিজয়ের জন্য নতুন একটি মাইলফলক হিসেবে আবির্ভুত হয়। বক্স অফিসে বিশাল সাফল্যের পাশপাশি সিনেমাটি বিজয়ের বড় একটি ফ্যানবেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়। যদিও আঝাগিয়া তামিল মাগান (২০০৭), সুরা (২০০৯), ভিল্লু (২০০৯) এবং কাভালান (২০১১) সিনেমাগুলো বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বক্স অফিসে সিনেমাগুলোর ব্যর্থতা বিজয়ের বিশাল ফ্যানবেজের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এরপর ২০১১ সালে মুক্তিপাপ্ত মোহান রাজা পরিচালিত ‘ভেলাইয়ুদাম’ সিনেমার মাধ্যমে আবারো বক্স অফিসে ঝড় তুলেন থালাপাতি বিজয়। দিওয়ালীতে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি সুরিয়া অভিনীত ‘সেভাম আরিভু’ সিনেমার সাথে বক্স অফিসে মুখোমুখি হয় এবং বাণিজ্যিক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
বিজয় অভিনীত চরিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রজনীকান্তের মত অনেকটা নিরাপদ পথে হেঁটেছেন এই তারকা। আর্ট এবং পুরষ্কারের চেয়ে বিজয়ের সিনেমায় সাধারণত বাণিজ্যিক সাফল্যের উপরই জোর দিয়েছেন। সিনেমার পর্দায় রজনীকান্তের মত বিজয়কেও মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নবিত্তকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা গেছে। উদাহরন হিসেবে অটোচালক, মাঝি অথবা গাড়ির মেকানিক চরিত্রগুলো উল্লেখযোগ্য। ‘থুপাক্কি’ সিনেমায় বিজয়ের অভিনীত চরিত্রটি সবধরনের দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো।
বিজয়ের ক্যারিয়ারে ২০১৩ সালটি খুবই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। এই বছরে বিজয় অভিনীত ‘থালাইভা’ মুক্তি নিয়ে দেখা গিয়েছিলো জটিলতা। ঈদে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের বাধার মুখে তামিল নাড়ুতে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। সিনেমাটিতে অতিরিক্ত সহিংসতার অভিযোগে সিনেমাটির মুক্তি বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো। সে সময়ে সিনেমাটির মুক্তির অনুমতি চেয়ে তামিল নাড়ুর মুখ্য মন্ত্রী জয়ললিতাকেও অনুরোধ করেন থালাপাতি বিজয়। শুধু তাই নয় সিনেমাটির মুক্তির জন্য প্রযোজক, পরিচালক এবং সঙ্গীত পরিচালক পুলিশের সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন, কিন্তু কোন কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি।
‘থালাইভা’র পর থালাপাতি বিজয় অভিনীত ‘জিল্লা’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০১৪ সালে। এই সিনেমায় বিজয় অভিনয় করেন মালায়লাম মেগাস্টার মোহনলালের সাথে। এই সিনেমাটি বিজয়কে আবার তার সফলতার ধারায় ফিরিয়ে আনে। একই বছরে বিজয় অভিনয় করেন এ আর মুরুগুদাস পরিচালিত ‘কাথথি’ সিনেমায়। বক্স অফিসে সফলতা অর্জন করলেও সিনেমাটির বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ উঠে। সিনেমাটির ফার্স্টলুক মোশন পোস্টারের সাথে তুর্কির একটি পত্রিকার ক্যাম্পেইন নকলের অভিযোগ উঠে। শুধু তাই না, সিনেমাটির গল্প ‘মোথা কুরি’ নামে একটি উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছে অভিযোগ করে মামলা করেন গোপি নাইয়ার। এতকিছুর পরও সিনেমাটি দর্শক এবং সমালোচকদের কাছ থেকে ভালো রিভিউ পেতে সক্ষম হয়েছিলো। এরপর ২০১৫ সালে থালাপাতি বক্স অফিসে আবারো ঝড় তোলেন ‘চিম্বুদেবান’ সিনেমার মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে এই সিনেমাতে জয়ললিতা এবং তার সরকারের সমালোচনাকে বিষয়বস্তু করে নির্মিত হয়েছিলো সিনেমাটি।
এদিকে বিজয়ের সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলো সিনেমাই বক্স অফিসে বানিজ্যিক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এরমধ্যে থেরি (২০১৬), বাইরাভা (২০১৭), মার্সাল (২০১৭) এবং সরকার (২০১৮) থালাপাতি বিজয়ের রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করেছে। রাজনৈতিক সংলাপ থাকার কারনে ‘মার্সাল’ সিনেমাটি মুক্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে বিজেপি। একই ঘটনা দেখা গেছে ‘সরকার’ সিনেমার ক্ষেত্রেও। সিনেমাটি মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহে সহিংসতার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য কর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন সিনেমাটির নির্মাতারা। এছাড়া বিজয়ের ‘বিগিল’ এবং সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মাষ্টার’ সিনেমা দুটিও বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করতে সক্ষম হয়েছিলো।
সিনেমায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজে তার অন্তর্ভুক্তিকে আগামী দিনে রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততার আভাস পাচ্ছেন অনেকেই। ‘বিজয় মাক্কাল ইয়াক্কাম’ এর মাধ্যমে থালাপাতি বিজয় সুবিধাবঞ্ছিতদের সাহায্য করে আসছেন অনেকদিন থেকে। বাচ্ছাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করার সাথে সাথে বিনা খরচে বিয়েরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন বিজয়। তবে আগামী দিনে সিনেমার পর্দার মত রাজনীতির মাঠও বিজয় কাঁপাবেন কিনা সেটা সময়ই বলে দিবে। আপাতত বিজয় ব্যস্থ আছেন তার নতুন সিনেমাগুলো নিয়ে। সম্প্রতি বিজয়ের পরবর্তি সিনেমা ‘বিস্ট’ এর ফার্স্টলুক পোষ্টার প্রকাশ করা হয়েছে। ফার্স্টলুক প্রকাশের পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভক্তদের মাঝে দেখা গেছে উম্মাদনা। নেলসন পরিচালিত এই সিনেমায় বিজয়ের বিপরীতে অভিনয় করছেন পূজা হেগ।
আরো পড়ুনঃ
থালাপাতি বিজয় সম্পর্কে মজার কিছু ঘটনাঃ দেখে নিন বিস্তারিত
প্রকাশ্যে থালাপাতি বিজয়ের নতুন সিনেমার ফার্স্টলুক পোষ্টার
যে ৫টি সিনেমা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো থালাপাতি বিজয়ের স্টারডম