১৯৯৮ সালে ‘দিল সে’ সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, তখন শাহরুখ খান এবং মনীষা কৈরালা তাদের ক্যারিয়ারের শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। এই জুটিকে নিয়ে প্রশংসিত চলচ্চিত্র নির্মাতা মণি রত্নমের সিনেমাটি সেলুলয়েডে জাদু দেখাবে বলে আশা করেছিলেন সবাই। সঙ্গীত প্রতিভা এ আর রহমান এবং কিংবদন্তি গুলজারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছিলো একটি মিউজিক্যাল লাভ স্টোরি। শেখর কাপুর এবং রাম গোপাল ভার্মার প্রযোজনায় সিনেমাটিতে সন্তোষ সিভানের সিনেমাটোগ্রাফির সাথে কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন ফারাহ খান। বক্স অফিসে ঝড় তোলার সম্ভাব্য সব উপাদানই ছিলো শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ সিনেমায়।
কিন্তু সবার প্রত্যাশার বিপরীতে শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ সিনেমাটি বক্স অফিস ছিলো হতাশাজনক। এটি রত্নমের লাভ ট্রিলজির (রোজা এবং বোম্বে) অন্যান্য চলচ্চিত্রের বিপরীতে সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও ব্যর্থ হয়। একমাত্র জিনিস যা শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো তা হল এর অবিস্মরণীয় গানগুলি। মুক্তির সময় বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরলেও সময়ের সাথে সাথে ‘দিল সে’ সিনেমাপ্রেমীদের কাছে কাল্ট-ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। কেউ কেউ এটিকে তার সময়ের আগে নির্মিত সিনেমা বলেও অভিহিত করেছে।
নব্বইয়ের দশকে বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতারা যখন আন্তর্জাতিক লোকেশন, রোম্যান্স এবং সরিষার ক্ষেতের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন, তখন মণি রত্নমের প্রেম-কাহিনী এবং চলচ্চিত্রগুলি সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ‘রোজা’ এবং ‘বোম্বে’ সিনেমাগুলোর পরে তার রোম্যান্টিক ট্রিলজির তৃতীয় সিনেমা ছিলো শাহরুখ খান, মনীষা কৈরালা এবং প্রীতি জিনতা অভিনীত ‘দিল সে’। একটি ধ্বংসাত্মক প্রেমের গল্পের সাথে সিনেমাটিতে উঠে এসেছিলো সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সময়ের আগে নির্মিত মাস্টারপিস শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ সিনেমার কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করবো আজকের এই লিখায়।
০১। ‘দিল সে’ কোন আদর্শ প্রেমের গল্প নয়
শুরুতে ‘দিল সে’ সিনেমাটি অল ইন্ডিয়া রেডিওর দিল্লি-ভিত্তিক প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ অমর (শাহরুখ খান) এবং একটি সন্ত্রাসী দলের সদস্য রহস্যময় যুবতী মেঘনার/ময়নার (মনিষা কৈরালা) মধ্যে প্রেমের গল্প হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে। কিন্তু আদতে সিনেমাটি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। গল্পে দেখা যায় অমর চায় ময়নার প্রতি তার ভালোবাসা ও উৎসর্গ অমর হোক। অন্যদিকে ময়নাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক ধর্ষণ করেছিল যে তার গ্রাম এবং তার পরিবারকে পুড়িয়ে দিয়েছে।
মেঘনা তার সমস্ত জীবন সেই ট্রমায় কাটিয়েছেন এবং সম্ভবত কাউকে ভালবাসার কথা ভাবতে পারেন না। কিন্তু অমর মেঘনাকে ঘীরে তার অনুভূতি নিয়েই বেশী চিন্তিত। সিনেমাটির ‘নায়ক’ এমন একজন মহিলার ব্যাপারে বেপরোয়া যে তার সবকিছু প্রত্যাখ্যান করে। সিনেমাটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে বিষাক্ত সম্পর্কের মহিমান্বিত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু হয়তো এটাই ছিল রত্নমের উদ্দেশ্য। প্রধান চরিত্রকে আবেগপ্রবণ এবং বিরক্তিকর ব্যক্তি হিসাবে দেখিয়ে, তিনি ‘নায়ক’-এর প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিলেন।
০২। একসাথে প্রেমের সাতটি শেড
শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ বলিউডের প্রথম সিনেমা যেখানে একসাথে প্রেমের সাতটি শেড দেখানো হয়েছে। সিনেমাটিতে একই সাথে আকর্ষণ, মোহ, প্রেম, শ্রদ্ধা, পূজা, আবেশ এবং মৃত্যু – এই সাতটি রুপ উঠে এসেছে। ‘দিল সে’ সিনেমার প্রেমের গল্পে যে সাতটি শেড দেখা গেছে তা প্রাচীন আরবি সাহিত্যে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অমরকান্ত দেশাই (শাহরুখ খান) এর চরিত্রটি এত সুন্দরভাবে এই সমস্ত পর্যায় অতিক্রম করে যে সিনেমাটি দর্শকদের জন্য একটি কাব্যিক এবং ভিজ্যুয়াল আনন্দে পরিণত হয়। এমনকি সিনেমাটির শুরুর দৃশ্যে মনি রত্নাম যেভাবে মেঘনা/ময়নাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন তা আজও দর্শকদের বিমোহিত করে।
০৩। বহুস্তর বিশিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য
‘দিল সে’ একটি শক্তিশালী সিনেমা যার মধ্যে এমন অনেক রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতাকে চিত্রিত করে। যেখানে দেখা যায় ক্ষমতায় থাকা লোকেরা সংখ্যালঘুদের তাদের দাবি অনুযায়ী কাজ করার ধারণা নিয়ে গ্রাস করে। দিল্লির অমর, যিনি ভারতের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী স্মরণে একটি রেডিও প্রোগ্রাম তৈরি করার সময় ময়নার সাথে দেখা করেন, তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন যা সর্বদা দেশের শীর্ষ অগ্রাধিকার ছিল। একইভাবে, ময়নার চরিত্রটি ভারতের সমস্ত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের ক্রমাগত কিনারায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ময়নার প্রতি অমরের সাধনা এবং আবেশকে সংখ্যালঘুদের তাদের দাবি মেনে নেওয়া এবং আত্মসমর্পণ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের (সংখ্যাগরিষ্ঠদের) আবেশের রূপক হিসাবে দেখা।
০৪। অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি
লাদাখের ধুলোময় এবং অদ্ভুত ল্যান্ডস্কেপ, দিল্লির রোজকার রাস্তাগুলি এবং কেরালার সৌন্দর্য – সন্তোষ সিভানের সিনেমাটোগ্রাফিতে সেই জায়গা এবং এর লোকেদের বৈশিষ্ট্য দারুণ ভাবে উঠে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিরতির আগ পর্যন্ত যেহেতু সিনেমাটি সম্পূর্ণরূপে উত্তর-পূর্ব ভিত্তিক, তাই সিভান ঘন ঘন প্রশস্ত শট ব্যবহার করে, দর্শকদেরকে একটি খোলা, বিস্তীর্ণ ল্যান্ডস্কেপের অংশ হওয়ার অনুভূতি দেন। কিন্তু বিরতির পরে গল্পটি যখন দিল্লিতে চলে যায় তখন তিনি একটি টাইট ফ্রেমে চলে যান, আঁটসাঁটভাবে বস্তাবন্দী কংক্রিটের শহরের ভিড়ের সারাংশকে ক্যামেরাবন্ধী করেন। এটি একটি চতুর সৃজনশীল পন্থা, কারণ এটি পরিবর্তিত ভৌগলিক এবং অবস্থানগুলিকে চিত্রিত করতে সাহায্য করে যেখানে গল্পটি উন্মোচিত হচ্ছে৷ একইভাবে, এটি একটি সঙ্কুচিত প্রভাব তৈরি করে যা গল্পটি কীভাবে শেষ হতে চলেছে তার প্লটের সাথে মানিয়ে যায়।
০৫। দুর্দান্ত অভিনয়
‘দিল সে’ সিনেমাটি শাহরুখ খানের সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয়ের সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অমর চরিত্রে বলিউড বাদশার অভিনয় এখনো দর্শকদের আলোড়িত করে। অন্যদিকে ময়নার চরিত্রে মনীষা কৈরালা ছাড়া অন্য কথা ভাবাটা কঠিন যে কারো জন্য। তিনি কেবল ময়নার চরিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দোষতা, দুর্বলতা এবং বিভ্রান্তির নিখুঁত সংমিশ্রণই আনেননি, অভিনয়ের মেজাজ এবং আবেগের নির্ভুলতা দিয়ে প্রতিটি দৃশ্যকে প্রাণবন্ত করে তোলেছেন।
০৬। তিগমাংশু ধুলিয়ার সংলাপ
তিগমাংশু ধুলিয়ার সংলাপে মেঘনা এবং অমরের মধ্যে রোমান্স ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। সিনেমাটির সংলাপগুলি চাঁদের মরুভূমির টিলাগুলিকে আরও জমকালো করে তোলে। মেঘনার প্রতি অমরের প্রেমের স্বীকারোক্তিতে সবচেয়ে প্রাণবন্ত সংলাপগুলির মধ্যে একটি ছিল। কেন তিনি তার এবং মেঘনার মধ্যকার দূরত্বকে আরও বেশি পছন্দ করেন সেটা অমর বলেন এই সংলাপের মাধ্যমে, ‘আমার কাছে এই দূরত্ব সবচেয়ে পছন্দের… কারন এই দূরত্ব না থাকলে তোমার কাছাকাছি আসার কোন উচ্ছ্বাস কাজ করত না…!’ সিনেমাটির গল্প এবং চরিত্রের গভীরতা তিগমাংশু ধুলিয়ার সংলাপে আরো বেশী আবেশী হয়ে উঠে।
০৭। কালজয়ী গানের সিনেমা
শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ সিনেমার অন্যতম সেরা দিক ছিলো কালজয়ী সব গান। ভারতীয় সঙ্গীতের দুই কিংবদন্তী একসাথে সিনেমাটির গানের কারিগর হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। গুলজারের কথায় সিনেমাটির গানগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এআর রহমান। এই সিনেমার ‘ছাইয়া ছাইয়া’ গানটি বলিউডের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি। শুধু তাই নয়, বিবিসি’এ একটি জরিপ অনুযায়ী এই গানটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়া সিনেমাটির দিল সে, জিয়া জলে এবং সাতরঙ্গী রে গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো।
তবে শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ যে একদম নির্ভুল সিনেমা সেটাও বলছি না। আরো অনেক আলোচিত সিনেমার মত ‘দিল সে’ ভুলের উর্ধে নয়। সিনেমাটির দীর্ঘ একটু বেশী এবং নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স ব্যতীত প্রথম দেখায় সিনেমাটি দর্শকদের মাঝে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। এছাড়া সিনেমাটি দর্শকদের কাছে নির্দিষ্ট কোন বার্তা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ ছিলো। একইভাবে, অমরের অতিরিক্ত আবেশ মাঝে মাঝে বিরক্তিকর, দর্শকদের অস্বস্তিকর করে তোলে। এই ত্রুটিগুলো থাকা সত্ত্বেও, শাহরুখ খানের ‘দিল সে’ সময়ের আগে নির্মিত একটি বলিউড মাস্টারপিস হিসেবে স্থান পাবে। এক কথায় বললে এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে মর্মস্পর্শী এবং চিন্তা-প্ররোচনামূলক হিন্দি সিনেমাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘দিল সে’।
আরো পড়ুনঃ
অয়ন মুখার্জির ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ সিনেমায় অস্ত্রভার্সের শক্তিশালী অস্ত্র উপাখ্যান!
ঋতুপর্ণ ঘোষ: চলচ্চিত্রের একজন স্বপ্নদর্শী গল্পকারের সেরা কিছু কাজ
হলিউড থেকে মেক্সিকোঃ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি