(শাহরুখ খানের এক দশক নিয়ে প্রথম পর্বের পর থেকে) ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এরপর ২০১৫ সালে শাহরুখ খান আবারও পর্দায় হাজির হন রোহিত শেঠীর সিনেমায়। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ এর বিশাল সাফল্যের পর রোহিত শেঠীর সিনেমা, দীর্ঘ ৫ বছর পর শাহরুখ-কাজল জুটি, ক্রিসমাসে মুক্তি – সব মিলিয়ে বড় আয়োজনে আসার জন্য প্রস্তুত ছিল ‘দিলওয়ালে’। উল্লেখ্য যে, একই দিনে মুক্তি পায় সঞ্জয়লীলা বানসালি পরিচালিত রনবীর সিং-প্রিয়াংকা-দীপিকা অভিনীত ‘বাজিরাও মাস্তানি’। তবে মুক্তির আগে প্রেক্ষাগৃহ দখলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিল শাহরুখ খানের ‘দিলওয়ালে’। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ এর পর আরো একবার শাহরুখ-রোহিত ম্যাজিক দেখতে হুমড়ি পরে দর্শক, কিন্তু আরো একবার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ শাহরুখ খান। সমালোচকদের পাশাপাশি দর্শকরাও মুখ ফিরিয়ে নেন সিনেমা থেকে, যার ফলে মুক্তির তিন দিনের মাথায় দর্শক হারাতে থাকে এই সিনেমা।
অন্যদিকে সমালোচক এবং দর্শকদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠে রনভির সিং, দীপিকা পাডুকোন এবং প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত সিনেমা ‘বাজিরাও মাস্তানি’। দ্বিতীয় সপ্তাহেই তাই প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা এবং বক্স অফিস আয়ে বড় ধরণের পতনের মুখে পরে ‘দিলওয়ালে’। বানিজ্যিকভাবে ব্যর্থতার পাশাপাশি এই সিনেমার মান নিয়ে সমালোচনা হয় অনেক। এছাড়াও বলিউডের বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সিনেমাটির বানিজ্যিক ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে পরিচালক রোহিত শেঠীর সাথে মনমালিন্যে জরান বলিউড বাদশা। সেসময় একটি সংবাদ মাধ্যমের সাথে আলাপকালে শাহরুখ খান সিনেমার মানের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি সিনেমায় অভিনবত্ব (novelty) চান তাহলে ফ্যান দেখুন।’ সবার কাছে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই শুরু হয় শাহরুখ খানের নতুন সিনেমা ‘ফ্যান’ এর প্রচারনা।
সম্ভাবনা দিয়ে শুরু হলো শাহরুখ খানের ২০১৬ সালের যাত্রা। আর এই যাত্রার উপলক্ষ্য ছিল ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ খ্যাত পরিচালক মানিষ শর্মার স্বপ্নের ছবি ‘ফ্যান’। যশ রাজ ফিল্মস প্রযোজিত সিনেমাটির গল্প একজন ফিল্মস্টার এবং হুবহু তার মত দেখতে তার এক অন্ধ ভক্তকে নিয়ে। গল্পের সেই সুপারষ্টার এবং অন্ধ ভক্ত দুই চরিত্রেই ছিলেন শাহরুখ খান। বলিউডের গতানুগতিক নায়ক-নায়িকা আর নাচে গানে ভরপুর সিনেমার ধরন থেকে ভিন্ন ধারার সিনেমা ‘ফ্যান’ মুক্তি পায় ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে। সিনেমাটি নিয়ে বলিউড প্রেমীদের পাশাপাশি আশাবাদী ছিলেন শাহরুখ খান নিজেও। আইপিএল চলাকালীন সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি প্রথমদিন ভালো ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে আবারো দর্শক হারাতে থাকে সিনেমাটি। মুক্তির আগে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলো ‘ফ্যান’, সিনেমার দ্বিতীয় ভাগে এসে সে সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পরে। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮৪ কোটি রুপিতে থামে ‘ফ্যান’সিনেমার বক্স অফিস যাত্রা, আর ফলাফল ২০০৪ সালের ‘স্বদেশ’ সিনেমার পর প্রথমবারের মত শাহরুখ খানের ফ্লপ সিনেমা দেখল বলিউড।
২০১৭ সালটা শাহরুখ খানের শুরু হয় আলোচনা সমালোচনা দিয়ে। বছরের শুরুতে শাহরুখ খান অভিনীত ‘রাইস’ সিনেমা নিয়ে এর সূত্রপাত। ‘রাইস’ সিনেমার মুক্তির তারিখ ঘোষনার আগেই রাকেশ রোশন ঘোষনা করেছিলেন ২৫শে জানুয়ারি মুক্তি পাবে সঞ্জয় গুপ্ত পরিচালিত হৃত্বিক অভিনীত ‘কাবিল’ সিনেমা। পরবর্তীতে, ‘রাইস’ প্রযোজক ফারহান আকতার একই দিনে শাহরুখ খান অভিনীত সিনেমাটি মুক্তির তারিখ ঘোষনা করলে শুরু হয় এই বিতর্ক। অবশেষে একই দিনে মুক্তির মাধ্যমে বক্স অফিসের লড়াইয়ে নামেন সময়ের বড় দুই তারকা শাহরুখ খান এবং হৃত্বিক রোশন। আরো একটি অ্যাকশন নির্ভর সিনেমায় শাহরুখের উপস্থিতি দর্শকের মধ্যে আগ্রহের তৈরী করে। তবে বড় দুইটি সিনেমার একই দিনে মুক্তি দুইটি সিনেমাকেই সম্ভাব্য আয় থেকে বঞ্চিত করে। শেষ পর্যন্ত ১২৯ কোটি রুপি আয় করে সেমি-হিট হয় সিনেমাটি।
২০১৭ সালের শুরুতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাইস’ সিনেমার ফলাফল বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা গেলেও একই বছরের পরের সিনেমাটি শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের একটা কালো অধ্যায় বলা চলে। ওই বছর শাহরুখ খানের মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিতীয় সিনেমা ‘যাব হ্যারি মেট সেজাল’। ইমতিয়াজ আলী পরিচালিত এই সিনেমাটির সাথে নিজের নাম যুক্ত করার যৌক্তিকতা শাহরুখ খান নিজেও জানেন কিনা জানিনা। ‘যাব উই মেট’ বা ‘রকস্টার’ সিনেমা দিয়ে সীমিত একটা দর্শক মহলের কাছে গ্রহযোগ্যতা পেলেও সর্বমহলের দর্শকদের সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ ছিলেন ইমতিয়াজ আলী। কিন্তু শাহরুখ খানের সাথে এই সিনেমায় সেই সীমিত দর্শকদের প্রত্যাশাও পূরণ করতে পারেননি ইমতিয়াজ আলী। আরো একটি নিম্নমানের চিত্রনাট্য বাছাইয়ের কারনে দর্শক থেকে শুরু করে বলিউড সংশ্লিষ্ট সবার সমালোচনার মুখে পড়েন শাহরুখ খান। ফলশ্রুতিতে স্টারডম অর্জনের পর শাহরুখ খানের সবচেয়ে নিম্নমানের সিনেমা ‘যাব হ্যারি মেট সেজাল’।
দুঃস্বপ্নের ২০১৭ শেষ করে শারুখ খান শুরু করেন আলোচিত পরিচালক আনন্দ এল রাই পরিচালিত সিনেমা ‘জিরো’। এর আগে এই পরিচালক ‘রঞ্জনা’ তনু ওয়েডস মনু’ এবং ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’ এর মত সিনেমা দিয়ে দর্শক এবং সমালোচকদের কাছে একটি প্রিয় নাম। এছাড়া ‘জিরো’ সিনেমার বিষয়বস্তুর কারনে সিনেমাটি ছিল সর্বমহলে আলোচিত। এই সিনেমায় শাহরুখ খান একজন বামনের চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমাটি নিয়ে কিছু বলার আগে এ প্রসঙ্গে বলিউডের একজন পরিচালকের একটা টুইট আমি উল্লেখ করতে চাই। ‘জিরো’ সিনেমাতে শাহরুখ খানের বামন চরিত্রে অভিনয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষনার পর পরিচালক রাম গোপাল ভার্মা এক টুইটে লিখেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি যে শাহরুখ খানের পরিণতি কমল হাসানের মত না হয়ে যায়। কমল হাসান যেমন বামন, বোবা, অন্ধ – এরকম চরিত্রে অভিনয় করে রজনীকান্তের কাছে স্টারডম হারিয়েছেন, তেমনি শাহরুখ খানও বামন চরিত্রে অভিনয় করে সালমান খানের কাছে তার স্টারডম হারাবেন।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে ‘জিরো’ সিনেমাটি মুক্তির পর রাম গোপাল ভার্মার কথাটা ধ্রুব সত্যের মত সামনে আসে। ‘জিরো’র ট্রেলার মুক্তির পর সবার প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয় এবং সিনেমার প্রতি সবার প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। সিনেমাটিতে শাহরুখ খানের সাথে অভিনয় করেন আনুশকা শর্মা এবং ক্যাটরিনা কাইফ। ২০১৮ সালের ক্রিসমাসে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাও বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রথম সপ্তাহে কিছুটা ব্যবসা করলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে রোহিত শেঠি পরিচালিত রনবীর সিং অভিনীত ‘সিম্বা’ মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহ থেকে অনেকটা উদাও হয়ে যায় ‘জিরো’। অন্যদিকে ‘সিম্বা’ দুর্দান্ত ব্যবসা করে এবং বক্স অফিসে ব্লকবাষ্টার হয়। আর আগের ধারাবহিকতায় শাহরুখ খানের বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘জিরো’ বক্স অফিসে ফ্লপ সিনেমার খাতায় নাম লিখায়।
আরো পড়ুনঃ
বলিউডের তিন খানের দুই দশকঃ অভিনেতা ও সুপারস্টার আমির খান (প্রথম পর্ব)
বলিউডের তিন খানের দুই দশকঃ অভিনেতা ও সুপারস্টার আমির খান (দ্বিতীয় পর্ব)
শাহরুখ খানের এক দশক: ‘সুপার হিরো’ থেকে ‘জিরো’ (প্রথম পর্ব)