শাকিব খানের দুই দশক: মাসুদ রানা থেকে সুপারস্টার (প্রথম পর্ব)

শাকিব খানের দুই দশক

সালটা ১৯৯৯, ঢালিউডের বানিজ্যিক সিনেমার অন্যতম সফল নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান তার ‘অনন্ত ভালবাসা’ সিনেমার জন্য দুইজন নবাগত তারকাকে নির্বাচন করেন। এই দুই নবাগত হলেন শাকিব খান এবং ইরিন জামান। তবে সিনেমাটি মুক্তির আগে থেকে আলোচনা ছিল ঐসময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা মৌসুমীর ছোট বোন ইরিন জামানকে ঘীরে। যদিও শাকিব খানের প্রথম চুক্তিবদ্ধ আফতাব খান টুলু পরিচালিত ‘সবাইতো সুখী হতে চায়’ কিন্তু প্রথম মুক্তি পায় ‘অনন্ত ভালবাসা’। তখনও হয়তো কেউ ধারনা করতে পারেনি যে মাত্রই অভিষিক্ত হওয়া সেই হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটি একদিন আবির্ভুত হবে বাংলা সিনেমার একক সম্রাট হিসেবে। কালের বিবর্তনে, শাকিব খান আজ ঢালিউডের সবচেয়ে বড় তারকা, যাকে ‘কিং খান’ হিসেবে ডাকতে ভালোবাসেন তার ভক্তরা।

১৯৯৯ সালে সিনেমায় অভিষেকের সুবাদে শাকিব খান কিছুটা ছোঁয়া পেয়েছিলেন আমাদের সোনালী প্রজন্মের সিনেমার। শাকিব খান যখন অভিনয় শুরু করেন তখন রিয়াজ, রুবেল, মান্না, ইলিয়াস কাঞ্চন, আমিন খান, শাকিল খান নিয়মিত ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে নিয়মিত অভিনয়ে ছিলেন রাজ্জাক, আলমগীর, হুমায়ুন ফরীদি, রাজীব, এটিএম শামসুজ্জামান এর মত ঢালিউডের কিংবদন্তী অভিনেতারা। আর অভিনেত্রীদের মধ্যে অভিনয়ে নিয়মিত ছিলেন শাবনূর, পপি, পূর্ণিমা, মৌসুমী এর মত তারকারা। প্রথম সিনেমায় যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিলেন শাকিব খান, তা পুরোপুরি বাস্তবে রুপ দেয়ার পথ চলাটা মোটেও সহজ ছিলোনা শাকিব খানের জন্য।

তার এই পথ চলায় ছিল অনেক চড়াই উৎরাই। অভিনয় জীবনের দ্বিতীয় বছরেই তিনি সে সময়ের শীর্ষ অভিনেত্রী শাবনূরের বিপরীতে ইস্পাহানী-আরিফ জাহান পরিচালিত গোলাম (২০০০) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যেমন আলোচিত হন, তেমনি টানা ব্যর্থতার সাথে নিজের আত্নবিশ্বাস দিয়ে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। একক নায়ক হিসেবে অভিষেকের পরও তিনি প্রতিনিয়ত অভিনয় করেছেন অন্য নায়কদের সাথে দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে। রুবেল এবং মান্নার বেশ সিনেমায় দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। তবে এটাও ঠিক এই সিনেমাগুলো শাকিব খানকে বাংলা সিনেমার দর্শকদের কাছে দিয়েছে পরিচিতি। রুবেল এবং মান্নার নিজস্ব যে ভক্তগোষ্ঠী ছিল তাদের কাছে তখন শাকিব খান নতুন এক অভিজ্ঞতার নাম। শাকিব খানের এই দীর্ঘ পথচলার বড় একটা ভীত তৈরী করেছে এই সিনেমাগুলো।

তবে নায়ক শাকিব খানের সুপারষ্টার হওয়ার শুরুটা ২০০৬ সাল থেকে। ২০০৬ সালে এই তারকার ১৩টি সিনেমা মুক্তি পায় এবং সেগুলো এই বছরের সেরা ব্যবসাসফল সিনেমা ছিল। এই সাফল্যের ফলে তার পারিশ্রমিক তিন লাখ থেকে ছয়-সাত লাখে উত্তীর্ণ হয়। শুধুমাত্র বানিজ্যিক সিনেমা নয়, এই বছর চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত সুভা সিনেমায় পূর্ণিমার বিপরীতে অভিনয় করেন, যা তাকে একজন অভিনেতা হিসেবে পূর্নতা এনে দেয়। পাশাপাশি ‘কোটি টাকার কাবিন’ এবং ‘চাচ্চু’ এর মোট ব্যবসা সফল সিনেমা শাকিবকে নির্মাতাদের কাছে এক নির্ভরযোগ্য নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

২০০৬ সালের সেই সাফল্যের পরের গল্পটা শুধুই শাকিব খানের। কারন পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে শাকিব অভিনীত ১২টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় এবং পূর্ববর্তী বছরের মত এই বছরও তার সিনেমাগুলো ব্যবসাসফল হয়। ২০০৬ এবং ২০০৭ – পরপর দুই বছর তার সিনেমাগুলোর বক্সঅফিস সাফল্য শাকিব খানকে ওই সময়ের সেরা তারকা মান্না’র একজন প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ২০০৮ সালে ঢালিউডে নেমে আসে এক গভীর অন্ধকার কারন ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যান মান্না। মান্নার অনুপস্থিতিতে এবং বিগত দুই বছর শাকিব খানের সফলতায় নির্মাতাদের একমাত্র ভরসার জায়গা হিসেবে সমানে আসে শাকিব খানের নাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড এম্বাসেডর ঢালিউডের কিং খান শাকিব খান।

এবার একটু দেখে নেয়া যাক, ব্যবসায়িক সফলতার বাইরে শাকিব খানের অর্জন। যেহেতু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত কোন বক্স-অফিসের হিসেবে নেই, তাই তার ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমার সংখ্যা বা অনুপাত তর্কসাপেক্ষ। তাই এখানে ব্যবসায়িক সফলতার বাইরে অভিনেতা হিসেবে শাকিব খানের অর্জনের দিকে একটু আলোকপাত করতে চাই –

পুরষ্কারের নাম  মোট বিজয়ী
জাতীয় পুরষ্কার
মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার
বাচসাস পুরস্কার
সিজেএফবি পারফরম্যান্স পুরস্কার

শাকিব খানকে নিয়ে কথা উঠলে দুইটি অমীমাংসিত বিতর্ক সামনে চলে আসে। বিতর্ক দুটি হচ্ছে – মান্না’র মৃত্যু শাকিব খানের উত্থানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে এবং শাকিব খানের কারনে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১৪০০ থেকে ২৫০ এ নেমে এসেছে। আপনি যদি যৌক্তিক বিবেচনায় চিন্তা করেন তাহলে আক্ষরিকভাবে এই দুই বিতর্কের কোনটাই প্রতিষ্ঠিত করা যায়না। এই লিখার মাঝমাঝি একটা জায়গায় যেমন আমি বলেছি ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে শাকিব খানের একাধিক সিনেমার ব্যবসায়িক সফলতার কারনে শাকিব খান তখন নির্মাতাদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন নায়ক মান্না অকালে চলে গেলেন, তখন শাকিব খান একাধিক বড় বড় পরিচালক এবং প্রযোজনা সংস্থার সাথে কাজ করছিলেন। তবে হ্যা, নায়ক মান্না যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে বক্স অফিসে মান্না-শাকিব প্রতিযোগিতা তাদের নিজেদের সিনেমার পাশাপাশি ঢালিউডকেও সমৃদ্ধ করত। যদি তাই হত তাহলে বাংলা সিনেমার দর্শকরা পেতেন কিছু মান সম্পন্ন সিনেমার দেখা।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহ কমে যাওয়ার জন্য শাকিব খানকে দায়ী করা নিতান্তই অমূলক। মান্না’র মৃত্যুর পর কেন সবাই শাকিব খানকে নিয়েই সিনেমা নির্মান করতেন? কেন চিত্রনাট্য নিয়ে শাকিবের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন পরিচালক-প্রযোজকরা? যখন পুরো ইন্ডাস্ট্রি এক শাকিবের সিনেমার উপর টিকে ছিলো তখন কেন নতুন তারকা তৈরীর কোন উদ্যাগ নেয়া হলো না এফডিসি’র পক্ষ থেকে? কেন তখনকার শক্তিশালী নির্মাতারা নতুন তারকা নিয়ে সিনেমা নির্মান করলেন না? কেন প্রযোজকরা নতুন তারকার পিছনে টাকা লগ্নি করেন নি? বর্তমানে বাংলা সিনেমার এই অচলবস্থা এবং প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের যে মিছিল চলছে তার কারন শাকিব খান না – তার কারন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর।

শাকিব খানের অবদান না হয় আপনি অস্বীকার করলেন কিন্তু এটা কিভাবে অস্বীকার করবেন যে, এই ইন্ডাস্ট্রিকে তার স্বরূপে ফেরাতে কোন উদ্যোগই নেননি সংশ্লিষ্ঠরা। আজ এত বছর পরও কেন ঢালিউডে একজন এজে মিন্টু, কাজী হায়াৎ, শহিদুল ইসলাম খোকন, মতিন রহমান বা সোহানুর রহমান সোহান তৈরী করতে পারিনি আমরা। তারকা সংকটের চেয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাতো নির্মাতা সংকট। একজন মেধাবী নির্মাতা চাইলে তারকা তৈরী করতে পারেন যেটা বিগত ২০ বছরে ঢালিউডে অনুপস্থিত। যে ২৫০/২৭০ টি প্রেক্ষাগৃহ টিকে আছে সেগুলোতে এখনো শাকিব খানই ভরসা। ইন্ডাস্ট্রির ভালোর জন্য আমরা কি আসলে পেরেছি শাকিব খানের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে? কলকাতার নির্মাতাদের সিনেমায় শাকিব খান এবং এফডিসি কেন্দ্রীক নির্মাতাদের সিনেমায় শাকিব খানকে দেখলে এই বিশাল পার্থক্যটা সুস্পষ্ঠ।

একজন মাসুদ রানার শাকিব খান হওয়ার গল্পটাকে সম্মান করতে হবে, সম্মান করতে হবে তাকে ঘীরে লাখো মানুষের উন্মাদনাকে। এই সিনেমা শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে শাকিব খানকে বাদ দিয়ে নয়, শাকিব খানকে কেন্দ্র করে সাজাতে হবে কর্ম পরিকল্পনা। এই কর্ম পরিকল্পনায় যেমন শাকিব খানকে দরকার তেমনি দরকার অন্যদেরও।

বিঃদ্রঃ লেখাটির দ্বিতীয় পর্বে থাকছে সুপারষ্টার শাকিব খানের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির সমীকরন।

আরো পড়ুনঃ
বাংলার নায়ক সালমান শাহ: বাংলা চলচ্চিত্রের এক ক্ষণজন্মা ধুমকেতু
মহানায়ক মান্না: নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এক ‘তেজি পুরুষ’
অ্যাকশন কিং জসিমঃ অসম্ভবকে সম্ভব করা সত্যিকারের এক নায়ক
লড়াকু নায়ক রুবেল: বাংলা চলচ্চিত্রের অনন্য এক অ্যাকশন হিরো’র গল্প

By নিউজ ডেস্ক

এ সম্পর্কিত