বলিউডের কিং অফ রোমান্স বলা হয়ে থাকে শাহরুখ খানকে। নিজের ক্যারিয়ারের বেশীরভাগ সিনেমায়ই রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় দিয়ে দর্শক মাতিয়েছেন বলিউড বাদশা। তার অভিনীত সিনেমাগুলো যেমন বলিউডে প্রেমের সিনেমার ক্ষেত্রে আইকনিক তেমনি শাহরুখ খানও রোম্যান্টিক চরিত্রের জন্য অনেকের আদর্শ। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘দিল তো পাগল হে’, ‘বীর জারা’, ‘কুচ কুচ হোতা হ্যাঁয়’, ‘মোহাব্বাতে’, ‘দিল সে’ এবং ‘কাল হো না হো’ এরমত কালজয়ী রোম্যান্টিক সিনেমা দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন তার নিজস্ব একটি স্টাইল। দুহাত প্রসারিত করে ভালোবাসার মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার আইকনিক স্টাইল বলিউডে রোমান্সের প্রতীক। তবে রোম্যান্টিক চরিত্রের বাইরেও এমন কিছু সিনেমা আছে যেগুলোতে নিজের সেই ইমেজকে ভেঙে নতুন করে গড়েছেন তিনি। সেক্ষেত্রে বক্স অফিসে খুব সফল সেটা না বলা গেলেও সিনেমাগুলোতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিলো। যে দশটি সিনেমা দিয়ে পর্দায় নিজের আইকনিক স্টাইল ভেঙেছেন শাহরুখ খান তার বিস্তারিত আলোচনা থাকছে এই লিখায়।
১। মায়া মেমসাব
১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন দীপা সাহি, ফারুক শেখ এবং শাহরুখ খান। এই সিনেমায় শাহরুখ খান অভিনীত চরিত্রের নাম ছিলো ললিত, যে মায়া (দীপা সাহি) নামে একজন বিবাহিত নারীর সাথে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পরে। মায়া ডঃ চারু দাসের (ফারুক শেখ) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া স্বতেও প্রথমে রুদ্র এবং পরে ললিতের সাথে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পরে। শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এই সিনেমাটিতে তার চরিত্রের ব্যাপ্তি খুব বেশী না থাকলেও পর্দায় তার উপস্থিতি অনেক সম্ভাবনাময়ি ছিলো। তিনি একজন জাগতিক সঙ্গীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিনি কেবল তার প্রেমিকার কাছে থাকার মাধ্যমে সুখ খুঁজে পেতে পারেন। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যকে খুব সূক্ষ্ম এবং চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি।
২। হে রাম
কমল হাসান অভিনীত ‘হে রাম’ সিনেমাটিতে একটি সংক্ষিপ্ত চরিত্রে দেখা গেছে শাহরুখ খানকে। ছোট চরিত্র হলেও সিনেমায় তার গুরুত্ব ছিলো অনেক। ‘হে রাম’ সিনেমায় সাকেথ রাম (কমল হাসান) এর বন্ধু আমজাদ আলী খান চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ভ্রাতৃত্বকে প্রাদান্য দেয়াই ছিলো আমজাদ খান চরিত্রের মূল উপাদান। সিনেমায় নিজের সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি স্বতেও সংলাপ এবং অভিব্যাক্তি দিয়ে পর্দায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিলেন শাহরুখ খান। সিনেমাটি কমল হাসানের স্বপ্নের প্রোজেক্ট ছিলো এবং ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয় ‘হে রাম’। একজন পাঠানের চরিত্রে শাহরুখ খানকে আরো বেশী করে দেখতে চায় তার দর্শকরা।
৩। জোস
‘জোস’ সিনেমায় শাহরুখ খান ম্যাক্স নামের একজন গ্যাংস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আর তার ভোনের চরিত্রে ছিলেন ঐশ্বরিয়া রাই। নিজের স্বভাবসুলভ রোম্যান্টিক চরিত্রের বাইরে একজন অ্যাকশন তারকার চরিত্রে পর্দায় আসেন তিনি। একই এলাকার অন্য গ্যাংস্টার প্রকাশের সাথে নিয়মিত বিরোধে জড়াতে দেখা গেছে তাকে। রোম্যান্টিক তারকার ইমেজের বাইরে ‘জোস’ সিনেমায়ও নিজের কারিশমাটিক দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। লেদারের জ্যাকেটের সাথে কানের দুলে নতুন লুকে দেখা গেছে তাকে।
৪। আশোকা
একজন কালজয়ী যোদ্ধা থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়ে যাওয়া সম্রাট অশোকের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছিলো সিনেমাটি। আর এই সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন শাহরুখ খান। মৌর্য রাজবংশের উত্তরাধিকারীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য ভিন্ন স্তরের উৎসর্গের প্রয়োজন ছিলো যেখানে শাহরুখ খানের কোন কমতি ছিলো না। এই চরিত্রটি আবেগের ঘটনার মধ্য দিয়ে যায় যা তাকে শান্তির পথে নিয়ে যায় এবং শাহরুখ খান এটি নিপুণ দক্ষতার সাথে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সম্রাট অশোককে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে শাহরুখ খানের বিকল্প নেই বলেই মনে হবে সিনেমাটি দেখার পর।
৫। স্বদেশ
‘লগান’ সিনেমার বিশাল সাফল্যের পর নির্মাতা আশুতোষ গোয়ারিকর শাহরুখ খানকে নিয়ে নির্মান করেন ‘স্বদেশ’ সিনেমাটি। রোম্যান্টিক গল্পের বাইরে সামাজিক একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত সিনেমাটিতে শাহরুখ খান একজন নাসার বিজ্ঞানীর চরিত্রে অভিনয় করেন। পুরো সিনেমায় শাহরুখ খান এবং মোহনকে আলাদা করা অনেকটাই অসম্ভব মনে হবে দর্শকদের। পানির সংকটে থাকা একটি গ্রামের মানুষদের নিয়ে পানির ড্যাম তৈরি করেন শাহরুখ খান। এছাড়া সিনেমাটিতে ভারতের প্রচলিত কাস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও অবস্থান করতে দেখা গেছে শাহরুখ খানকে। বক্স অফিসে সাফল্য অর্জনে ব্যার্থ হলেও ‘স্বদেশ’ সিনেমাটি সেই বছরের সেরা সিনেমা হিসেবে পুরষ্কার লাভ করেছিলো আর শাহরুখ খানে পেয়েছিলেন সেরা অভিনেতার পুরষ্কার। অনেক ব্লকবাস্টার সিনেমাকে পিছনে ফেলে, এখনো এই সিনেমাটিকে শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
৬। পাহেলি
ভারতের প্রচলিত পৌরনিক গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘পাহেলি’ সিনেমায় দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। এরমধ্যে একটি চরিত্র হচ্ছে ভুত অন্যটি রানী মুখার্জির স্বামী। শাহরুখ খানের রূপ ধরে সিনেমার গল্পের সেই ভূতকে লাচ্চি (রানী মুখার্জি)-র সাথে প্রেম করতে দেখা গেছে। একজন রাজপুতের চরিত্রের পাশাপাশি ভূতের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। শাহরুখ খান সুন্দরভাবে রাজপুতী উপভাষাকে টেনে নিয়েছেন এবং পর্দায় সেটা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। এই সিনেমাটিও বক্স অফিসে ব্যার্থ ছিলো কিছু সিনেমায় ভিন্ন ধরনের চরিত্রে শাহরুখ খানের অভিনয় সবার কাছেই প্রশংসিত হয়েছিলো।
৭। চাক দে! ইন্ডিয়া
শাহরুখ খানের ক্যারয়ারের সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত এবং সফল সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম চাক দে! ইন্ডিয়া। কিং অফ রোমান্স হিসেবে পরিচিত শাহরুখ খানের বিপরীতে কোন নায়িকা ছিলেন না এই সিনেমায়। ভারতের জাতীয় মহিলা হকি দলে কোচ কবির খান চরিত্রে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে দেশদ্রোহীর অপবাদ পাওয়া কবির খান একসময় ফিরে আসেন মহিলা হকি দলে কোচ হয়ে। একটি অগোছালো এবং বিচ্ছিন্ন কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে বিজয় অর্জনের সেই যাত্রাকে অসাধারণ দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন শাহরুখ খান। আর তার সেই অভিনয়ের স্বকৃতি হিসেবে জিতেছেন একাধিক পুরষ্কার।
৮। মাই নেইম ইজ খান
ব্যাক্তিগতভাবে আমার পছন্দের অন্যতম সেরা বলিউড সিনেমা আর করন জোহর পরিচালিত এখন পর্যন্ত সেরা সিনেমা ‘মাই নেইম ইজ খান’। সিনেমাটিতে শাহরুখ খানকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং করন জোহরের প্রত্যাশার প্রতি যে সম্মান তিনি দেখিয়েছেন সেটা ছিলো অসাধারণ। একজন মানসিকভাবে অক্ষম চরিত্রে অভিনয় মোটেই সহজ ছিলোনা কিন্তু শাহরুখ খান তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ উৎরে গেছেন খুব সহজেই। টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলমানদের জীবনের উপর নেমে আসা বৈরতা নিয়ে নির্মিত সিনেমাটিতে রিজওয়ান খান চরিত্রে নিজেকে অন্যভাবে পর্দায় তুলে এনেছেন বলিউড বাদশা। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য একাধিক পুরষ্কারও জিতেছেন তিনি।
৯। ডিয়ার জিন্দগি
পুরোপুরি শাহরুখ খান নির্ভর না হলেও রিমা কাগতি পরিচালিত ‘ডিয়ার জিন্দগি’ সিনেমাতে দর্শক আবিষ্কার করেছেন অন্য এক শাহরুখ খানকে। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে ডঃ জাহাঙ্গীর খান চরিত্রে শাহরুখ খান ছিলেন অসাধারণ। উন্মাদনা এবং মৌলবাদের সাথে অভিজ্ঞতার মিশ্রনে সাজানো চরিত্রটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শাহরুখ খান। জাগ বা জাহাঙ্গীর চরিত্রে শাহরুখ এতটাই সাবলীল ছিলেন যে, আপনার মনে হবে এই চরিত্রটির জন্ম শুধুমাত্র তার জন্যই হয়েছে। সিনেমায় তার সংলাপ এবং পর্দা উপস্থিতি আপনাকে অদ্ভুত এক প্রশান্তির অভিজ্ঞতা দিবে যা আপনি নিজের অনুভবে ধারন করতে চাবেন।
১০। রইস
২০১৭ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রইস’ সিনেমাতে আবারো গ্যাংস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছোটবেলা থেকেই মাদক চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত রইস একসময় তার গডফাদারকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে উঠে মাদক সম্রাট। গুজরাটের একটি বাস্তব চরিত্রের আলোকে নির্মিত এই সিনেমাটিতে শাহরুখ খানকে দেখা গেছে নিজের পরিচিত ইমেজের বাইরে অন্যভাবে। সিনেমাটিতে প্রেম রোমান্স থাকলেও সেটা ছাপিয়ে ‘রইস’ সিনেমায় শাহরুখ খান ছিলেন একজন গ্যাংস্টার। নিজের এলাকার এবং পরিবারের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার পাশাপাশি তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর সেই গ্যাংস্টারকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন নিখুঁতভাবে।
প্রিয় পাঠক, শাহরুখ খান অভিনীত উপরে উল্লেখিত সিনেমাগুলোর মধ্যে কোন সিনেমাটি আপনার কাছে সবচেয়ে পছন্দের সেটা আমাদের জানিয়ে দিন ঝটপট। এছাড়া এই বাইরে আর যদি কোন সিনেমা এই তালিকায় থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করে সেটাও আমাদের জানিয়ে দিতে পারেন মন্তব্যে।
আরো পড়ুনঃ
হলিউডের সিনেমায় অভিষেকের অপেক্ষায় ভারতের যত তারকা!
শিশু শিল্পী থেকে থালাপাতি: সুপারস্টার বিজয়ের সিনেমার যাত্রা
শাহরুখ খানের এক দশক: ‘সুপার হিরো’ থেকে ‘জিরো’