বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতা উৎসাহ যোগাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার প্রতিটি অধ্যায় জুড়ে আছে অসংখ্য গল্পের উপাখ্যান। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমা। এরকম কিছু আলোচিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা থাকছে আজকের এই লিখায়।
১। ওরা এগারো জন (১৯৭২)
১৯৭২ সালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ‘ওরা এগারো জন’। সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলেন প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম আর প্রযোজনা করেছিলেন মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষনের কিছু অংশ দেখানো হয়েছিল এতে। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, খসরু, সৈয়দ হাসান ইমাম ও খলিলউল্লাহ খানসহ অনেকে।
২। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৭২ সালে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত পরিচালক সুভাষ দত্ত। আর এর তিনটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা, উজ্জল ও আনোয়ার হোসেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বিষয়বস্তুগত দিক দিয়ে এ চলচ্চিত্রটিকে একেবারেই অন্যরকম বলে মন্তব্য করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।
৩। আলোর মিছিল (১৯৭৪)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত অন্যতম আলোচিত সিনেমা ‘আলোর মিছিল’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত এই সিনেমা ১৯৭৪ সালে মুক্তি পেয়েছিলো। সিনেমাটির প্রধান কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক, ববিতা, রাজ্জাক এবং সুজাতা।
৪। একাত্তরের যীশু (১৯৯৩)
লেখক শাহরিয়ার কবির-এর লেখা ‘একাত্তরের যীশু’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ছবির প্রধান প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন ফরীদি, জহির উদ্দিন পিয়াল, আবুল খায়ের, আনওয়ার ফারুক, কামাল বায়েজীদ ও শহীদুজ্জামান সেলিম।
৫। আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)
বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৯৪ সালে। নিজের লেখা আগুনের পরশমণি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘আগুনের পরশমণি’ হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ডলি জহুর সহ আরো অনেকে।
৬। নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৫)
১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘নদীর নাম মধুমতী’ রচনা ও পরিচালনা করেছেন তানভীর মোকাম্মেল। নূর আলী নিবেদিত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে কিনো-আই ফিল্মস। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, আলী যাকের, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সারা জাকের, আফসানা মিমি প্রমুখ।
৭। মুক্তির গান (১৯৯৫)
মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গ নেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামের দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি ডকুমেন্টারি তৈরি করতে পারেননি।
দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেন। লেভিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের সাথে সংগৃহীত অন্যান্য উপাদান যোগ করে ছবিটি নির্মিত হয়।
৮। এখনো অনেক রাত (১৯৯৭)
খান আতাউর রহমান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৯৭ সালে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে। এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক, সুচরিতা, আলীরাজ, ববিতা ও পরিচালকের ছেলে কণ্ঠশিল্পী আগুন।
৯। হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমাটি ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়। ছায়াছবিটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। ছায়াছবিতে বুড়ি মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন সুচরিতা। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা, অরুনা বিশ্বাস, অন্তরা, ইমরান, দোদুল ও আশিক।
১০। মাটির ময়না (২০০২)
তারেক মাসুদের গল্প অবলম্বনে সিনেমাটির চিত্রনাট্য যৌথভাবে রচনা করেছেন তারেক এবং ক্যাথরিন মাসুদ। আর পরিচালনা করেছেন তারেক মাসুদ। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে মাসুদের ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। চলচ্চিত্রের মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নুরুল ইসলাম বাবলু, রাসেল ফরাজী, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী, শোয়েব ইসলাম এবং লামিসা আর রিমঝিম।
১১। শ্যামল ছায়া (২০০৪)
হুমায়ন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্যামল ছায়া’ সিনেমাটি ২০০৪ সালে মুক্তি পেয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই সিনেমাটি ২০০৬ সালে “সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র” বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে নিবেদন করা হয়েছিল। ছবির বিশেষত্ব হচ্ছে, সরাসরি যুদ্ধের দৃশ্য না দেখিয়েও এতে যুদ্ধের আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
১২। জয়যাত্রা (২০০৪)
২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জয়যাত্রা’ সিনেমাটি বাংলাদেশের বিখ্যাত সম্পাদক, কাহিনিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের কাহিনি নিয়ে সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন তৌকির আহমেদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিত্তিক এই ছবিটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। সিনেমাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী।
১৩। আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১)
আমার বন্ধু রাশেদ ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশি যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত একই নামের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। সিনেমাটি প্রযোজনা করেছে মমন চলচ্চিত্র ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। আর প্রধান চরিত্রে অভিনয়ে করেছেন চৌধুরী জাওয়াতা আফনান, অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইনামুল হক, হুমায়রা হিমু, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, আরমান পারভেজ মুরাদ।
১৪। গেরিলা (২০১১)
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গেরিলা’ পরিচালনা করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত সিনেমাটি সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে৷ যৌথভাবে চিত্রনাট্য রচনা করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান। গেরিলা ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সহস্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ।
এর বাইরেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত আরো কিছু সিনেমা আছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে সব মিলিয়ে ৫০ এর কাছাকছি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছাড়াও ২০টির মোট স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র এবং ৩০ টির কিছু বেশি প্রামান্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। নতুন এছাড়া চলতি বছরে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কয়েকটি সিনেমা নির্মাণাধীন রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা নিয়ে আরো সিনেমা নির্মান করতে হবে। সময়োপযোগী এবং আধুনিকভাবে নির্মানের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের হতিহাস তুলে ধরতে হবে, তবেই স্বাধীনতার স্বরূপ সন্ধান সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। অনলাইন ব্লগ
আরো পড়ুনঃ
সেন্সর ছাড়পত্র স্থগিত: মুক্তি পাচ্ছে না শাপলা মিডিয়ার ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’
১৯শে মার্চ নয় স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি পাচ্ছে তৌকীর আহমেদের ‘স্ফুলিঙ্গ’