২০০৪ সালের ৮ই অক্টোবর শো মোশন লিমিটেড বসুন্ধরা সিটি মলে চালু করেছিলো বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা থিয়েটার। যাত্রা শুরুর পর থেকে ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’ অনেকটাই ছিলো হলিউডের সিনেমা নির্ভর। ঢাকার দর্শকরা সাধারণত হলিউডের সিনেমা দেখতেন এই মাল্টিপ্লেক্সে। তাই নির্দিষ্ট শ্রেণীর দর্শকের কাছেই সীমাবদ্ধ ছিলো ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়ার প্রেক্ষিতে স্টার সিনেপ্লেক্সের আরো একাধিক শাখা শুরুর পাশাপাশি দেশে চালু হয় ব্লকবাস্টার, সিলভার স্ক্রিন সহ বেশ কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্স।
শুরু পর থেকেই দেশীয় মাল্টপ্লেক্সগুলো মূলত হলিউডের সিনেমা নির্ভর ছিলো। হলিউডের আলোচিত সিনেমা মুক্তির মাধ্যমেই নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিলো এই আধুনিক প্রেক্ষাগৃহগুলো। মাঝে মাঝে দেশীয় কিছু সিনেমা মাল্টিপ্লেক্সে দর্শক টানলেও সেটা ইন্ডাস্ট্রি পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরির ক্ষেত্রে যতেষ্ট ছিলো না। তথাকথিত বিকল্প ধারার এই সিনেমাগুলো নির্দিষ্ট শ্রেণীর দর্শকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ ‘আয়নাবাজি’ সিনেমাটি মাল্টিপ্লেক্সে ভালো ব্যবসা করলেও সেটা দেশীয় সিনেমায় কাঙ্ক্ষিত জোয়ার এনে দিতে পারেনি।
এছাড়া ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘মিশন এক্সট্রিম’ সহ কয়েকটি মূল ধারার সিনেমা মাল্টিপ্লেক্সে দর্শক মাতালেও পরবর্তিতে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। তাই ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের মাল্টিপ্লেক্সগুলো থেকে গেছে বিদেশি সিনেমা নির্ভর। কিন্তু মূল ধারার বাংলা সিনেমার দর্শকদের মাল্টিপ্লেক্সে নিয়মিত হতে দেখা যায়নি এই সময়ে। হলিউডের আলোচিত সিনেমাগুলোর পাশে ঢালিউডের সিনেমাগুলো থেকে গেছে উপেক্ষিত। সীমিত প্রদর্শনী নিয়েই দেশীয় সিনেমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্স সহ অন্যান্য মাল্টিপ্লেক্সে।
এরমধ্যে করোনা মহামারীর কারনে দুই বছরে বাংলাদেশের সিনেমা যখন অনেকটাই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে তখন দেখা গেছে নতুন এক সময়ের। মাল্টিপ্লেক্সে নিয়মিতভাবে মুক্তি পাচ্ছে ঢালিউডের সিনেমা এবং সেগুলো প্রত্যাশিত ব্যবসাও করছে। হলিউডের সিনেমার পাশাপাশি মাল্টিপ্লেক্সের দর্শকরা ঝুঁকছেন দেশীয় সিনেমার প্রতি। এছাড়া আধুনিক ঢালিউডের কয়েকজন নির্মাতা তাদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সেই সোনালি সময়ের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করছেন ক্রমাগত ভাবে। চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত একাধিক সিনেমার মাধ্যমে মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা সিনেমার জোয়ার শুরু হয়েছে। সেই সাথে নতুন ঢালিউডের স্বপ্ন সময়ের সাথে অনেক বেশী দৃশ্যমান হচ্ছে সবার কাছে।
মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা সিনেমার জোয়ার শুরুটা হয়েছিলো চলতি বছরের রোজার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত শাকিব খানের ‘গলুই’ এবং সিয়াম আহমেদের ‘শান’ সিনেমার মাধ্যমে। একই ঈদে শতাধিক হলে শাকিব খানের ‘বিদ্রোহী’ নামে আরো একটি সিনেমা মুক্তি পেলেও, মাল্টিপ্লেক্স দর্শকদের কাছে জায়গা করে নেয় ‘গলুই’ এবং ‘শান’ সিনেমাগুলো। স্টার সিনেপ্লেক্স সহ দেশের অন্যান্য মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমাগুলো দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিলো। দুটি সিনেমাই মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দর্শকদের আগ্রহের শীর্ষে পৌঁছে যায়। সিনেমাগুলো দেখতে টিকেটের লাইনে দর্শকদের লম্বা সারি এবং ‘হাউজফুল’ বোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে।
রোজার ঈদে শুরু হওয়া সেই জোয়ারে নতুন বেগ নিয়ে আগে কোরবানির ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত অনন্ত জলিলের ‘দ্বীনঃ দ্য ডে’ এবং রায়হান রাফি পরিচালিত ‘পরাণ’। প্রথম সপ্তাহে শতাধিক হলে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্বীনঃ দ্য ডে’ সিনেমাটি বিভিন্ন কারনে আলোচনায় থাকলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে দৃশ্যপট পাল্টে দেয় রায়হান রাফির আলোচিত সিনেমা ‘পরাণ’। প্রথম সপ্তাহের তুলনায় দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছিলো সিনেমাটি। বিশেষ করে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমাটির প্রদর্শনী নিয়মিতভাবে হাউজফুল হয়েছিলো। ‘পরাণ’ সিনেমাটির মাধ্যমে ঢালিউড পেয়েছিলো বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই উম্মাদনা।
‘গলুই’, ‘শান’ এবং ‘পরাণ’ সিনেমার পর ঢালিউড সংশ্লিষ্টদের জন্য সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ ছিলো সেটা হচ্ছে মান সম্পন্ন সিনেমা মুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। কোরাবানির ঈদের একমাস পর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাওয়া’ সিনেমাটি যুক্ত হয়েছিলো মাল্টিপ্লেক্স বিপ্লবে। ‘পরাণ’ সিনেমার পাশাপাশি ‘হাওয়া’ সিনেমাতিও দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিলো দারুণভাবে। প্রথমবারের মত দেশীয় সিনেমা সাক্ষী হলো এক ইতিহাসের। মাল্টিপ্লেক্সের ইতিহাসে প্রথমবারের মত হলিউডের সিনেমার চেয়ে ঢালিউডের সিনেমার প্রদর্শনী বেশী ছিলো। কিছু কিছু মাল্টিপ্লেক্সে হলিউডের ‘থর’ সিনেমার পরিবর্তে প্রদর্শিত হয়েছে ‘পরাণ’ এবং ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটি।
মুক্তির ৭০দিন পরেও স্টার সিনেপ্লেক্সে ‘পরাণ’ দেখতে ভীড় করছেন দর্শক। সেই সাথে ‘হাওয়া’ জোয়ার চলমান রয়েছে। এই দুই সিনেমার বেশ কাটতে না কাটতেই চলতি সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে আরো দুটি সিনেমা। দীপঙ্কর দীপন পরিচালিত ‘অপারেশন সুন্দরবন’ এবং জয়া আহসান অভিনীত ‘বিউটি সার্কাস’ সিনেমাগুলো মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা সিনেমার জোয়ারে নতুন হাওয়া এনেছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাগুলো দেখতে স্টার সিনেপ্লেক্স সহ অন্যান্য মাল্টিপ্লেক্সে ভীর জমাচ্ছেন সব শ্রেণীর দর্শক। সেই সাথে সিনেমাগুলোর প্রচারণায় তারকাদের উপস্থিতি এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
মুক্তির প্রথম দুই দিন ‘অপারেশন সুন্দরবন’ এবং ‘বিউটি সার্কাস’ সিনেমাগুলোর বেশীরভাগ প্রদর্শনী হাউজফুল হতে দেখা গেছে। সিনেমাগুলোর দেখতে মাল্টিপ্লেক্সে দর্শকদের উপস্থিতি ছিলো চোখে পরার মত। স্টার সিনেপ্লেক্সের সূত্রে জানা গেছে মুক্তির প্রথমদিনে সবগুলো শাখায় ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সিনেমার বেশিরভাগ প্রদর্শনী হাউজফুল গেছে। বসুন্ধরা সিটিতে পাঁচটি প্রদর্শনীর চারটিই ছিল হাউজফুল। অন্যদিকে, ‘বিউটি সার্কাস’ সিনেমার প্রদর্শনী তুলনামূলক কম হলেও দিনভর দারুণ দর্শক টেনেছে জয়া অভিনীত এই সিনেমা।
মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা সিনেমার এই জোয়ার অব্যাহত রাখাটা এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমার জনপ্রিয়তা দেশের মফস্বলের প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদেরও আগ্রহী করে তোলে। কারন মাল্টিপ্লেক্সের দর্শকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয়। মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়ে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে আলোচনা সিনেমাগুলো নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুন। যা শেষ পর্যন্ত অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহেও দর্শক টানতে সাহায্য করে থাকে। ‘পরাণ’ এবং ‘হাওয়া’ সাফল্য তারই প্রমাণ বহন করে।
চলতি বছরে আরো কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে যেগুলো মাল্টিপ্লেক্স দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার দাবী রাখে। এরমধ্যে শাকিব খান অভিনীত ‘লিডার, আমিই বাংলাদেশ’, ‘অন্তরাত্মা’ এবং আরিফিন শুভ অভিনীত ‘মিশন এক্সট্রিম ২: ব্ল্যাক ওয়ার’ উল্লেখ যোগ্য। প্রতীক্ষিত এই সিনেমাগুলো আগের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে নতুন ঢালিউডের স্বপ্ন দৃশ্যমানতার সীমা পেরিয়ে বাস্তবতা হিসেবে আবির্ভূত হোক সেটাই সবার চাওয়া। আর একজন বাংলা সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা সেই জোয়ার অব্যাহত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন নির্মাতারা। পরিশেষে এই প্রত্যাশা ব্যাক্ত করে – জয় হোক বাংলা সিনেমার!
আরো পড়ুনঃ
ফেসবুক স্টারদের যুগে শাকিব খানই ঢালিউডের শেষ সত্যিকার সুপারস্টার
যে পাঁচটি কারনে আপনার দেখা উচিৎ দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’
হলিউড থেকে মেক্সিকোঃ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি