এই জন্মদিনে ৫৬তম বছরে পা দিচ্ছেন শাহরুখ খান। বলিউডে দীর্ঘ ৩০ বছরের ক্যারিয়ারে এই সুপারস্টার অভিনয় করেছেন ৮০টির বেশী সিনেমায়। ভক্ত সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবে স্বীকৃত শাহরুখ খান। ভক্ত এবং মিডিয়ার কাছে তিনি ‘বলিউড বাদশা’, ‘কিং অফ বলিউড’, বক্স অফিস কিং’ এবং ‘কিং খান’ হিসেবে পরিচিত। ১৪টি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারের পাশাপাশি ২০০৫ সালে অর্জন করেছেন ভারতীয় সরকার কতৃক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পুরষ্কার। সেই সাথে আছে একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এর মধ্যে ফ্রান্স সরকারের ‘অরড্রে দেস আর্টস এট দেস লেট্রেস’ এবং ‘লেগিওন অফ ওনার’ উল্লেখযোগ্য।
তুলনামূলক ভাবে রোম্যান্টিক সিনেমায় বেশী অভিনয়ের কারনে বলিউডে তাকে ‘কিং অফ রোমান্স’ নামে ডাকে অনেকে। রোম্যান্টিক সিনেমায় শাহরুখ খানের সাথে কাজল, জুহি চাওলা, রানী মুখার্জি, প্রীতি জিনতা, মাধুরী দীক্ষিত এবং দীপিকা পাডুকোনের জুটি অনেক জনপ্রিয়। তবে রোম্যান্টিক সিনেমার বাইরেও শাহরুখ খান অ্যাকশন থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। ৩০ বছরের এই বর্নীল ক্যারিয়ারে শাহরুখ খানের এমন অনেক সিনেমা রয়েছে যা তাকে ‘কিং অফ রোমান্স’ এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘কিং অফ বলিউড’ হিসেবে। চলতি বছরের ২রা নভেম্বর এই তারকা উৎযাপন করতে যাচ্ছেন তার ৫৬তম জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষ্যে চলুন দেখে নেয়া যাক শাহরুখ খান অভিনীত দশটি সিনেমা যা তাকে বলিউড বাদশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১। ডর (১৯৯৩)
ক্যারিয়ারের শুরু দিকে হলেও ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডর’ সিনেমাটি এখনও শাহরুখ খান অভিনীত সবচেয়ে হিংস্র সিনেমা হিসেবে রয়ে গেছে। যশ চোপড়া পরিচালিত এই সিনেমায় শাহরুখ খান একজন খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যে একতরফা প্রেমে হিংস্র হয়ে উঠে। শুধুমাত্র খলচরিত্র হওয়ার কারনে সালমান খান এবং আমির খান সহ বেশ কয়েকজন তারকা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সিনেমাটি। সিনেমায় শাহরুখ খানের সাথে আরো অভিনয় করেছেন সানি দেওল এবং জুহি চাওলা। কিন্তু অসাধারণ অভিনয় দিয়ে সানি দেওলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন শাহরুখ খান। ‘ডর’ সিনেমার মাধ্যমেই শাহরুখ খান বলিউড বাদশা হওয়ার এক দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন।
২। দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে (১৯৯৫)
নিঃসন্দেহে বলিউডের সর্বকালের সবচেয়ে সফল রোম্যান্টিক সিনেমা ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’। একটি রোড ট্রিপে দুইজন ছেলে মেয়ের কাছে আসা এবং একজনের প্রতি আরেকজনের দূর্বলতা – সব মিলিয়ে একটি সুন্দর রোম্যান্টিক গল্প যা আপনাকে বিমোহিত করবে মুক্তির ২৫ বছর পরও। বলিউডের সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হওয়ার রেকর্ড গড়েছে সিনেমাটি। ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ সিনেমাটি শাহরুখ খানকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন সুপারস্টার হিসেবে। সিনেমাটিতে শাহরুখ খানের অভিনয় এবং কাজলের সাথে তার পর্দা রসায়ন দর্শকদের নিয়ে যাবে ভিন্ন এক জগতে।
৩। করন-অর্জুন (১৯৯৫)
১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাহরুখ খান অভিনীত আরো একটি ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘করন-অর্জুন)। পুনর্জন্ম নিয়ে নির্মিত সিনেমাটিতে একসাথে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান এবং সালমান খান। রাকেশ রোশন পরিচালিত সিনেমাটিতে শাহরুখ খানের বিপরীতে অভিনয় করেছেন কাজল। সিনেমাটির কিছু দৃশ্য এবং সংলাপ এখনো বলিউড সিনেমাপ্রেমীদের কাছে আইকনিক। বিশেষ করে সালমান খান এবং শাহরুখ খানের দুই ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয়ের কারনে সিনেমাটি এখনো দর্শকদের কাছে অন্যতম আবেদনের দাবী রাখে।
৪। কুছ কুছ হোতা হ্যায় (১৯৯৮)
১৯৯৮ সালে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন নির্মাতা করন জোহর। ত্রিভুজ প্রেমের এই সিনেমাটিতে আরো একবার রোম্যান্টিক চরিত্রে দর্শক মাতান শাহরুখ খান। সিনেমাটিতে শাহরুখ খান ছাড়া আরো অভিনয় করেছেন কাজল এবং রানী মুখার্জি। আর একটি বিশেষ চরিত্রে ছিলেন সালমান খান। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ সিনেমার পর আরো একবার কাজলের সাথে তার পর্দা রসায়ন মুগ্ধ করে দর্শকদের। ফলশ্রুতিতে বলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যবসা সফল সিনেমার তালিকায় স্থান করে নেয় ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’। বক্স অফিসে সফলতার পাশাপাশি জাতীয় পুরষ্কার সহ একাধিক পুরষ্কার জিতেছিলো আলোচিত এই সিনেমা।
৫। দিল সে (১৯৯৮)
ব্যবসায়িক ভাবে ব্যর্থ হওয়া শাহরুখ খান অভিনীত যে কয়টি ক্লাসিক সিনেমা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ‘দিল সে’। সিনেমাটি লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন মনি রত্নম। রোম্যান্টিক গল্পের এই সিনেমায় শাহরুখ খানের বিপরীতে অভিনয় করেছেন মনীষা কৈরালা। সিনেমাটিতে শাহরুখ খান একজন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যে কিনা একজন রহস্যময় নারীর প্রেমে পরেছিলো। ভারতীয় বক্স অফিসে সফলতা না পেলেও ভারতের বাইরে সিনেমাটি ভালো ব্যবসা করতে সক্ষম হয়েছিলো। মালাইকা অরোরার সাথে ট্রেনের উপর চিত্রায়িত ‘ছাইয়া ছাইয়া’ গানটি ‘দিল সে’ সিনেমার অন্যতম প্রধান আকর্ষন ছিলো।
৬। দেবদাস (২০০২)
বলিউডের আলোচিত নির্মাতা সঞ্জয় লীলা বানসালী যখন ‘দেবদাস’ সিনেমার ঘোষনা দেন তখন বলিউডের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কারন এর আগে বলিউডে এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা দিলীপ কুমার। কিন্তু সবার শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় শাহরুখ খানের অভিনয় আরো একবার মুগ্ধ করে দর্শক এবং সমালোচকদের। ভারতীয় কথা সাহিত্যের অন্যতম ট্র্যাজিক এই চরিত্রে শাহরুখ খানের অভিনয় আরো একবার প্রমান করেছিলো বলিউড বাদশা হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা। সিনেমাটিতে শাহরুখ খানের সাথে আরো অভিনয় করেছেন ঐশ্বরিয়া রাই। মাধুরী দীক্ষিত এবং চন্দ্রচূড় সিং।
৭। কাল হো না হো (২০০৩)
আরো একটি ট্র্যাজিক প্রেমের সিনেমা এবং আরো একবার প্রতিটি দৃশ্যে শাহরুখ খানের মুগ্ধতা। ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাল হো না হো’ সিনেমায় শাহরুখ খান দেখিয়েছেন জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত উপভোগ করা কতটা জরুরী। সিনেমাটিতে শাহরুখ অভিনীত চরিত্রের নাম আমান, মৃত্যু পথযাত্রী একজন মানুষ যে শেষ পর্যন্ত অন্যদের মুখে হাসি ফুটাতে ব্যাস্ত। সিনেমাটিতে শাহরুখ খান ছাড়া আরো অভিনয় করেছেন প্রীতি জিনতা এবং সাইফ আলী খান। আর একটি বিশেষ চরিত্রে ছিলেন সোনালী বেন্দ্রে। রোম্যান্টিক সিনেমার ক্ষেত্রে ‘কাল হো না হো’ অন্যতম ক্ল্যাসিক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
৮। স্বদেশ (২০০৪)
মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো শাহরুখ খান অভিনীত কোন সিনেমাটিতে তিনি অভিনয় করতে চান। উত্তরে অমিতাভ বচ্চন বলেছিলেন ‘স্বদেশ’। ২০০৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমাটিকে শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সিনেমাটিতে শাহরুখ খান যুক্তরাষ্ট্রে নাসার একজন বিজ্ঞানী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নিজের এলাকার পানির সমস্যা সমাধানের পর নাসার চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসেন নাসার সেই বিজ্ঞানী। গতানুগতিক রোম্যান্টিক চরিত্রের বাইরে শাহরুখ খানের অভিনয় ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলো।
৯। চাক দে! ইন্ডিয়া (২০০৭)
শিমিত আমিন পরিচালিত বলিউডের অন্যতম সেরা স্পোর্টস ড্রামা সিনেমা ‘চাক দে! ইন্ডিয়া’ মুক্তি পেয়েছিলো ২০০৭ সালে। স্টাইল, গ্ল্যামার এবং রোম্যান্টিক চরিত্র – শাহরুখ খানকে এই তিন ভাবে দেখতে অভস্ত দর্শক দেখলেন পুরোপুরি ভিন্ন রূপে। ভারতের মহিলা হকি দলের কোচ কবির খান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। এই প্রথমবারের মতো দর্শক ‘কিং অফ রোমান্স’কে দেখলেন নায়িকা বিহীন একটি চরিত্রে। সিনেমায় ছিলোনা কোন রোম্যান্টিক দৃশ্য বা গান, ছিলোনা কোন অ্যাকশন দৃশ্য। কিন্তু যা ছিলো তা পুরোটা সময় দর্শকদের বিমোহিত করে রাখার জন্য যতেষ্ট ছিলো। সুপারস্টার শাহরুখ খান দেখালেন একজন পূর্ন অভিনেতার ঝলক। ব্যবসায়িক সফলতার পাশাপাশি পুরষ্কার, সবকিছু মিলিয়ে শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা হচ্ছে ‘চাক দে! ইন্ডিয়া’।
১০। মাই নেইম ইজ খান (২০১০)
শাহরুখ খানের অভিনয় সমৃদ্ধ সিনেমা ‘মাই নেইম ইজ খান’ মুক্তি পেয়েছিলো ২০১০ সালে। করন জোহর পরিচালিত এই সিনেমায় শাহরুখ খান একজন মুসলিমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে সংঘঠিত ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমাটিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন কাজল। মুক্তির আগ মুহুর্তে আইপিএল-এ পাকিস্থানের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে একটি মন্তব্যের জের ধরে ভারতে বাধার মুখে পরে সিনেমাটি। তবে শেষ পর্যন্ত এত বাধার মুখেও সিনেমাটি বক্স অফিসে হিট ব্যবসা করতে সক্ষম হয়েছিলো। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শাহরুখ খান সর্বশেষ ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার জিতেছিলেন।
এর বাইরেও শাহরুখ খান অভিনীত আরো কয়েকটি সিনেমা রয়েছে যা একজন সুপারস্টার এবং অভিনেতা হিসেবে তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। এই লিখায় আলোচনা না করা সেই সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অশোকা’, ‘মহাব্বাতে’, ‘দিলতো পাগল হে’, ‘ম্যা হু না’, ‘বীর-জারা’ ইত্যাদি। বলিউড বাদশা হিসেবে স্বীকৃতি এবং এই উপাধির প্রতি তার সুবিচার বিবেচনায় আমার কাছে এই সিনেমাগুলো উল্লেখযোগ্য। আবার তার ক্যারিয়ারে এমনও কিছু সিনেমা রয়েছে যা হয়তো তার করাটা উচিৎ। এর পর হয়তো অন্য কোন আলোচনায় সেটা নিয়ে লিখবো।
আরো পড়ুনঃ
যে দশটি সিনেমা দিয়ে নিজের আইকনিক স্টাইল ভেঙেছেন শাহরুখ খান!
শাহরুখ খানের এক দশক: ‘সুপার হিরো’ থেকে ‘জিরো’
নতুন দশকে শাহরুখের পতন: তিন খানের তুলনামূলক পর্যালোচনা