বলিউডের কিছু নির্মাতা সত্যিই বিভ্রমের মধ্যে বসবাস করেন। তারা খারাপ চিত্রনাট্য লেখার জন্য তাদের সময় উৎসর্গ করেন, যে আমরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হই। ফলস্বরূপ, আমরা ব্যতিক্রমীভাবে বাজে কিছু সিনেমা পাই যা, সিনেমা শিল্পের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকে। ‘প্রেম আগান’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে সালমান খানের কয়েকটি সিনেমা পর্যন্ত এরকম কিছু কয়েকটি সিনেমার কথা থাকছে এই লিখায়। বলিউডের এই সিনেমাগুলো দেখলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে এই সিনেমাগুলোর কি আসলেই কোন চিত্রনাট্য ছিলো? চলুন দেখে নেয়া যাক সিনেমাগুলোর বিস্তারিত।
১। ম্যায় প্রেম কি দিওয়ানি হুঁ
কারিনার জীবনের একমাত্র মূলমন্ত্র হল কলেজ শেষ হওয়ার ঠিক পরে বিয়ে করা। তার মানে তার বয়স ২০ বছরের মত। বিবাহ সংক্রান্ত কারনে তার প্রেমের (হৃতিক রোশন) সাথে দেখা হয়, যে দেখতে সুদর্শন এবং স্মার্ট। তারা একজন আরেকজনের কাছাকাছি আসে এবং নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পরবর্তিতে জানা যায় যে এটা আসল প্রেম নয়…হতাশা। এরপর সঠিক প্রেম (অভিষেক বচ্চন) আসে এবং সবকিছুকে ১০ গুন বেশী বিরক্তিকর করে তোলে।
২। জানি দুশমানঃ এক আনোখি কাহানি
একঝাক তারকা নিয়ে নির্মিত ‘জানি দুশমানঃ এক আনোখি কাহানি’ সিনেমাটি বলিউডের বিরক্তিকর সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটি ধর্ষণ, একজন নারী যিনি ধর্ষণকে ক্ষমা করেন, এক ইচ্ছাধারি নাগিন, মারাত্নক খারাপ ভিএফএক্স, ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ এবং ‘দ্য মমি’ থেকে সরাসরি নকল করা দৃশ্য – কি ছিলো না এই সিনেমায়। সম্ভবত চিত্রনাট্য ছাড়া সবই ছিলো এই সিনেমায়। আর সর্বপরি ছিলেন একজন সোনু নিগম যিনি মনে করেন তিনি অভিনয় করছেন!
৩। প্রেম আগান
ফিরোজ খান পরিচালিত এই সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তার ছেলে ফারদিন খান। খারাপ চিত্রনাট্য এবং খারাপ অভিনয়ের সিনেমা হিসেবে ‘প্রেম আগান’ বলিউডের ইতিহাসে অনন্য সিনেমা হিসেবে থাকবে। আপনি যদি সিনেমাটি দেখতে চান তাহলে আপনার মস্তিষ্কের রক্ত ক্ষরণের দায়িত্ব আপানকেই নিতে হবে।
৪। সাওয়ারিয়া
সোনম এবং রণবীর কাপুরের অভিষিক্ত সিনেমাটি এতটাই আলোচিত ছিল যে, সবাই ভেবেছিল এটি একটি সঞ্জয় লীলা বনসালির মাস্টারপিস হবে। রাজ সকিনার প্রেমে পড়ে, তার জন্য একগুচ্ছ গান গায় এবং তাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে কারণ এছাড়া তার আর করার মত কোন কাজ নেই! পরে সকিনা তাকে বলে যে সে ইমানের জন্য অপেক্ষা করছে, যাকে সে ভালোবাসে। পুরো সিনেমাটি একটা অশুভ নীল রঙয়ের আভা আছে যা সিনেমাটিকে বিরক্তিকর করে তোলার জন্য যতেষ্ট।
৫। রাম গোপাল ভার্মা কি আগ
একটি কালজয়ী সিনেমাকে কিভাবে নষ্ট করা যায় তার একটি মানদণ্ড রাম গোপাল ভার্মা দাঁর করিয়েছিলেন এই সিনেমার মাধ্যমে। ‘সোলে’ সিনেমাটির এই রিমেক রীতিমত দর্শকদের জন্য একটি যন্ত্রণার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অমিতাভ বচ্চন, মোহনলাল এবং অজয় দেবগণের মত তারকাকে নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি গত ১০০ বছরে বলিউডে নির্মিত অন্যতম জঘন্য সিনেমা হিসেবে মনে রাখবে ইতিহাস।
৬। রেস ৩
আব্বাস মাস্তান পরিচালিত ‘রেস’ সিনেমাটি দুর্দান্ত একটি ফ্র্যাঞ্ছাইজির সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিলো। সিনেমাটির দ্বিতীয় পর্ব ‘রেস ২’ প্রথম পর্বের মত ভালো না হলেও সেই সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু সালমান খানকে নিয়ে রেমো ডি’সুজা পরিচালিত ‘রেস ৩’ পুরো ফ্র্যাঞ্ছাইজিকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ‘রেস ৩’ সিনেমাটি দেখলে মনে হবে রেমো শুধু ‘অ্যাকশন’ আর ‘কাট’ বলেছেন। নির্মাতা হিসেবে আর কিছুই তিনি করেননি। বাকী যা কিছু হয়েছে সেটা সালমান খান তার পছন্দের কিছু মানুষকে নিয়ে করা তামাশা।
৭। কেয়া কুল হ্যায় হাম সিরিজ
সিনেমা সেন্সর বোর্ড কীভাবে এমন আবর্জনা মুক্তির অনুমতি দিল, সেটা বুঝতে পারছি না! স্টিরিওটাইপিং এবং সরাসরি লিঙ্গবাদের মাধ্যমে দর্শক হাসানোর ব্যার্থ চেষ্টা করেছেন এই সিনেমার নির্মাতারা। এই সিরিজের কোনও সিনেমার জন্য কোনও কিছুর প্রতি আকর্ষন নেই, বিশেষ করে সিনেমাটির ৩য় কিস্তি। তুষার কাপুর এবং আফতাব শিবদাসানি মুখ্য চরিত্রে, তাহলে বুঝে নিন অভিনয়ের দিক থেকে কতটা ফালতু প্রদর্শনি হতে পারে এই সিনেমা!
৮। তিস মার খান
ফারাহ খান নির্মাতা হিসেবে আবর্জান ছাড়া আর কিছু না। ‘তিস মার খান’ সিনেমার মাধ্যমে নিজের এই সুনামকে আরো শক্তিশালী করেছেন তিনি। ক্যাটরিনা কাইফের ‘শিলা কি জওয়ানি’ এবং তার আগের সিনেমা ‘ওম শান্তি ওম’ বক্স অফিস সফল হওয়ার কারনে এই সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে একটি আবর্জনা উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এরপর অবশ্য ফারাহ খান ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ নির্মান করেছিলেন যেটা ছিলো আরো একটি ফালতু সিনেমা।
৯। হিম্মতওয়ালা
সিনেমাটির বর্ননায় উইকিপিডিয়ায় লেখা আছে, ‘একজন দুষ্ট বাড়িওয়ালা একটি মন্দিরের পুরোহিতের বিরুদ্ধে টাকা চুরির মিথ্যা অভিযোগ তোলেন, যার ফলে তিনি আত্মহত্যা করেন। কয়েক বছর পরে, তার ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িওয়ালার প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।‘ কি বুঝলেন? এই সিনেমাটির পরিচালক ফারাহ খানের ভাই সাজিদ খান – আর কিছু বলা লাগবে? না কি পারিবারিক ঐতিয্যের সাথে মিলিয়ে নেবেন?
১০। আপ কা সুরুর
হিমেশ রেশহামিয়াকে অভিনয় করতে দিল কে? এমনকি কে তাকে গান গাইতে দিয়েছে সে প্রশ্নও উত্তরের দাবী রাখে। এই সিনেমাটি এমন একটি ভয়ঙ্কর জিনিস যা আপনি আর কোথাও দেখার সুযোগ পাবেন কিনা জানি না। সিনেমাটিতে মল্লিকা শেরাওয়াত একজন আইনজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যদিও, তাকে সবসময় নাচতে দেখা গেছে। ‘কোই..মিল গায়া’র শিশুটি হঠাৎ করে পূর্ণ বয়স্ক হয়ে যায় এবং ‘জার্মানি’ শব্দটি ২,৯৬০,০৪৭ বার উচ্চারিত হয়েছে৷
১১। রাসকেলস
কঙ্গনা রানাউতের কিছু সুন্দর দৃশ্য আছে যা সে যদি চায় তাহলে ফিরে দেখতে পারে, এছাড়া সিনেমাটিতে আর কিছু নেই৷ এই সিনেমায় সঞ্জয় দত্ত, অজয় দেবগন এবং অর্জুন রামপালকে পুরুষের চরিত্রে দেখানো হয়েছে। এটি এমন এক ধরণের কমেডি সিনেমা যা আপনি দেখতে বসলে কেবল নিজেকে থাপ্পড় মারতে চাবেন এবং জানালা দিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজবেন।
১২। গুড বয় ব্যাড বয়
২০০০-এর দশকের আরেকটি সিনেমা যা কখনই তৈরি করা উচিত হয়নি। ইমরান হাশমি এবং তুষার কাপুর অভিনীত এই সিনেমাটির কোন মাথা বা লেজ নেই। সিনেমাটি দেখে মনে হবে তারকাদের নিজেদের মত করে কিছু করতে বলা হয়েছে এবং তা ক্যামেরায় ধারন করে সিনেমা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলিউড দর্শকরা মনে হয় এর চেয়ে ভালো কিছুর দাবী রাখে।
১৩। রাধে – ইউর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই
‘ওয়ান্টেড’ সিনেমার মাধ্যমে রাধে চরিত্রটিকে সালমান খান অভিনীত একটি আইকনিক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রভুদেবা। গত বছর ২০২১ সালে ‘রাধে – ইউর মোস্ট ওয়ান্টেড ভাই’ সিনেমার মাধ্যমে চরিত্রটির রীতিমত বারোটা বাজিয়েছেন সেই প্রভুদেবা। ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি সাম্পতিক সময়ে বলিউডে নির্মিত অন্যতম বাজে চিত্রনাট্যের সিনেমা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলো। অবশ্য সিনেমাটি দেখার পর আপনার মনে হয়তেই পারে – আদৌকি কোন চিত্রনাট্য ছিলো এই সিনেমার?
১৪। যাব হ্যারি মেট সেজাল
শহারুখ খান এবং আনুশকা শর্মাকে নির্মিত ইমতিয়াজ আলীর এই সিনেমাটি সম্ভবত শাহরুখ খানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সিনেমা ছিলো। নিজেদের সেরা সময়ে শাহরুখ খান এবং আনুশকা শর্মার এই সিনেমাটিতে অভিনয় করতে রাজি হওয়ার একটাই কারন থাকতে পারে আর তা হলো সিনেমাটির চিত্রনাট্য না পড়েই অভিনয় করতে সম্মতি দেয়া। অবশ্য চিত্রনাট্য না পড়ার কারন হতে পারে যে, ইমতিয়াজ আলী আসলে সিনেমাটির জন্য কোন চিত্রনাট্য তৈরিই করেন নি!
১৫। প্রেম রতন ধন পায়ো
সুরাজ বরজাতিয়া ১৯৯২ সালে যেরকম সিনেমা নির্মান করতেন নিজের বানানো টাইম মেশিনের উপর ভর করে ২০১৫ সালে একই রকম সিনেমা নির্মান করেছেন তিনি। তার প্রতিটি সিনেমার কেন্দ্রীয় পরিবার একান্নবর্তী, সবাই বিত্তশালী, বড় বড় ব্যবসায়ের মালিক! তারা সবসময় একসাথে বসে নাচ-গান করে, তাদের ব্যবসা কিভাবে চলে সেটা অবশ্য তিনি নিজেই বলতে পারেন। ২০১৫ সালে এসে নিজের আগের সিনেমাগুলোর কাহিনী থেকে কিছুটা পরিমার্জন করে নির্মান করেন ‘প্রেম রতন ধন পায়ো’। আর এ কারনেই হয়তো সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখার পিছনে সময় নষ্ট করেন নি সুরাজ।
উপরে উল্লেখিত সিনেমাগুলো ছাড়া আরো এমন অনেক সিনেমাকে এই তালিকায় আনা সম্ভব। তবে সব সিনেমার প্রতি প্রত্যাশা একই রকম থাকেনা। এই সিনেমাগুলোর সার্বিক দিক বিবেচনায় এই সিনেমাগুলোর প্রতি প্রত্যাশা থেকেই এই আলোচনা। এর মধ্যে কিছু সিনেমা আবার বক্স অফিসে সফলও হয়েছিলো।
আরো পড়ুনঃ
বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানের ‘উড়ান’: যুগান্তকারী যে সিনেমার গল্প আজও প্রাসঙ্গিক
জীবন সম্পর্কে ধারনা পরিবর্তন করে দেয়ার মত ৫টি বলিউড সিনেমা
হলিউডের যে সিনেমাগুলো বলিউড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছিলো